সত্যের আলোয় চির-উজ্জ্বল হযরত মাসুমা (সা.)
সত্যের আলোয় চির-উজ্জ্বল হযরত মাসুমা (সা.)
হযরত মাসুমা (সা.) ইসলামের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রকৃত ইসলাম বা খাঁটি মোহাম্মদী ইসলামের নূরানী ধারার সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারে এ মহিয়সী নারীর বুদ্ধিদৃপ্ত সংগ্রামী ভূমিকা তাঁকে শ্রদ্ধার অক্ষয় আসনে সমাসীন করেছে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইত (আ.) আলোকিত চরিত্র ও মানবীয় সব গুণাবলীর শ্রেষ্ঠ আদর্শ। মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সা.)-কে প্রদীপের সাথে তুলনা করেছেন। প্রদীপের বৈশিষ্ট্য হল, এক প্রদীপ থেকে জ্বালানো যায় অনেক প্রদীপ। তেমনি করে মহাপুরুষেরাও সৃষ্টি করতে পারেন অনেক মহামানব-মহামানবী। বিশ্বনবী (সা.)'র আলোকিত শিক্ষায় প্রশিক্ষিত তাঁরই পবিত্র আহলে বাইত বা নিষ্পাপ বংশধারায় জন্ম নেয়া মহান ইমাম হযরত মূসা কাযেম (আ.)'র কন্যা ছিলেন হযরত মাসুমা (সা.) এবং নিষ্পাপ ইমাম হযরত ইমাম রেজা(আ.) ছিলেন তাঁর ভাই। তাঁর মূল নাম ছিল ফাতেমা এবং "মাসুমাহ" ছিল ভাই ইমাম রেজা (আ.)'র দেয়া উপাধি । হযরত মূসা কাযেম (আ.)'র সন্তানদের মধ্যে ইমাম রেজা(আ.)'র পর তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও সবার শ্রদ্ধার পাত্র। মহান নিষ্পাপ ইমামগণ এবং ধর্মীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বরাও এ মহিয়সী নারীর অসাধারণ মহত্ত্ব ও নানা গুণের কারণে তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করেছেন। যেমন, [হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)'র নাতি হযরত ইমাম বাকের (আ.)'র পুত্র] হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) হযরত মাসুমা (সা.)'র জন্মের অনেক বছর আগেই বলেছিলেন,
" মুসা কাযেমের(আ.) কন্যা ফাতেমা নামে আমার এক বংশধর (নাতনী) কোম শহরে মৃত্যু বরণ করবে। যারাই তাঁর কবর জিয়ারত করবে, বেহেশত তার জন্য ওয়াজিব হবে।" তিনি সব ধরণের বিচ্যুতি ও মন্দ দিক বা বিষয় থেকে দূরে ছিলেন বলে ভাই হযরত ইমাম রেজা (আ.) তাকে "মাসুমাহ" বা "নিষ্পাপ" বলে উপাধি দিয়েছিলেন।
হযরত মাসুমা (সা.) ২০১ হিজরীতে ইরানের কোম শহরে আসেন। ভাই ইমাম রেজা(আ.)'র সাথে সাক্ষাতের জন্য তিনি পবিত্র মদীনা শহর থেকে তৎকালীন ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত মার্ভ শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি সফর অব্যাহত রাখতে পারেননি। তাই তিনি কোম শহরে যান এবং এখানেই ইন্তেকাল করেন।
বেহেশতী নারীকূলের নেত্রী নবী-নন্দিনী হযরত ফাতেমা (সা.)'র বংশধরদের মধ্যে হযরত যেইনাব (সা.) ছাড়া অন্য কেউই প্রখর বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, এবাদত, খোদাভীরুতা ও সংগ্রামী চরিত্রের দিক থেকে হযরত মাসুমা (সা.)'র মত প্রসিদ্ধ নন। তিনি শৈশবেই ধর্ম ও ধর্মীয় আইন সম্পর্কে মানুষের নানা প্রশ্নের জবাব দিতেন। সে যুগের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশও তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়ক হয়েছে।
হযরত মাসুমা (সা.)'র যুগে আব্বাসীয় শাসকরা জুলুম, নির্যাতন ও ত্রাসের এক শ্বাঁসরূদ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ইমাম রেজা (আ.) ও তাঁর বোন হযরত মাসুমা (সা.) আব্বাসীয় শাসকদের চরিত্র ও নীতি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। আব্বাসীয় শাসকের নির্দেশে হযরত মূসা কাযেম (আ.)কে শহীদ করা হয়েছিল। তৎকালীন শাসকদের হাতে জনগণের প্রতারিত হওয়ার পরিণাম কি হতে পারে সে সম্পর্কেও ইমাম রেজা (আ.) ও তাঁর বোন ধারণা রাখতেন। ইমাম পরিবারের সদস্য হিসেবে জুলুম ও অত্যাচারের মোকাবেলায় প্রতিরোধের শিক্ষাও রপ্ত করেছিলেন হযরত মাসুমা (সা.)। তাই তিনি দূরদর্শিতা নিয়ে সত্যকে সংরক্ষণের পথেই অগ্রসর হন।
হযরত মাসুমা (সা.) নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। এ জন্য তিনি "মুহাদ্দেসাহ" উপাধি পেয়েছিলেন। পিতা ইমাম মুসা কাযেম (আ.) কারাবন্দী থাকায় অনুসারীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারতেন না। ত্রাস ও নির্যাতনের ওই পরিবেশে হাদীস প্রচারের মাধ্যমে হযরত মাসুমা (সা.) বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতই যে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক নেতৃত্বের প্রকৃত হকদার বা যোগ্য ব্যক্তিত্ব তা তুলে ধরেছিলেন। ভাই হযরত ইমাম রেজা(আ.)'র ইমামতের যুগেও তিনি কিছু হাদীস তুলে ধরে ইমামতের ভিত্তিকে শক্তিশালী করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে "হাদীসে মানযেলাত" উল্লেখযোগ্য। এ হাদীসে বিশ্বনবী (সা.) হযরত আলী (আ.)'র সাথে তাঁর সম্পর্ককে মূসা (আ.) ও হারুন (আ.)'র সম্পর্কের সাথে তুলনা করেছেন। এ ছাড়াও তিনি গাদিরে খুমের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঘটনাও তুলে ধরেছিলেন যাতে মুসলমানরা বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারে এবং রাসূলের(সা.) রেখে যাওয়া এ আমানত সম্পর্কে বিভ্রান্ত ও অসচেতন না হয়।
খলিফা মামুন হযরত ইমাম রেজা(আ.)-কে যুবরাজ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব দিলে এর জবাবে তিনি যে প্রজ্ঞাপূর্ণ উত্তর দিয়ে মামুনের দুরভিসন্ধি বা জনমতকে ধোকা দেয়ার উদ্যোগ সবার কাছে স্পষ্ট করেছিলেন হযরত মাসুমা (সা.) তা বার বার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। ইমাম মামুনকে বলেছিলেন, "খেলাফত যদি তোমার অধিকার হয়ে থাকে, তাহলে তা অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা উচিত নয়, আর এটা যদি তোমার অধিকার না হয়ে থাকে তাহলে কেন নিজে খলিফার পদে বসেছ এবং যুবরাজ নির্বাচন করছ?"এভাবে তিনি বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতই যে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক নেতৃত্বের প্রকৃত হকদার বা যোগ্য ব্যক্তিত্ব তা মুসলমানদের কাছে তুলে ধরেছিলেন।
খলিফা মামুন ইমাম রেজা(আ.)-কে মদীনা ত্যাগ করে মার্ভে আসতে বাধ্য করেছিলেন। ভাইয়ের প্রতি স্নেহ-মমতা ও আনুগত্যের টানে এবং মদীনায় নিরাপত্তার হুমকির কারণে মার্ভে আসতে চাইছিলেন মহিয়সী নারী হযরত মাসুমা (সা.)। ইমাম রেজা(আ.)ও তাঁকে হিজরত করে মার্ভে চলে আসতে বলেন। ইমাম বংশের বিশ জন সদস্য নিয়ে তিনি মার্ভের দিকে রওনা দেন। পথে তাঁর কাফেলা যে জনপদ বা শহরেই থামত, জনগণ তাঁদেরকে ব্যাপক সম্বর্ধনা জানাত। এ সময় তিনি জনগণের কাছে বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইত-এর মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। এ কারণেই তাঁর কাফেলা যখন সভে শহরের কাছে পৌঁছে তখন আহলে বাইতের বিরোধী একদল লোক তাঁদের এগিয়ে যেতে বাধা দেয় এবং তাঁদের আটকে রাখে। তারা হযরত মাসুমা (সা.)'র একদল সঙ্গীকে শহীদ করে। এ ঘটনায় তিনি কষ্ট পান এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে মার্ভের দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখতে অক্ষম হন নবী(সা.) বংশের এই উজ্জ্বল প্রদীপ। এরপর তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে কোম শহরে আনা হয়। তিনি বলেছেন, "বাবার কাছে শুনেছি যে কোম আমাদের অনুসারীদের কেন্দ্র।"কোম শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এ শহরে তাঁর আগমনের খবর শুনে যেন আকাশের চাঁদ কাছে পেল। তারা তাঁকে ব্যাপক সম্বর্ধনা জানায়।
অসুস্থ হযরত মাসুমা (সা.) কোমে আসার পর মাত্র ১৭ দিন বেঁচেছিলেন। কিন্তু এ অল্প কয়েক দিনেই তিনি কোমে রেখে গেছেন বরকত ও কল্যাণের অফুরন্ত ফল্গুধারা। তাঁরই মাজারের পাশে গড়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ও বৃহৎ ধর্মীয় শিক্ষালয়। নবী(সা.) বংশের সেই উজ্জ্বল প্রদীপ এভাবে আরো হাজারও প্রদীপ ও বরেণ্য আলেম সৃষ্টির পথ খুলে দিয়েছেন। সারা বিশ্বের আহলে বাইত প্রেমিকদের জন্য হযরত মাসুমা (সা.)'র মাজার প্রাণ-জুড়ানো এক অনন্য আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ও যেন সুরম্য বেহেশতী উদ্যাণের অবিচ্ছেদ্য টুকরো। আরো একবার সবাইকে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে শেষ করছি এ বিশেষ আলোচনা।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন