আল-আযহার আলেম: শিয়াদেরকে কাফের বললে ১৪০ জন রাভি’র নাম মুছে ফেলতে হবে
আল-আযহার আলেম: শিয়াদেরকে কাফের বললে ১৪০ জন রাভি’র নাম মুছে ফেলতে হবে
তাকফিরী ও সালাফী মুভমেন্ট পরিচিতি বিষয়ক ধারাবাহিক আলোচনা সভা মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট আলেমের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
আল-আযহারের বিশিষ্ট আলেম ‘ড. শেইখ তাজুদ্দীন আল-হেলালী’ এ সভায় তাকফিরী চিন্তাধারার আবির্ভাবের উত্সমূলের প্রতি আলোকপাত করে বলেন : বর্তমানে তাকফিরীরা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে মুসলমানদেরকে হত্যা করছে! তারা মুসলমানদের শিরোচ্ছেদ করার সময় তাকবির ধ্বনি উচ্চারণ করে!
আল-হেলালী, তাকফিরী চিন্তাধারার উত্সমূলকে জাল হাদীস উল্লেখ করে বলেন : সুন্নি মাযহাবে সাহাহ সিত্তায় বর্ণিত সকল হাদীসকেই সহিহ বলে জ্ঞান করা হয়। অথচ শিয়া মাযহাবে ইমামদের নির্দেশের ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনা করা হয়, অতঃপর সেগুলোকে পবিত্র কুরআনের সামনে উপস্থাপন করা হয় এবং যা কিছু কুরআনের পরিপন্থী সেগুলোকে অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। মূলতঃ শিয়া আলেমরা হাদীসসমূহকে সমালোচনাযোগ্য বলে জ্ঞান করে, কিন্তু সালাফী আলেমরা যায়িফ তথা দূর্বল হাদীসসমূহকেও মানে এবং এটাই হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতার মূল কারণ।
তাকফিরীদের জ্ঞানভিত্তিত যুক্তি-প্রমাণ শূণ্যতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন : যখন সকল মুসলমান তওহিদ (একত্ববাদ) নবুয়্যত এবং কেয়ামত তথা দ্বীনের এ তিন মৌলিক স্তম্ভের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে তখন আমরা কিভাবে পরস্পরকে কাফের আখ্যায়িত করতে পারি?!
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক মুফতি বলেন : আমরা কিভাবে ইমামিয়া মাযহাবের অনুসারীদেরকে কাফের বলতে পারি, যখন তারা এ মৌলিক বিষয়াদির উপর বিশ্বাস রাখে এবং সিলসিলাতুয যাহাব নামে খ্যাত ঐতিহাসিক হাদীসের ভিত্তিতে তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাহু’কে মহান আল্লাহ’র দূর্গে প্রবেশের শর্ত হিসেবে মুখে উচ্চারণ করে এবং এর প্রতি ঈমান রাখে?
তিনি বলেন : সিলসিলাতুয যাহাব শীর্ষক হাদীস ইমাম রেজা (আ.) থেকে বর্ণিত :
"کلمة لا إله إلا الله حصني، فمن قالها دخل حصني و من دخل حصني أمن عذابی"
[‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ বাক্যটি হচ্ছে আমার দূর্গ। অতএব, যে এ বাক্য বলবে আমার (নিরাপদ) দূর্গে প্রবেশ করবে আর যে আমার দূর্গে প্রবেশ করবে সে আযাব থেকে নিরাপদ থাকবে।] এ হাদীসটি শিয়াদের হাদীস গ্রন্থসহ সুন্নিদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
শেইখ আল-হেলালী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে তাকফিরীদের উদ্দেশ্যে বলেন : যদি আহলে বাইত (আ.) এর অনুসারীদেরকে কাফের জ্ঞান করি, তবে রেওয়ায়েত ভিত্তিক আপনাদের অনেক গ্রন্থ এবং সাহাহ সিত্তার অনেক হাদীসই প্রশ্নবিদ্ধ হবে; কেননা এ সকল হাদীসের রাভিদের (রেওয়ায়েত বর্ণনাকারী) মাঝে ১৪০ জন রাভি শিয়া মাযহাবের অনুসারী।
তিনি বলেন : দুঃখজনকভাবে তাকাফিরীরা শুধু কিছু কিছু বিভেদ থেকে অপব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয় না বরং শিয়াদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচারের আশ্রয় নেয়, যেমন : তারা বলে ‘শিয়াদের কুরআন ভিন্ন’। এছাড়া ‘খানাল আমিন’ তথা জীবরাইল খেয়ানত করেছে শীর্ষক মিথ্যা, বাতিল ও ভিত্তিহীন অপবাদ শিয়াদের উপর আরোপ করে থাকে (নাউজুবিল্লাহ)।
আমিরুল মু’মিনীন (আ.) এর কথার মাধ্যমে সালাফী চিন্তাধারা খণ্ডন করে আল-আযহারের বিশিষ্ট এ আলেম বলেন : খাওয়ারেজ ছিল বাতিল একটি দল, মহানবী (স.) এর ওফাতের পর যাদের উদয় হয়। এরা অন্যদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করতো। কিন্তু তারা কাফের কি না –এ বিষয়ে আমিরুল মু’মিনীন (আ.) কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন : না।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাকফিরী গ্রুপ কর্তৃক মানুষ হত্যার নিন্দা জানিয়ে আল-আযহারের প্রখ্যাত এ আলেম বলেন : এ দলটির কাজকর্ম মহানবী (স.) এর সুন্নত বিরোধী। কেননা তিনি (স.) বলেছেন :
"من قتل مسلماً فاعتبط بقتله لم یکن له یوم القیامة صرفاً و لا عدلاً".
ওয়াহাবী তাকফিরীদের বিভিন্ন স্ববিরোধী কথাবার্তার প্রতি ইশারা করে তিনি বলেন : বিশ্বের কোন প্রান্তে যখন কোন অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন তারা আনন্দিত হয় এ দলটি। অথচ তারা নির্দিধায় বহু সংখ্যক মুসলমানকে কাফের বলে আখ্যা দেয় এবং তাদেরকে হত্যা করে।
ড. আল-হেলালী বলেন : তাকফিরীরা বর্তমানে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ন্যায় কাজ করছে। অর্থাত বর্তমানে আমরা গণবিধ্বংসী এক অস্ত্রের সম্মুখীন যা সকল মুসলিম উম্মাহ’র জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অস্ত্রকে ফিলিস্তিন মুক্ত করার কাজে বা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করে মুসলমানদের হত্যার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাকফিরীরা মুসলমানদের শত্রু ও মুসলমানদের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের সাথে যুদ্ধ না করে কবরবাসীদের সাথে যুদ্ধ করছে; যারা কারো কোন ক্ষতি করে না!
তিনি বলেন : এ অস্ত্রের মাধ্যমে মূলতঃ ইসরাইলের স্বপ্ন -নীল নদ থেকে ফুরাত পর্যন্ত একটি দেশ গঠন- বাস্তবায়নের পথ মসৃণ হচ্ছে। আর এ কারণেই ইরাক, সিরিয়া ও মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে তাকফিরীদের হাতে সাধারণ মুসলমানদের হত্যার সাক্ষী আমরা।
শেইখ তাজুদ্দীন আল-হেলালী তার বক্তৃতার অপর অংশে মুসলমানদের ঐক্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন : আমাদের উচিত উভয় মাযহাবের মধ্যে আকিদাগত যৌথ বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা, যাতে সেগুলোর সহায়তায় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
তিনি বলেন : আমাদের উচিত মানুষকে কল্যাণের প্রতি আহবান জানানো এবং নূরের উত্স [মহানবী (স.) কর্তৃক রেখে যাওয়া] ২ মূল্যবান বস্তুর –কুরআন ও ইতরাত- উপর ইজমা করা। আর নিশ্চিতভাবে বলা যায় অপরের ত্রুটি খুঁজে বেড়ানোর মাঝে কোন কল্যাণ নেই।
আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত এ শিক্ষক তাকফিরীদের সাথে কিরূপ আচরণের বিষয়ে বলেন : মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়ে নিহত হওয়ার জন্য প্রস্তুত তাকফিরীদের সাথে তাদের ন্যায় আচরণ করে তাদেরকে হত্যা করা উচিত নয়। বরং তাদের চিন্তার সাথে মোকাবিলা করে তাদেরকে পরিত্রাণ দিতে হবে।
সভা শেষে এতে অংশগ্রহণকারীরা ড. তাজুদ্দীন আল-হেলালী’র নিকট বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন।
বলাবাহুল্য, ‘সুন্নি মাযহাবের দৃষ্টিতে আহলে বাইত (আ.) এর প্রতি ভালাবাসা’ এবং ‘তাকফিরী ও সালাফি মুভমেন্ট পরিচিতি’ শীর্ষক ধারাবাহিক এ আলোচনা সভা চলতি সপ্তাহের শেষ নাগাদ অব্যাহত থাকবে। এতে বক্তব্য রাখছেন মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষক ‘ড. শেইখ তাজুদ্দীন আল-হেলালী’। হাওযা ইলমিয়া কোমে’র আন্তর্জাতিক বিভাগের উদ্যোগে এ সভা হাওযা ইলমিয়ার শিক্ষক ও গবেষকদের উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয়েছে।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন