ইমাম রেযা (আ.) কিভাবে শাহাদত বরণ করেন?
ইমাম রেযা (আ.) কিভাবে শাহাদত বরণ করেন?
একদা ইমাম রেযা ( আঃ ) সকালের নামায আদায় করলেন। নতুন জামা পরে তিনি মেহরাবে বসলেন। মনে হচ্ছিল যেন তিনি জানতেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তাঁর চেহারা অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জল দেখাচ্ছিল। ইমান আর প্রেমের পৃথিবী যেন তাঁর চোখগুলোতে তরঙ্গায়িত হচ্ছিল। হঠাৎ মামুনের দূত তাঁর ঘরে এসে বললো-খলিফা মামুন আবাল হাসান বা ইমাম রেযা (আ) কে তার কাছে ডেকে পাঠিয়েছেন। ইমাম তখনি দূতের সাথে রওনা হলেন। মামুন আনন্দের সাথে ইমামকে স্বাগত জানালো। মামুন বহুভাবে জনগণের কাছে ইমামের জনপ্রিয়তা খর্ব করতে এবং ইমামের গ্রহণযোগ্যতা কমাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেসব কোনো কাজেই আসে নি। মামুন ভালোভাবেই জানতো যে যতোদিন ইমামের অস্তিত্ব জনগণের সামনে সূর্যের মতো দেদীপ্যমান থাকবে,ততোদিন জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে সূর্যের সামনে মোমের আলোর মতো নি®প্রভ। এ বিষয়টি মামুনকে সবসময় ভাবিয়ে তুলতো।
মামুন একটু হাঁটলো। মুখে কোনো কিছু বললো না। বড়ো একটা ফলের ঝুড়ি থেকে এক গুচ্ছ আঙ্গুর তুলে নিয়ে কটা খেল। তারপর ইমামের সামনে গিয়ে তাঁর দু'চোখের ঠিক মাঝখানটায় চুমু খেল। ইমামের হাতে আঙ্গুরের আরেকটি গুচ্ছ দিয়ে বললো-হে রাসূলের সন্তান!এর চেয়ে ভালো আঙ্গুর আর দেখি নি। ইমাম বাক-নৈপুণ্যের সাথে জবাব দিলেন-কিন্তু বেহেশতের আঙ্গুর এরচেয়েও সুস্বাদু এবং মজার। মামুন সৌজন্য দেখিয়ে ইমামকে ঐ আঙ্গুর খেতে বললো। ইমাম খেতে চাইলেন না। কিন্তু মামুন আঙ্গুর খাওয়ার জন্যে ইমামকে খুবই পীড়াপীড়ি করলো। জোর করে সে ইমামকে ঐ আঙ্গুর খাওয়ালো। বিষাক্ত ঐ আঙ্গুর খাবার পর ইমামের ঠোঁটের কোণে তিক্ততার হাসি ফুটে উঠলো। হঠাৎ তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলো। আঙ্গুরের গুচ্ছকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পা বাড়ালেন।
আবাসাল্ত ছিলেন ইমাম রেযা (আ) এর ঘনিষ্টদের একজন। তিনি ইমামকে আনন্দিত হলেন। কেননা নবী পরিবারের সন্তান ছিলেন ইমাম। আর ইমামের মহান ব্যক্তিত্বের আলোয় তিনি আলোকিত হতে পারবেন-এরকম চিন্তা ছিল তার। তার দৃষ্টিতে ইমাম সবার অন্তরকে আলোকিত করতেন। ইমামকে স্মরণ করে তিনি বলেছেন-‘ইমাম এবং নেতা, যমিনে আল্লাহর বান্দাদের ওপর তাঁর বিশ্বস্ত বান্দা ও হুজ্জাত...আল্লাহর পথে আহ্বানকারী এবং তাঁর আদেশ-নিষেধের সীমারেখা রক্ষাকারী। ইমাম গুনাহ থেকে মুক্ত এবং দোষ-ত্র"টি থেকে দূরে ছিলেন। জ্ঞানের আলোয় সমৃদ্ধ ছিলেন তিনি এবং ছিলেন অপরিসীম সহনশীল। ইমাম ছিলেন মুসলমানদের মান-মর্যাদা,গর্ব ও সম্মান এবং দ্বীনের সুরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী ।
আবা সালত এইসব চিন্তা করছিলেন। সেজন্যে ইমামের অবস্থাটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইমাম শাহাদাতবরণ করলেন। সেই দিনটি ছিল ২০৩ হিজরীর সফর মাসের শেষদিন।
ইমাম রেযা (আ) ছিলেন পূত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহর প্রতি গভীর ঈমান ছিল তার। তিনি জনগণের ব্যাপারে ছিলেন দায়িত্ব সচেতন। এইসব বৈশিষ্ট্য তাঁকে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি আধ্যাত্মিক ব্যাপারে ছিলেন গভীরভাবে মনোযোগী।ইবাদাত-বন্দেগিতেই অধিকাংশ সময় কাটানোর চেষ্টা করতেন তিনি। মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল। তাছাড়া আপামর জনগণের চাওয়া-পাওয়া মেটানোর চেষ্টা করতেন তিনি। রোগীদের দেখাশোনা করতেন। আর মেহমান বা অতিথি পরায়নতার ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ উদার। তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের কথা শুনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু চিন্তাবিদ ও মনীষী তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন। ইমাম রেযা (আ) তাঁর ইমামতির সময় বহু বিদ্যার্থীকে জ্ঞান দান করেন এবং তাফসিরে কোরআন, হাদীস,নীতি-নৈতিকতা এমনকি ইসলামী চিকিৎসা সম্পর্কে মূল্যবান বহু গ্রন্থও রচনা করেন। এসবের বাইরে ইমামের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিলো রাজনৈতিক সংগ্রাম।
খেলাফতের শুরু থেকেই আহলে বাইতের মহান ইমামগণ সর্বপ্রকার বিচ্যুতি ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। ইমাম রেযা (আ) ও তাঁর সময়ে সকল প্রকার জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। কিন্তু ইমাম রেযা (আ) এর সময়ে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁর সময়ে এমন এক রকম রাজনৈতিক শীতল যুদ্ধ চলছিল যে জয়-পরাজয় তখন মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারণী ব্যাপার ছিল। একদিন মামুন ইমামের জ্ঞান-গুণ,আধ্যাত্মিকতা,ইবাদাত,নেতৃত্ব সবদিক থেকেই তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বে মহিমায় মহিমান্বিত করে কথা বললো। ইমাম তার কথার জবাবে বললেন- আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে গর্বিত। তাকওয়ার মাধ্যমে এবং আল্লাহর অশেষ রহমতে আল্লাহর দরবারে সম্মানজনক একটি অবস্থানের আশা করছি।
মামুন বললো-আমি চাচ্ছি যে , খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব আপনার ওপর ন্যস্ত করবো। ইমাম জবাবে বললেন,"মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেন , তাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারি না হয়ে থাক , তাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই। তুমি নিজেই জানো কে এজন্যে সবার চেয়ে বেশি উপযুক্ত।" এরকম কঠিন সত্য কথা মামুনের জন্যে অসহনীয় ছিল। তারপরও সে চেষ্টা করেছে তার রাগটাকে লুকিয়ে রাখতে। তারপর বললো-হে নবীর সন্তান! তাহলে নিশ্চয়ই যুবরাজ তথা সিংহাসনের উত্তরাধিকারের প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন! ইমাম বললেন,অবশ্যই আমি এই কাজটা নিজের ইচ্ছায় করবো না। মামুন বললো,হে নবীর সন্তান! তুমি বুঝি চাচ্ছো যুবরাজ হবার প্রস্তাবের বাইরে থেকে জনগণকে এটা বোঝাতে যে আলী ইবনে মুসা আররেযা পার্থিব এই পৃথিবী সম্পর্কে উদাসীন!
ইমাম বললেন,আমি তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানি। তুমি চাচ্ছো জনগণ যাতে বলে যে,আলী ইবনে মুসা রেযা (আ) পার্থিব জগতের ব্যাপারে নির্মোহ ছিলেন না,খেলাফতের স্বাদ গ্রহণ করার জন্যে তিনি যুবরাজ হবার প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন।
যাই হোক,শেষ পর্যন্ত মামুন ইমামকে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকার তথা যুবরাজ হবার প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করলো। তবে এই শর্তে যে,হুকুমাতের কোনো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থাকবে না।-এভাবে ইমাম অত্যন্ত সচেতনভাবে জনগণকে বোঝালেন যে তিনি মামুনের রাজনীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং হুকুমাতের কোনো দায়িত্ব তিনি পালন করবেন না। এভাবে ইমামের আধ্যাত্মিক মর্যাদা আরো বেড়ে গেল। তিনি কেন এ ধরনের শর্তারোপ করেছিলেন , তার কারণ দায়িত্ব গ্রহণকালে প্রদত্ত তাঁর মুনাজাত থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি মুনাজাতে বলেছিলেন,হে খোদা ! তুমি ভালো করেই জানো , আমি বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সুতরাং আমাকে এজন্যে পাকড়াও করো না। যেমনিভাবে তুমি ইউসূফ ও দানিয়েল ( আ ) কে পাকড়াও করো নি। হে আল্লাহ ! তোমার পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যতিত আর কোনো কর্তৃত্ব হতে পারে না। আমি যেন তোমার দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে পারি , তোমার নবীর সুন্নাতকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি। "
ইমাম রেযা (আ) শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চলে গেছেন তাঁর প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে। আমাদের জন্যে রেখে গেছেন তাঁর আদর্শ। আমরা যদি তাঁর আদর্শকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারি-তবেই আমাদের জীবন হবে সার্থক সমুজ্জ্বল।
সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। এই দ্বন্দ্বে নবীবংশের মহান ইমামগণ যুগে যুগে যে কালজয়ী অবদান রেখেছেন, তা আজো জনমনে সত্যের পথাবলম্বনের অনুপ্রেরণা জোগায়। ইমাম রেযা (আ.) এর শাহাদাতের ঘটনাটিও তেমনি একটি অনুপ্রেরণার উৎস। আমরা তাঁর শাহাদাতের নেপথ্য ঘটনাবলী বিশে-ষণের মাধ্যমে সেই সত্যকে উন্মোচন করার চেষ্টা করবো।
আব্বাসীয় শাসকদের মধ্যে বাদশা হারুন এবং মামুনই ছিল সবচে' পরাক্রমশালী এবং দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। তারা প্রকাশ্যে আহলে বাইতের ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তির কথা বলে বেড়াতেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইমামদের প্রতি ভীষণ বিদ্বেষী ছিলেন। ইমামদের প্রতি তাঁদের এধরণের আচরণের উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক, আলাভিদের আন্দোলনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এবং দুই শিয়া মুসলমানদের মন জয় করা। ইমামদের সাথে সম্পর্ক থাকার প্রমাণ থাকলে তাদের শাসন সকল মুসলমানের কাছে বৈধ বলে গৃহীত হবে-এ ধরণের চিন্তাও ছিল তাদের মনে। কেননা ;মুসলমানরা যদি দেখে যে , হযরত আলীর (আ) পরিবারবর্গের সাথে বাদশাহর সম্পর্ক বা যোগাযোগ রয়েছে , তাহলে তারা আব্বাসীয়দের শাসনকে বৈধ মনে করে খুশি হবে , ফলে তারা আর বিরোধিতা করবে না । এরফলে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হবে। ইমাম রেযা (আ) শাসকদের এই অভিসন্ধিমূলক রাজনীতি বুঝতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তাঁর ঐ কৌশলটির ফলে একদিকে বাদশা মামুনের উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয় , অপরদিকে মুসলিম বিশ্বের জনগণও প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারে। এ সময় নবীবংশের সমর্থকরা প্রচার করতে থাকেন যে , আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ইসলামী খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকার কেবলমাত্র নবী পরিবারের পবিত্র ইমামগণের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং তাঁরা ব্যতীত কেউ ঐ পদের যোগ্য নয়। জনগণের মাঝে এই সত্য প্রচারিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাদশার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে-এই আশঙ্কায় মামুন ইমাম রেযাকে (আ) সবসময়ই জনগণের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। শুধু ইমাম রেযা কেন প্রায় সকল ইমামকেই এভাবে গণবিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরা তাঁদেরকে কঠোর প্রহরার মধ্যে রাখার ষড়যন্ত্র করে। তারপরও ইমামদের সুকৌশলের কারণে তাঁদের বার্তা জনগণের কাছে ঠিকই পৌঁছে যায়।
শাহাদাতের সিঁড়ি বেয়ে যে ইসলাম জমিয়েছে পাড়ি কালের যাত্রায় আজো তা বিশ্বময় দীপ্তিমান নবীবংশীয় ইমামতের সুদীপ্ত ধারায় আর জনগণের কাছে ইমামগণের বার্তা পৌঁছে যাবার ফলে তারা প্রকৃত সত্য বুঝতে সক্ষম হন এবং নবীবংশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকেন। বিশেষ করে বাদশা মামুনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ইমাম রেযা যখন দাঁড়িয়ে গেলেন , তখন ইরাকের অধিকাংশ লোক মামুনের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল।
হযরত আলীর (আ) খান্দানের কেউ বাদশাহর বিরুদ্ধে গেলে বাদশাহী যে হারাতে হবে-এই আশঙ্কা মামুনের মধ্যে ছিল। যার ফলে মামুন একটা আপোষনীতির কৌশল গ্রহণ করে। বাদশাহ মামুন ইমামকে খোরাসানে আসার আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম প্রথমত রাজি হন নি , কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি বসরা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তাঁর গতিপথ পরিবর্তন করে ইরানের দিকে পাড়ি দেন। যাত্রাপথে তিনি যেখানেই গেছেন জনগণ তাঁকে সাদরে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে। ইমামও নবীজীর সুন্নত , তাঁর আহলে বাইতের ইমামদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের সঠিক বিধি-বিধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। সেইসাথে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বাদশাহর আমন্ত্রণের কথাও তাদেরকে জানান। চতুর বাদশাহ মামুন ইমামের আগমনে তার সকল সভাসদ এবং অন্যান্য লোকজনকে সমবেত করে বলেন , হে লোকেরা ! আমি আব্বাস এবং আলীর বংশধরদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখেছি , আলী বিন মূসা আর রেযার মতো উত্তম লোক দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমি চাচ্ছি যে , খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত করবো ইমাম, মামুনের রাজনৈতিক এই দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি জবাবে বললেন, মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেন , তাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারী না হয়ে থাক , তাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই।
ইমাম শেষ পর্যন্ত মামুনের কথায় খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় মামুন ইমামকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার হতে বাধ্য করে। ইমাম রেযা (আ) শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে কিছু শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করেন। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত ছিল তিনি প্রশাসনিক কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। তিনি কেন এ ধরণের শর্তারোপ করেছিলেন , তার কারণ দায়িত্ব গ্রহণকালে প্রদত্ত তাঁর মুনাজাত থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি মুনাজাতে বলেছিলেন , হে খোদা ! তুমি ভালো করেই জানো , আমি বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সুতরাং আমাকে এজন্যে পাকড়াও করো না। যেমনিভাবে তুমি ইউসূফ ও দানিয়েল ( আ) কে পাকড়াও করো নি। হে আল্লাহ ! তোমার পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যতিত আর কোনো কর্তৃত্ব হতে পারে না। আমি যেন তোমার দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে পারি , তোমার নবীর সুন্নতকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি।
ইমাম রেযার এই দায়িত্ব গ্রহণের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে আব্বাসীয়রা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা ভেবেছিল, খেলাফত বুঝি চিরদিনের জন্যে আব্বাসীয়দের হাত থেকে আলীর (আ) বংশধরদের হাতে চলে গেল। তাদের দুশ্চিন্তার জবাবে বাদশা মামুন তার মূল অভিপ্রায়ের কথা তাদেরকে খুলে বলেন। ফলে মামুনের দুরভিসন্ধি প্রকাশ পেয়ে যায়। এ বিষয়ে আয়াতুল্লাহ উযমা খামেনেই বলেছেন, ইমামকে খোরাসানে আমন্ত্রণ জানানো এবং তার পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পেছনে মামুনের মূল উদ্দেশ্য ছিল , শিয়াদের বৈপ-বিক সংগ্রামকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা। যাতে তাদের উত্তাল রাজনীতিতে ভাটা পড়ে যায়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ছিল আব্বাসীয় খেলাফতকে বৈধ বলে প্রমাণ করা। তৃতীয়ত , ইমামকে উত্তরাধিকার বানানোর মাধ্যমে নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও মহান উদার হিসেবে প্রমাণ করা । তো মামুনের এই অভিসন্ধির কথা জানার পর আব্বাসীয়রা ইমামকে বিভিন্নভাবে হেয় ও মর্যাদাহীন করে তোলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ইমামকে তারা কিছুতেই অপদস্থ করতে পারে নি। বাদশা মামুন একবার তার সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তরের আসরে ইমামকে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে ইমাম কোনো এক প্রোপটে মামুনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিমত দেন। এতে বাদশা ভীষণ ক্ষেপে যান এবং ইমামের বিরুদ্ধে অন্তরে ভীষণ বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকেন। ঐ ঘটনা ছাড়াও ইমামত , জনপ্রিয়তা ,খেলাফত , আলীর বংশধর প্রভৃতি বিচিত্র কারণে বাদশাহ ইমামের বিরুদ্ধে শত্র"তা করতে থাকে। পক্ষান্তরে জনগণ উপলব্ধি করতে পারে যে , খেলাফতের জন্যে মামুনের চেয়ে ইমামই বেশি উপযুক্ত। ইমামের বিরুদ্ধে মামুনের ক্রোধ এবং হিংসা যতো বাড়তে থাকে , ইমামও মামুনের বিরুদ্ধে অকপট সত্য বলার ক্ষেত্রে নির্ভীক হয়ে ওঠেন। কোনোভাবেই যখন ইমামকে পরাস্ত করা গেল না , তখন মার্ভ থেকে বাগদাদে ফেরার পথে ইরানের বর্তমান মাশহাদ প্রদেশের তূস নামক অঞ্চলে মামুন ইমামকে আঙ্গুরের সাথে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে হৃদয়জ্বালা মেটাবার চেষ্টাকরে। ২০৩ হিজরীর ২৯শে সফরে এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। তখন ইমামের বয়স ছিল পঞ্চান্ন বছর।
আসলে বিষ প্রয়োগে ইমামের সাময়িক মৃত্যু ঘটলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। পক্ষান্তরে ইমাম শাহাদাতের পেয়ালা পান করে যেন অমর হয়ে গেলেন চিরকালের জন্যে। তার প্রমাণ মেলে মাশহাদে তাঁর পবিত্র সমাধিস্থলে গেলে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইমামের শাহাদাত বার্ষিকীতে কাতারে কাতারে মানুষ আসে তাঁর মাযারে। কান্নাকাটি আর দোয়া- দরুদ পড়ে তাঁরা তাঁদের প্রিয় ইমামের প্রতি নিজ নিজ অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানায় , অপরদিকে নিজেদের কল্যাণ কামনা করে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত দেয়।
এবারে এই মহান ইমামের কিছু বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর সম্মানে নিবেদিত এই অলোচনার পরিসমাপ্তি টানবো। তিনি বলেছেন ;
১। মুমিন ক্রোধান্বিত হলেও, ক্রোধ তাকে অপরের অধিকার সংরক্ষণ থেকে বিরত করে না।
২। যে ব্যক্তি তার ক্ষমতা ও মর্যাদা স¤পর্কে অবগত, সে কখনোই ধ্বংস হবে না।
৩। কিয়ামতে সেই ব্যক্তি আমাদের সর্বাধিক নিকটবর্তী হবে, যে সদাচরণ করে এবং তার পরিবারের সাথে সদ্ব্যবহার করে।
৪। যদি কেউ কোন মুসলমানকে প্রতারণা করে, তবে সে আমাদের কেউ নয়।
৫ । তিনটি কর্ম সর্বাপেক্ষা কঠিন :
এক. ন্যায় পরায়ণতা ও সত্যবাদিতা যদিও এর ফল নিজের বিরুদ্ধে যেয়ে থাকে। দুই. সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণে থাকা।
তিন. ঈমানদার ভাইকে নিজ সম্পদের অংশীদার করা।
ইমামের এইসব বাণী যেন আমরা আমাদের জীবনে কাজে লাগিয়ে ধন্য হতে পারি , আল্লাহ আমাদের সেই তৌফিক দিন-এই কামনা করে শেষ করছি নবী বংশের অষ্টম ইমাম হযরত রেযা (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা ।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন