সূরা নাহল; আয়াত ১০৪-১০৭
সূরা নাহল; আয়াত ১০৪-১০৭
সূরা নাহলের ১০৪ ও ১০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ لَا يَهْدِيهِمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (104) إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ (105)
“যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না, আল্লাহ্ তাদের পথ নির্দেশ দান করেন না। তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি।” (১৬:১০৪)
“যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না,তারাই মিথ্যা উদ্ভাবন করে,(আসলে) এরাই মিথ্যাবাদী।” (১৬:১০৫)
আগের আয়াতে বলা হয়েছে, শত্রুরা রাসূল (সা.)-এর ওপর যে সব অপবাদ দিত তার একটি ছিল : রাসূল (সা.)-এর একজন শিক্ষক আছেন, যিনি তাঁকে আয়াত শিক্ষা দিতেন এবং রাসূল (সা.) ওই আয়াত আল্লাহর বাণী হিসেবে প্রচার করতেন।
সে আলোচনার ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে আল্লাহ বলেন: যে ব্যক্তি কাফের সে পথভ্রষ্ট, তার পক্ষে সঠিক পথের দিশা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই তার কাছ থেকে হেদায়েতের বার্তা বিশ্বনবীর কাছে যেতে পারে না। কারণ, পবিত্র কুরআন হচ্ছে হেদায়েতের আলোকবর্তিকা এবং মানুষ এটি অনুসরণ করে মহাসাফল্য অর্জন করতে পারে। কাজেই যে ব্যক্তি নিজে এই মহাসাফল্য অর্জনের সুযোগ পায়নি সে কিভাবে রাসূল (সা.)-এর শিক্ষক হবে?
এ আয়াতের পরবর্তী অংশে বিশ্বনবীকে আল্লাহ বলেন: এ মিথ্যা অপবাদের জন্য তুমি অসন্তুষ্ট হয়ো না। এ সবের কারণ হল তারা আল্লাহর উপর ঈমান রাখে না, ফলে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
এক. শুধুমাত্র পবিত্র কুরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া এবং আল্লাহর আয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমেই মানুষ সত্যিকারের হেদায়েত পেয়ে পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে। আর বাকিরা যেমন হেদায়েত পাননি তেমনি তারা হেদায়েত করার ক্ষমতাও রাখে না।
দুই. মিথ্যাবাদী অন্যকে নিজের মত মিথ্যাবাদী মনে করে।
সূরা নাহলের ১০৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (106)
“কেউ বিশ্বাস স্থাপনের পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং প্রত্যাখ্যানের জন্য হৃদয় মুক্ত রাখলে তার উপর আল্লাহ ক্রোধ পতিত হবে এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। তবে তার জন্য নয়, যাকে (সত্য প্রত্যাখ্যানে) বাধ্য করা হয়, কিন্তু তার অন্তর বিশ্বাসে অটল।” (১৬:১০৬)
ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফেররা নও মুসলিমদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাতো যাতে তারা বিশ্বনবীর প্রতি ঈমান থেকে ফিরে আসে। রাসূলের সাহাবি হযরত আম্মার ইয়াসিরের বাবা-মা কাফেরদের অত্যাচারে শহীদ হয়ে যান। এ অবস্থায় যখন কাফেররা হযরত আম্মার ইয়াসিরকে অত্যাচার করতে আসে তখন তিনি মুখে আল্লাহ ও তার রাসূলকে অস্বীকার করেন। কিন্তু তার অন্তর ছিল ঈমানে পরিপূর্ণ। এভাবে তিনি নিজের জীবন রক্ষা করেন। এ কারণে কিছু মুসলমান হযরত আম্মারকে ভর্তসনা করে বলতে থাকেন, তিনি ইসলাম ত্যাগ করেছেন। এ অবস্থায় আম্মার রাসুলুল্লাহ্র (সাঃ) সমীপে উপস্থিত হয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, এরপর যদি আবার তুমি এরকম অবস্থায় পড়ো তাহলে আবারো ওই একই কথা বলে নিজের জীবন বাঁচাবে। তোমার অন্তর ঈমানে পরিপূর্ণ।
ইসলামে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য এ ধরনের কাজকে তাকিয়া বলা হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে আল্লাহর প্রতি ঈমানের বিষয়টি শুধু গোপনই রাখা যাবে না, সেইসঙ্গে প্রয়োজনে এর বিপরীত কথাবার্তাও বলা যাবে। তাকিয়া শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এক ধরনের কৌশল। তাকিয়া এক ধরনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়।
অবশ্য কখনো কখনো ধর্ম রক্ষার জন্য জীবন উতসর্গ করা জরুরি হয়ে পড়ে। ইমাম হোসেইন (আ.) তার সঙ্গীসাথী ও সন্তানদের নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জীবন দিয়েছেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, তাকিয়া শুধুমাত্র সেখানে করা যাবে যেখানে ধর্ম বিপদের মধ্যে নেই এবং দ্বীনের ওপর কোনো ধরনের আঘাত আসারও আশঙ্কা নেই। প্রচণ্ড অত্যাচারের মুখে বাহ্যিকভাবে হযরত আম্মার কুফরি করাতে ইসলামের কোনো ক্ষতি হয়নি।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. মানুষ প্রায় সময়ই নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। তাই যারা মু’মিন তাদের অহংকারি হওয়া যাবে না, এই পৃথিবীতে বহু মু’মিন এক সময় কাফের হয়ে গেছে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।
দুই. বাধ্যবাধকতার সময় মানুষের কর্তব্য পরিবর্তন হয়ে যায়। যদি কেউ চাপের মুখে পড়ে নিজের বিশ্বাসের বিপরীত কিছু বলে তাহলে তার কোন মূল্য নেই।
সূরা নাহলের ১০৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآَخِرَةِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ (107)
“(আল্লাহর ক্রোধের) কারণ হলো, তারা এই পৃথিবীর জীবনকে পরকালীন জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসে। যারা ঈমান ত্যাগ করে আল্লাহ তাদের হেদায়েত করবেন না।” (১৬:১০৭)
আগের আয়াতে আল্লাহ বলেন, কাফেরদের দু’টি শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। প্রথম দলটি প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে বাহ্যিকভাবে কুফরির কথা উচ্চারণ করে, যদিও তারা প্রকৃত মুসলমান। আর দ্বিতীয় দলটি বুক ফুলিয়ে কাফেরদের দলে যোগ দেয় এবং প্রকাশ্যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে।
আল্লাহ এ আয়াতে এ ধরনের কাফেরদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ থাকার কথা ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন: তারা নিজেরাই এ ধরনের পরিণতি বেছে নিয়েছে। তারা চিরস্থায়ী জীবন ত্যাগ করে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন বেছে নিয়েছে। তারা কাফেরদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বলে তারা হেদায়েত পায়নি।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. কুফরি ও ঈমান ত্যাগ করার প্রধান কারণ হল দুনিয়া প্রেমিক হওয়া। ভোগবিলাস ও ইন্দ্রিয়পুজা মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।
দুই. মানুষ দুনিয়াপ্রেম ও ভোগবিলাসের কারণে মানুষ আধ্যাত্মিক হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয় এবং নিকৃষ্ট পরিণতি ভোগ করে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন