শিয়া মাযহাবের ভাবমূর্তি নষ্টের ক্ষেত্রে গোলাতদের ষড়যন্ত্র- ২

“মেলাল ওয়ান নাহল” নামক গ্রন্থে গোলাতদের ১০টি দলের কথা উল্লেখ করেছেন। (আল মেলাল ওয়ান নাহল, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭৪, ১৯০) গোলাত মতাদর্শের অনুসারীরা মহান আল্লাহ, ইমাম এবং সাহাবিদের রূপক অর্থে ব্যাবহার করেছে। আর এ কারণে বিভিন্ন যুগে অনেক ব্যাক্তিত্বদেরকে হত্যা কর

শিয়া মাযহাবের ভাবমূর্তি নষ্টের ক্ষেত্রে গোলাতদের ষড়যন্ত্র- ৩

এস, এ, এ

...পূর্বের আলোচনায় আমরা আমাদের সম্মানিত পাঠকদের আরো অবগতির জন্য গোলাতদের পরিচিতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকে আমরা তাদের বিভিন্ন দল ও মত সম্পর্কে আলোচনা করবো।

শাহরিসতানি তার “মেলাল ওয়ান নাহল” নামক গ্রন্থে গোলাতদের ১০টি দলের কথা উল্লেখ করেছেন। (আল মেলাল ওয়ান নাহল, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭৪, ১৯০)

গোলাত মতাদর্শের অনুসারীরা মহান আল্লাহ, ইমাম এবং সাহাবিদের রূপক অর্থে ব্যাবহার করেছে। আর এ কারণে বিভিন্ন যুগে অনেক ব্যাক্তিত্বদেরকে হত্যা করা হয়েছে। (কুল্লিয়াত ফি ইলমে রেজাল, পৃষ্ঠা ৩৫৬, ৩৫৭)

“মেলাল ওয়ান নাহল” নামক গ্রন্থে কিছু ফেরকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইসলামের শত্রুরা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উক্ত ফেরকাগুলোকে শিয়াদের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছে। আর উক্ত বৃথা চেষ্টার জন্য যে সকল  দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে তা কোনটাই বিশ্বস্ত  বা সঠিক না। (আল মেলাল ওয়ান নাহল, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২০১, ১৪৪, লোগাত নামে দেহখোদা, পৃষ্ঠা ১৬৫৬৯৭, ১৬৫৬৬৭)

পূর্বে হয়তো উক্ত ফেরকা সমুহের কোন অস্তিত্ব ছিল কিন্তু বর্তমানে তার আর কোন অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। এখানে একটি প্রশ্নের সঞ্চার হতে পারে আর তা হচ্ছে  মেলাল ওয়ান নাহলে যে উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার উৎস কোথায়? আর কেন উক্ত ফেরকা সমূহের মধ্যে বেশিরভাগ ফেরকাকে শিয়া মাযহাবের সাথে সম্পৃক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে? (আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা ওয়া আসাতিরে আখেরি, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৭২)

প্রকৃত পক্ষে উক্ত গোলাত মতাদর্শের ফেরকাগুলো ইমাম (আ.)’দেরকে ভুল বুঝার কারণে সৃষ্টি হয়নি বরং অনেক ফেরকা সমূহ ইমাম (আ.)’দের সাথে শত্রুতা থাকার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। তারা শত্রুতার কারণে নিজেদেকে শিয়া বলে পরিচয় দিত। আর এভাবেই নিজেদের মতাদর্শকে আহেলে বাইত (আ.)’দের নামে প্রতিষ্ঠা এবং ইমাম (আ.)দের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করার চেষ্টা করতো। কিন্তু ইমাম (আ.)’দের একনিষ্ঠতা তাদের সকল ষড়যন্ত্রের বেড়া জাল কে ছিন্ন করে দিয়েছিল।

কিছু গোলাত মতাদর্শি যেমন: আবুল খাত্তাব, মুগাইরা, বায়ান বিন সামআন পার্থিব মোহে চমরভাবে আকৃষ্ট হওয়ার কারণে তারা নবুওয়াতকে  ইমামদের সাথে সম্পৃক্ত করে  এবং নিজেদেরকে ইমাম বা ইমাম (আ.)’এর নায়েব হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করেছিল। (ফেরাকুশ শিয়া, পৃষ্ঠা ৪২, ৪৩)

তারা এভাবে জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যেমে নিজেদের মূখ্য উদ্দেশ্যে পৌছানোর চেষ্টা করেছিল। তারা মনে করতো যে, তাদের দাবি যতই বড় বা বেশি হবে ততই তারা তাদের মতাদর্শের প্রতি সাধারণ মানুষদেরকে আকৃষ্ট করতে পারবে। (তারিখে ইলমে কালাম ওয়া মাযাহেবে ইসলামি, পৃষ্ঠা ১২২)

কিছু গোলাতগণ তাদের সকল ধরণের প্রচার প্রসারকে জায়েজ বলে মনে করতো এবং নিজেদেরকে ইমাম (আ.)’দের নায়েব বলে প্রচার করতো। তারা এভাবেই নিজেদের সকল স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করতো। আর এভাবেই ধিরে ধিরে বিভিন্ন গোলাত মতাদর্শি ফেরকা সমূহের সৃষ্টি হয়। আর তাই উক্ত কারণ সমূহের জন্য আমরা গোলাতদেরকে শিয়া মাযহাবের শাখা বলে মনে  করতে পারি না। বরং উক্ত গোলাত মতাদর্শিরা শিয়া মাযহাব এবং পবিত্র ইমাম (আ.)দের প্রকৃত ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য বিভিন্নভাবে হাদিস জাল করতো, ইমাম (আ.)দের সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিতো।

গোলাতদের ষড়যন্ত্র:

ইমাম (আ.)দের প্রকৃত ভাবমূর্তিকে নষ্ট করা:

গোলাত মতাদর্শিরা ইমাম (আ.)দের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিত এবং নিজেদেরকে ইমাম (আ.)দের নায়েব বলে পরিচয় করানোর মধ্যেমে নিজেদের বাতিল আকিদা এবং চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশের চেষ্টা করতো। এভাবে তারা সাধারণ জনগণকে শিয়া মাযহাবের বিরোধি করে তুলতো। গোলাতদের কারণে সে যুগে সাধারণ জনমনে শিয়াদের প্রতি ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি যে, আবু হানিফা গাদিরে খুমের হাদিস বর্ণনা করতেন না  এমনকি তার অনুসারিদেরকেও উক্ত হাদিসটি বর্ণনার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করতেন।

হেইসাম বিন হাবিব এ সম্পর্কে আবু হানিফাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আপনার কাছে কি গাদিরে খুমের হাদিস বর্ণিত হয়নি? আবু হানিফা বলেন হ্যাঁ হয়েছে। তাহলে কেন আপনি তা বর্ননা করতে বাধা প্রদান করেন? আবু হানিফা তার জবাবে বলে: আমার কাছে উক্ত হাদিসটি প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু কিছু গোলাত মতাদর্শিদের কারণে আমি উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করতে নিষেধ করেছি। (আমালি সাদুক, পৃষ্ঠা ২৬, ২৭)

আহলে সুন্নাতের হাদিসের গ্রন্থ সহিহ বুখারিতে এমন কিছু হাদিস বর্ণনাকারিদের হাদিসকে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু রাসুল (সা.)’এর নির্বাচিত পবিত্র ইমাম (আ.)দের থেকে কোনই হাদিস বর্ণনা করা    হয়নি। (দারাসাত ফিল কাফি লিলকুলাইনি ওয়াল সাহিহ লিলবুখারি, পৃষ্ঠা ২৩, ১৬৪, ১৬৫)

আহলে সুন্নাতের অনেক আলেমগণ গোলাত এবং শিয়াদের ইমাম (আ.)দের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য নির্ধারণ করেননি। বর্তমান যুগের আব্দুস সালাম নামক আহলে সুন্নাতের একজন লেখক তার গ্রন্থে আহলে বাইত (আ.)কে গোলাতদের সাথে সম্পর্কের কথা  উল্লেখ করেছেন। (গালিয়ান, পৃষ্ঠা ৩১৩)

গোলাতদের অসৎ কর্মপন্থার কারণে শিয়াদের ইমাম (আ.)দের বিরূদ্ধে প্রচারণা শুরু হয় এবং এভাবে তাদের প্রকৃত ভাবমূর্তিকে খারাপ করার চেষ্টা করা হয়। ইয়াহিয়া বিন আব্দুল হামিদুল হামানি ইমাম আলি (আ.)’এর ইমামত প্রমাণের ক্ষেত্রে লিখেছেন যে, একদা আমি “শারিক” নামক এক হাদিস বর্ণনাকারিকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, কেন সাধারণ জনগণ জাফর বিন মোহাম্মাদ(আ.) থেকে বর্ণিত হাদিসকে দূর্বল বলে মনে করে? শারিক তার উত্তরে বলে জাফর বিন মোহাম্মাদ ছিলেন একজন সৎ ও পরহেজগার মুসলমান। কিন্তু কিছু অজ্ঞ লোজন তার কাছে যাতায়াত করতো এবং তারা তাঁর নামে জাল হাদিস বর্ণনার মাধ্যেমে জনগণকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করতো এবং তাদের মাধ্যেমে সুবিধা ভোগ করতো।  তারা এমনভাবে হাদিস বর্ণনা করতো যেন সাধারণ জনগণ তাদের সংস্পর্শে এসে পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।

অতঃপর শারিক আরো বলে যে, মহান আল্লাহ তায়ালার শপথ জাফর বিন মোহাম্মাদ (আ.) কখনই এ ধরণের হাদিস বর্ণনা করেননি।  কেননা আমি জাফর বিন মোহাম্মাদ অন্যান্যদের তুলনায় উত্তম এবং ভালভাবে চিনি এবং জানি। (এখতিয়ারে মারেফাতুর রেজাল, ৩২৪, ৩২৫)

আবু বাসির বলেন: আমি আবু আব্দুল্লাহ অর্থাৎ ইমাম সাদিক (আ.) বলি যে, গোলাত মতাদর্শের লোকেরা আপনার সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলে বেড়ায়। তিনি জিজ্ঞাসা করেন তারা কি বলে? আমি তাঁর উত্তরে বলি যে, তারা বলে আপনি বৃষ্টির ফোটা, নক্ষত্রের সংখ্যা, গাছের পাতার সংখ্যা, সমুদ্রগর্ভে বিভিন্ন সৃষ্টির ওজন, পাথরের সংখ্যা সম্পর্কে আপনি অবগত। তখন ইমাম (আ.) তাঁর দুই হাতকে আকাশের দিকে উত্তলোন করে বলেন: সুবহান আল্লাহ! সুবহান আল্লাহ! মহান আল্লাহর শপথ এসকল বিষয়ে এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ অবগত না! (এখতিয়ারে মারেফাতুর রেজাল, পৃষ্ঠা ২৯৯)

নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত সম্পর্কে গোলাত মতাদর্শের চিন্তাধারা হচ্ছে শুধুমাত্র ইমাম (আ.)দেরকে ভালবাসলেই শরিয়তের ওয়াজিব কাজগুলো সম্পাদনের আর কোন প্রয়োজন নেই। (মারেফাতুল হাদিস, পৃষ্ঠা ৬৭)

তারা তাদের উক্ত চিন্তাধারার মাধ্যেমে ইসলামের সকল বিষয়কে জায়েজ বলে মনে করে এবং তারা উক্ত পন্থার মাধ্যেমে অসংযত মানুষদেরকে অতি সহজেই আকৃষ্ট করতো। (গালিয়ান, পৃষ্ঠা ২৯২- ৩০১)

আর এভাবেই গোলাতরা ইমাম (আ.)দের ভাবমূর্তি নষ্ট করার আপ্রাণ চেষ্টা করতো।

চলবে...

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন