সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৬৪-৬৭
সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত ৬৪-৬৭
সূরা বনী ইসরাইলের ৬৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِمْ بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَولَادِ وَعِدْهُمْ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا (64)
“(হে শয়তান!) তাদের মধ্যে যাদের পার ধ্বংসের পথে পরিচালনা কর,তোমার মনোমুগ্ধকর আহ্বানে তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা আক্রমণ কর। সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে পরস্পর অংশ গ্রহণ কর এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দাও। এবং (হে আমার বান্দারা, জেনে রেখ) শয়তানের প্রতিশ্রুতি ছলনা ছাড়া আর কিছু নয়।” (১৭:৬৪)
আগের পর্বে আমরা বলেছি, ইবলিস হযরত আদম (আ.)কে সেজদা করত অস্বীকার করলে আল্লাহ তাকে তার দরবার থেকে বের করে দেন। আর তখন সে আল্লাহর কাছ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত সময় চেয়ে নেয়। আল্লাহও তাকে কেয়ামত পর্যন্ত সময় দান করেন। কিন্তু আল্লাহ হযরত আদম (আ.) ও তার বংশধরদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তারা যেন শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে দূরে থাকে। এ আয়াতে আগের সে সব আয়াতের ধারাবাহিকতায় আল্লাহ আরও বলেন: ইবলিস বিভিন্নভাবে মানবজাতিকে ধোঁকা দেয়। সে সব সময় একই কৌশল অবলম্বন করে না। শয়তানরা নিজেদের ধোঁকা ছড়িয়ে দেয়ার কাজে ব্যাপক প্রচার-প্রপাগান্ডার আশ্রয় নেয়। শয়তানের এ শক্তিকে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
সম্মুখ যুদ্ধে যেমন বিপক্ষ শক্তিকে আক্রমণের জন্য অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী ব্যবহার করা হয়,তেমনি জ্বিন ও মানুষরূপী শয়তান মানুষকে বিপথগামী করার জন্য নানা ধরনের উস্কানি ও মিথ্যা আশ্বাস দেয়। হারাম বা নিষিদ্ধ পথে অর্থ উপার্জন, নারী ও পুরুষের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন এবং জেনা ও ব্যাভিচারের মাধ্যমে সমাজে জারজ সন্তান ছড়িয়ে দেয়া- ইত্যাদি কাজগুলো শয়তান মানুষকে দিয়ে করায়। অবশ্য আল্লাহ বহুবার শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এজন্য তিনি আমাদেরকে বারবার সাবধান করে দিয়েছেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
এক. শত্রুর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সামরিক হামলার চেয়েও ভয়ঙ্কর। এ কারণে আল্লাহ এই আয়াতে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর হামলার কথা বলার আগে মনোমুগ্ধকর আহ্বানের কথা বলেছেন।
দুই. ধোঁকা দেয়া শয়তানের কাজ। শয়তান একদিকে গোনাহ বা পাপকাজ করতে উস্কানি দেয়, আবার অন্যদিকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে তওবা করতে দেরি করায়।
সূরা বনী ইসরাইলের ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ وَكَفَى بِرَبِّكَ وَكِيلًا (65)
“অপর পক্ষে আমার (খাঁটি ও নেককার) বান্দাদের উপরে তোমার কোনও কর্তৃত্ব থাকবে না। (তাদের জন্য) তোমার সৃষ্টিকর্তার সমর্থন ও সুরক্ষাই যথেষ্ট।” (১৭:৬৫)
শয়তানের হুমকি মানুষের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তবে এই আয়াতে আল্লাহ তার খাঁটি বান্দাদের সুসংবাদ দিয়েছেন যে, শয়তান তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ, ঈমানদার বান্দারা আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়ার কারণে তাঁরই আশ্রয়ে থাকেন। ফলে তাদের ওপর শয়তানের ধোঁকা কোনো কাজ করে না।
প্রশ্ন আসতে পারে, আল্লাহর এই খাঁটি বান্দা কারা। উত্তর হচ্ছে, নবী-রাসূল থেকে শুরু করে অলি-আউলিয়া এবং যারাই নিজেদের ঈমানের ওপর অটল থেকে ধারাবাহিকভাবে সত্কর্ম করে যেতে পারবেন তাদের সবাই আল্লাহর এ পৃষ্ঠপোষকতা পাবেন।
যেমনটি সূরা নাহলের ৯৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন, যারা প্রকৃত ঈমানের অধিকারি ও তাদের প্রভুর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল,তাদের ওপর শয়তানের কোনো কর্তৃত্ব নেই। আল্লাহ সূরা আরাফের ২০১ নম্বর আয়াতেও বলেন: যদি শয়তান তাদের কুমন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে তারা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার মাধ্যমে শয়তানকে তাড়িয়ে দেয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
এক. ইবাদত-বন্দেগি মানুষকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
দুই. আল্লাহ-তায়ালা তার নেক বান্দাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবেন বলে ওয়াদা করেছেন।
সূরা বনী ইসরাইলের ৬৬ ও ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
رَبُّكُمُ الَّذِي يُزْجِي لَكُمُ الْفُلْكَ فِي الْبَحْرِ لِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا (66) وَإِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فِي الْبَحْرِ ضَلَّ مَنْ تَدْعُونَ إِلَّا إِيَّاهُ فَلَمَّا نَجَّاكُمْ إِلَى الْبَرِّ أَعْرَضْتُمْ وَكَانَ الْإِنْسَانُ كَفُورًا (67)
“তিনিই তোমাদের প্রভু যিনি সমুদ্রে তোমাদের নৌযানগুলোকে নিরাপদে পরিচালিত করেন যাতে তোমরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পার। নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।” (১৭:৬৬)
“যখন সমুদ্রে বিপর্যয় তোমাদের পাকড়াও করে,তখন আল্লাহ ছাড়া অন্য যাদের তোমরা ডাকতে,তারা তোমাদের হতাশার মধ্যে ত্যাগ করে চলে যায় (এবং তখন তোমরা কেবল আল্লাহকেই ডাকো)। কিন্তু যখন তিনি নিরাপদে তোমাদের স্থলে ফিরিয়ে আনেন,তখন তোমরা তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ তো অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” (১৭:৬৭)
আল্লাহ্ এ আয়াতে তাঁর নেয়ামতগুলোর একটি অর্থাত্ সমুদ্রের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। মানুষ এই সমূদ্রকে যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। সেইসঙ্গে এই সমূদ্রে রয়েছে অফুরন্ত সম্পদের ভাণ্ডার। আল্লাহ বলছেন, এত বিশাল নেয়ামত দেয়া সত্ত্বেও আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের পরিবর্তে বান্দা তাঁকে ভুলে যায়। বান্দা সাগরের মধ্যে ঝড়-তুফানের মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও অন্যান্য বিপদে পড়লে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু যখনই বিপদ থেকে উদ্ধার পায় তখন সে আল্লাহ্কে ভুলে যায় এবং নিজের কুপ্রবৃত্তিগুলো চরিতার্থ করার দিকে ছোটে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
এক. আল্লাহর রহমত ও দয়া সব জায়গায় বিস্তৃত। জল-স্থল উভয়ই আল্লাহর নেয়ামত এবং রুজি রোজগারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
দুই. বিপদাপদে পড়লে আল্লাহকে উপেক্ষা করার মানসিকতা থেকে মানুষ সরে আসে। মানুষ তখন সত্যিকারের প্রভুর দিকে ছুটে যায়, আর এই ছুটে যাওয়া থেকে প্রমাণিত হয়, প্রতিটি মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস লুকিয়ে আছে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন