সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৭৪-৭৭

সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৭৪-৭৭


সূরা বনী ইসরাইলের ৭৪ ও ৭৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا (74) إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا (75)

“আর যদি আমি তোমাকে মজবুত না রাখতাম তাহলে তোমার পক্ষে তাদের দিকে কিছু না কিছু ঝুঁকে পড়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল না।” (১৭:৭৪)
“কিন্তু যদি তুমি এমনটি করতে তাহলে আমি এ দুনিয়ায় তোমাকে দ্বিগুণ শাস্তির মজা টের পাইয়ে দিতাম এবং আখেরাতেও,তারপর আমার মোকাবেলায় তুমি কোনো সাহায্যকারী পেতে না।” (১৭:৭৫)

আগের পর্বে বলা হয়েছে যে, মক্কার মুশরিকরা নবী করিম (সা.) এর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে এবং নবীজীর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার জন্যে বহু চেষ্টা করেছিল। তারা শুধু চেয়েছিল জনগণকে যাতে ইসলামের দাওয়াত তথা এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করা থেকে নবীজী বিরত থাকেন। এই দুই আয়াতে আল্লাহকে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ আমরা তোমাকে শত্রুদের প্ররোচনায় প্রভাবিত হওয়া থেকে বিরত রেখে সুরক্ষা করেছিলাম। আমরা যদি তা না করতাম অর্থাৎ যদি বিপথগামীদের প্রলোভনের কাছে তুমি আত্মসমর্পন করতে (নাউজুবিল্লাহ) তাহলে ইহকাল এবং পরকালে তোমাকে অন্যদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি করে ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হতো। কেননা তোমার বিচ্যুতি সকল মুমিনের বিচ্যুতির কারণ হয়ে দাঁড়াতো।

এ আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় যে নবীরা হলেন নিষ্পাপ। তাঁদেরকে এই সুউচ্চ মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহই দিয়েছেন এবং সেই মর্যাদা রক্ষাকারীও আল্লাহ নিজেই। এই আয়াতে অনেকটা শর্তসাপেক্ষ বাক্য ব্যবহৃত হয়েছেঃ যদি আমরা তোমাকে মজবুত না রাখতাম তাহলে তুমিও ভুলের মাঝে নিপতিত হবার কাছাকাছি চলে যেতে। এ ধরনের আয়াতে কুরআনে কম নেই তবে এসব আয়াতের সাথে নিষ্পাপ মর্যাদার কোনো বিরোধ নেই। আরো এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ হে পয়গাম্বর! যদি মুশরিক হয়ে যেতে তোমার সকল আমল ধ্বংস হয়ে যেত।

এ আয়াত দুটো থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. শত্রুদের প্ররোচনায় প্ররোচিত না হওয়াটা নবী-রাসূল এবং তাঁর প্রকৃত সহচরদের বৈশিষ্ট্য।
দুই. শত্রুদের মোকাবেলায় কোনো রকমের অলসতা করা কুফরি কিংবা দ্বীনী মূল্যবোধ থেকে সরে যাবার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে ।
তিন. ইসলামী সমাজের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দের ওপর ব্যাপক দায়িত্বভার রয়েছে। তাই তাঁদের কোনোরকমের ছোটোখাটো ত্রুটিও সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বড়।

সূরা ইব্রাহীমের ৭৬ ও ৭৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِنْ كَادُوا لَيَسْتَفِزُّونَكَ مِنَ الْأَرْضِ لِيُخْرِجُوكَ مِنْهَا وَإِذًا لَا يَلْبَثُونَ خِلَافَكَ إِلَّا قَلِيلًا (76) سُنَّةَ مَنْ قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنْ رُسُلِنَا وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا (77)
“আর এরা (কাফেররা) এ দেশ থেকে তোমাকে উৎখাত করার এবং এখান থেকে তোমাকে বের করে দেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিল৷ কিন্তু যদি এরা এমনটি করে তাহলে তোমার পর এরা নিজেরাই এখানে বেশীক্ষণ থাকতে পারবে না।” (১৭:৭৬)
“এটি আমার স্থায়ী কর্মপদ্ধতি৷ তোমার পূর্বে আমি যেসব রাসূল পাঠিয়েছিলাম তাদের সবার ব্যাপারে এ কর্মপদ্ধতি আরোপ করেছিলাম। আর আমার কর্মপদ্ধতিতে তুমি কোনো পরিবর্তন দেখতে পাবে না।” (১৭:৭৭)

মক্কার মুশরিকদের একটা পরিকল্পনা ছিল নবীজীকে মক্কা থেকে দূরের কোনো অঞ্চলে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেবে, যাতে কেউ তাকে সাহায্য করতে না পারে এবং তাঁর দাওয়াতের আহ্বান বা ডাক যেন কোনো মানুষের কানে পৌঁছতে না পারে। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের এই পরিকল্পনা নষ্ট করে দেন, তাদের ঐ পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র সফল হতে দিলেন না।
আয়াতের ধারাবাহিকতায় বলা হয়েছেঃ সকল নবী এবং তাঁদের কওমদের ব্যাপারে আল্লাহর একটি অভিন্ন নীতি হলো তাঁর নবীদের সাথে যখনই কোনো সংঘাত বেঁধেছে তখনই ঐ অঞ্চলে নেমে এসেছে আল্লাহর আজাব, আর ঐশী শাস্তি থেকে কেউই রক্ষা পায় নি। সূরা ইব্রাহিমের ১৩ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছেঃ কাফেররা তাদের পয়গাম্বরকে বলেছিলঃ আমরা অবশ্যই তোমাকে আমাদের এই ভূখণ্ড বা দেশ থেকে বের করে দেব, যদি না তুমি আমাদের ধর্মে দীক্ষিত না হও। কিন্তু আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে ওহী অবতীর্ণ করে বলেছিলেনঃ আমরা অত্যাচারীদেরকে ধ্বংস করে দেব।
আসলে একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট, তা হলো যেসব লোক নবীকে চিনতো না বা তাঁর আগমন যে তাদের জন্যে কত বড় নিয়ামত তার মর্যাদাই বুঝতো না, আর সে কারণে তাঁর প্রদর্শিত হেদায়েতের আলোকবর্তিকার আলো গ্রহণ করার পরিবর্তে উল্টো তাঁর মর্যাদা ধ্বংস করার চেষ্টা করত, তারা আল্লাহর রহমত পাবার যোগ্যতাই আর রাখে না। এ কারণে তাদের ওপর যে নেমে আসবে ভয়াবহ শাস্তি-তাতে আর অবাক হবার কী আছে! আল্লাহর এই নীতি কোনো অঞ্চল বা কওমের জন্যে নির্দিষ্ট নেই। ঐশী বিধানে কোনো বৈষম্য নেই, সবাই তাঁর কাছে সমান। এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করব আয়াতের ধারাবাহিকতায় বলা হয়েছেঃ ইতিহাসের পরিক্রমায় ঐশী এই বিধান কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই অব্যাহতভাবে চলে এসেছে। এটা মানীয় নীতিমালার বিপরীত। মানব রচিত নীতি বা বিধিবিধান ব্যক্তি বা গোষ্ঠির চাহিদা অনুযায়ী সংস্কারযোগ্য এবং পরিবর্তনীয়।

এইসব আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ
এক. শত্রুরা প্রথমে ইসলামী নেতৃবৃন্দকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। যখনই তারা সেটা পেরে ওঠে না তখন শারীরিকভাবে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার পরিকল্পনা নেয়।
দুই. মানুষের মাঝে নবীদের উপস্থিতি ঐশী আজাব বা রোষানল থেকে তাদের মুক্তির উপায়। আল্লাহর ওলিগণও দরবারে খোদার সাথে নৈকট্যের বিচারে এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
তিন. ঐশী বিধি-বিধানগুলোর ভিত্তিতে ইতিহাসের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের জন্যে দিক-নির্দেশনা স্থির করা উচিত।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন