সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৭১-৭৩
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৭১-৭৩
সূরা বনী ইসরাইলের ৭১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَوْمَ نَدْعُوا كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ فَمَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَأُولَئِكَ يَقْرَءُونَ كِتَابَهُمْ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًا (71)
“তারপর সেই দিনের কথা মনে কর যেদিন আমি মানুষের প্রত্যেক দলকে তাদের নেতা সহকারে ডাকব। সেদিন যাদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেওয়া হবে তারা নিজেদের কার্যকলাপ পাঠ করবে এবং তাদের ওপর সামান্যতম জুলুমও করা হবে না।” (১৭:৭১)
চিন্তাদর্শ এবং সামাজিক বিষয়ে প্রতিটি মানুষই একজন নেতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করে। কুরআন এই আয়াতে বলছেঃ কিয়ামতেও মানুষেরা তাদের সেইসব নেতার সাথেই একসাথে পুনরুত্থিত হবে এবং কেননা আখেরাত হচ্ছে এই পৃথিবীর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি বা প্রতিকৃতি। যদি কারো আদর্শিক নেতা নূর এবং হেদায়েতের ইমাম হন তাহলে তাঁর আনুগত্যকারীও মুক্তি পাবে এবং বেহেশতে প্রবেশ করবে। আর যদি কারো নেতা দুর্নীতি পরায়ন, ফাসেদ কিংবা বিপথগামী হয় তাহলে তার অনুসরণকারীও কিয়ামতে দোযখের অধিবাসী হবে। এ আয়াতের ধারাবাহিকতায় আরো বলা হয়েছেঃ অবশ্য কিয়ামতের বিচারদিনে ঐশী ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচারের ব্যবস্থা হবে। সেদিন কারো ওপরই বিন্দুমাত্রও অন্যায় অবিচার করা হবে না।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. সমাজনেতা কিংবা মতাদর্শগত নেতার অনুসরণের নিদর্শন বা কীর্তি কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকবে এবং কিয়ামতে মানুষের মাঝে শ্রেণীবিন্যাস করা হবে তাদের নেতাদের মর্যাদার ভিত্তিতে।
দুই. নেতৃত্ব এবং ইমামতি মানুষের জীবন জুড়ে বিরাজ করে এবং তা মানুষের চিরন্তন দুভার্গ্য কিংবা সৌভাগ্যের ক্ষেত্র তৈরি করে।
সূরা বনী ইসরাইলের ৭২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَنْ كَانَ فِي هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيلًا (72)
“আর যে ব্যক্তি এ দুনিয়াতে অন্ধদিল এবং গোমরাহ হয়ে থাকে সে আখেরাতেও অন্ধ হয়েই থাকবে বরং পথ লাভ করার ব্যাপারে সে অন্ধের চেয়েও বেশী ব্যর্থ।” (১৭:৭২)
আগের আয়াতে মানুষের পরকালীন সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে আদর্শিক নেতার ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতে মানুষের সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে তাদের অভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ মানুষের ভাগ্য বিনির্মাণের বাহ্যিক শক্তি হিসেবে আদর্শিক নেতাদের প্রভাব যেমন রয়েছে, তেমনি মানুষের জীবনে সত্যের মোকাবেলায় অপবিত্র অন্তরাত্মা এবং অন্ধত্বেরও ভূমিকা রয়েছে। পবিত্র অন্তর সত্য গ্রহণের সহায়ক আর অন্ধ ও অপবিত্র অন্তর সত্যের বিপরীত ভূমিকা পালন করে। তাই যেমনটি বলা হয়েছে, কিয়ামতে মানুষেরা তাদের দুনিয়ার নেতার সাথে পুনরুত্থিত হবে। পৃথিবীর জীবনে যদি সে অন্ধত্বপূর্ণ মানসিকতার অধিকারী বা অন্ধ অনুসরণ করে থাকে, তাহলে কিয়ামতেও অন্ধ এবং গোমরাহ অবস্থাতেই পুনরুত্থিত হবে।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হচ্ছে-
এক. কিয়ামতে আমাদের পার্থিব জীবনের কর্মের প্রতিফলন ঘটবে তাই যা-ই করব তারই প্রতিফল ঘরে তুলবো।
দুই. দুনিয়ার অন্তর্দৃষ্টি বা পাণ্ডিত্য আখেরাতেও সুপ্রভাব ফেলবে আর দুনিয়াবি অন্ধত্ব কিয়ামতেও গোমরাহির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সূরা বনী ইসরাইলের ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا (73)
“হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আমি যে ওহী পাঠিয়েছি তা থেকে তোমাকে ফিরিয়ে রাখার জন্য এ লোকেরা তোমাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দেবার চেষ্টায় ত্রুটি করেনি, যাতে তুমি আমার নামে নিজের পক্ষ থেকে কোনো কথা তৈরি কর। যদি তুমি এমনটি করতে তাহলে তারা তোমাকে নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করত।” (১৭:৭৩)
নবী-রাসূলদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো পাপশূন্যতা। আল্লাহ পাক যেহেতু তাঁর বার্তা বা কথাগুলোকে অবিকৃতভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে তাঁর বান্দাদের কানে পৌঁছাতে চান সেজন্যেই তিনি নবীদেরকে সর্বপ্রকার গুনাহ-খাতা থেকে মুক্ত এবং পবিত্র রেখেছেন। তার মানে হলো নবীগণ তাঁদের কথায় বার্তায় আচার আচরণে, কাজে কর্মে যেন কোনারকম ভুলত্রুটি করে না বসেন এবং আল্লাহ পাক তাঁদেরকে যা কিছু করতে অনুপ্রাণিত করেছেন বা দায়িত্ব দিয়েছেন তার বাইরে কোনোকিছু যেন না পৌঁছায়, সেজন্যেই তাঁদেরকে সকল প্রকার ভুল-ত্রুটি থেকে পবিত্র রাখা হয়েছে। যদি তাঁরা কোনো ত্রুটি করতেনই (নাউজুবিল্লাহ) তাহলে জনগণ তাঁদের প্রতি আস্থা রাখতে পারতো না।
মুশরিকরা চেষ্টা করেছিল প্রতারণাপূর্ণ কথাবার্তা এবং মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে নবীজীকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানো থেকে বিরত রাখতে। ইতিহাসে যেমনটি এসেছে, মক্কার অধিপতিরা নবীজীর কাছে লোকজন পাঠিয়ে বলেছেঃ যদি ধন-সম্পদ চাও তাহলে যতো চাও ততোই দেওয়া হবে। যদি সুন্দরী নারী চাও তাহলে তা-ই দেব, কিন্তু তুমি লোকজনকে তোমার দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকো। নবীজী তাদের প্রস্তাবের জবাবে বললেনঃ আল্লাহর কসম যদি তোমরা সূর্যকে আমার এক হাতে এনে দাও আর চাঁদকে দাও অন্য হাতে তবু আমি আমার রেসালাতের দায়িত্ব থেকে হাত গুটাবো না। নবুয়্যতের দুই/তিন বছরেও মক্কাই হোক কিংবা মদিনায়- যেখানে তিনি হুকুমাত কায়েম করেছেন-মুশরিকরা কখনো লোভ দেখিয়ে কিংবা কখনো ভয়-ভীতি দেখিয়ে বিভিন্নভাবে তাঁকে রেসালাতের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নবীজী বিন্দুমাত্র পিছপা হননি কিংবা এতোটুকু ভুলও করেন নি।
এ আয়াতেও বলা হয়েছেঃ মুশরিকরা ব্যাপক চেষ্টা করেছে বন্ধুত্ব কিংবা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবীজীকে প্রতারিত করতে এবং তাঁকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে। কিন্তু আল্লাহপাক তাঁকে তাদের সকল ষড়যন্ত্র আর প্রতারণার জাল থেকে সুরক্ষা করেছেন এবং তাদের কোনোরকম প্ররোচনাই কোনো কাজে লাগে নি।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
এক. ইসলামী সমাজের নেতাদের উচিত জাগ্রত এবং সদা সতর্ক থাকা। সেঈসাথে মনে রাখতে হবে শত্রুরা বন্ধুর বেশে ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে দুর্বল করার চেষ্টা চালাবে।
দুই. যে-কোনোরকম বন্ধুত্বই মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসকে দুর্বল করার কারণ হতে পারে সে ধরনের বন্ধুত্ব অবশ্যই পরিত্যাজ্য এবং বর্জনীয়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন