সূরা কাহাফ; আয়াত ৯৫-১০১
সূরা কাহাফ; আয়াত ৯৫-১০১
সূরা কাহাফের সূরার ৯৫ ও ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ مَا مَكَّنِّي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا (95) آَتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انْفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آَتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قِطْرًا (96)
“সে (যুলকারনাইন) বলল,আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দান করেছেন তা তোমাদের উপকরণের (আর্থিক সাহায্যের) চেয়ে উত্তম। তোমরা কেবল (ব্যাপক) শ্রম দিয়ে আমাকে সাহায্য কর; যাতে আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যে একটি মজবুত প্রাচীর গড়ে দেই।”(১৮:৯৫)
“তোমরা আমার কাছে লোহার টুকরগুলো আন। এমনকি যখন লোহার টুকরগুলোয় দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী নিচু জায়গা পাহাড়ের সমান উচ্চতায় স্তূপ হয়ে গেল তখন সে বলল, (তোমাদের হাঁপর দিয়ে) ফুঁকতে থাক। এমনকি যখন সে সেটাকে সম্পূর্ণ আগুনে পরিণত করে দিল, তখন বলল, তোমরা দ্রবীভূত তামা আন, আমি তা এটার ওপর ঢেলে দিই।” (১৮:৯৬)
আগের আলোচনায় আমরা ওই বিশেষ অঞ্চলটির কথা বলেছি, যেখানকার লোকজন প্রায়ই একটি হিংস্র জাতির হামলার শিকার হচ্ছিল। তারা যুলকারনাইনের কাছে আবেদন জানিয়েছিল তিনি যেন ওই হিংস্র জাতির অনুপ্রবেশের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি প্রান্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
এ আয়াতে বলা হয়েছে, তাদের ওই আবেদনের জবাবে যুলকারনাইন বলেন, এ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তোমাদেরকেও কাজ করতে হবে বা এ কাজে অংশ নিতে হবে এবং তোমাদের মধ্যে যারা সক্ষম ব্যক্তি তারা যেন লোহা ও তামা নিয়ে আসে যাতে এ দু’টি ধাতুর সমন্বয়ে আমি এমন এক প্রাচীর বানিয়ে দেব যাতে ওই হিংস্র লোকগুলো তোমাদের অঞ্চলে ঢুকতে না পারে। আমি এ জন্য তোমাদের কাছ থেকে কোনো পুরস্কার বা মূল্য চাই না। কারণ, আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন তা তোমরা আমাকে যা দেবে তার চেয়ে অনেক বেশি ভাল।
এ দুই আয়াতের মূল শিক্ষা :
১. আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিরা মানুষের পার্থিব সমস্যাগুলোর সমাধানেও আন্তরিক এবং এইসব কাজ করাকে নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করেন।
২. নানা প্রকল্পে সহযোগিতা ও মানুষের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে সমবায়ের মনোভাব উজ্জীবিত হয় এবং সেবা ও পরিশ্রমের মূল্য বুঝতে পারে। যখন মানুষ সমবায় ও সেবার জন্য শ্রম দেয়া- এইসব বিষয়ের মূল্য বুঝতে পারবে তখন তারা সহজেই ওইসব প্রকল্প হাতছাড়া করবে না।
৩. কোনো প্রকল্প সম্পাদনের জন্য কেবল উপায়-উপকরণ, অর্থ ও জনবলই যথেষ্ট নয়, যোগ্য এবং দূরদর্শী নেতা থাকাও জরুরি যাতে নানা কাজ-কর্ম যথাযথভাবে সম্পাদিত হয় ও এসব সুফলদায়ক হয়। যুলকারনাইন আসার আগে ওই অঞ্চলের লোকদের কাছে সব উপায়-উপকরণই ছিল কিন্তু যুলকারনাইনের মত যোগ্য পরিচালক ছিল না।
সূরা কাহাফের ৯৭ ও ৯৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
) فَمَا اسْطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا (97) قَالَ هَذَا رَحْمَةٌ مِنْ رَبِّي فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا (98)
“(ওই প্রাচীর নির্মাণের পর ইয়াজুজ ও মাজুজ) না সেটা অতিক্রম করতে পারল, আর না তা ভেদ করতে পারল।” (১৮:৯৭)
“সে (যুলকারনাইন) বলল, ‘এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, তবে যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি আসবে তখন তিনি সেটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন; এবং আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।” (১৮:৯৮)
এ আয়াতে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
প্রথমত: হযরত যুলকারনাইনের নির্মিত প্রাচীর বা বাঁধটি এত উঁচু ও মজবুত ছিল যে ইয়াজুজ-মাজুজ নামে কুখ্যাত হিংস্র গোত্রের লোকেরা ওই প্রাচীর অতিক্রম করতে বা প্রাচীর ভেদ করতে পারত না। এ বাঁধ বা প্রাচীর ছিল এত লম্বা ও চওড়া বা পুরু যে তার ওপরে ওঠার ক্ষমতা কারো ছিল না। তামা ও লোহার মিশ্রণও এত শক্ত বা কঠিন ছিল যে ওই প্রাচীর বা বাঁধ ছিদ্র করাও কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব হত না।
দ্বিতীয়ত: যুলকারনাইন এ বাঁধ বা প্রাচীর নির্মাণ করাকে নিজের কীর্তি বলে দাবি করেননি। বরং একে ওই অঞ্চলের জনগণের জন্য আল্লাহর দয়া ও করুণা বলে মনে করতেন যা তাদের জন্য নিরাপত্তার মাধ্যম হয়েছিল।
তৃতীয়ত: এমন একদিন আসবে যখন এই অসাধারণ মজবুত বাঁধটিও ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এটা ঘটবে কিয়ামতের প্রাক্কালে। কারণ, তখন এত ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে যে গোটা পৃথিবীর সব পাহাড়-পর্বত ধুলিস্মাত হয়ে সমতুল ভূমিতে পরিণত হবে।
এ দুই আয়াতের মূল শিক্ষা:
১. যে কোনো কাজ খুব মজবুত করে বা জোরালোভাবে ও যথাযথভাবে করা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের রীতি। যেমন, হযরত যুলকারনাইন (আ.)’র বাঁধ এত মজবুত ও বড় ছিল যে তা কিয়ামতের ভূমিকম্পের আগ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না।
২. খোদাপ্রেমিক ব্যক্তিরা নিজের ও জনগণের সাফল্যকে আল্লাহর দয়া বলেই মনে করেন। তারা কখনও নিজেকে মহান বা অন্যদের চেয়ে বড় ভাবেন না ও অহংকারের শিকার হন না।
৩. আমাদের উচিত কিয়ামত ও বিচার-দিবস বা পরকালে অবশই বিশ্বাস করা। এর পাশাপাশি পার্থিব কাজকর্মও যথাযথভাবে এবং মজবুতভাবে করা উচিত। আমাদেরকে দুনিয়ার সুখ-সমৃদ্ধির জন্যও কাজ করতে হবে, একইসঙ্গে পরকালের ব্যাপারেও উদাসীন হওয়া চলবে না।
সূরা কাহাফের ৯৯,১০০ ও ১০১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَتَرَكْنَا بَعْضَهُمْ يَوْمَئِذٍ يَمُوجُ فِي بَعْضٍ وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَجَمَعْنَاهُمْ جَمْعًا (99) وَعَرَضْنَا جَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ لِلْكَافِرِينَ عَرْضًا (100) الَّذِينَ كَانَتْ أَعْيُنُهُمْ فِي غِطَاءٍ عَنْ ذِكْرِي وَكَانُوا لَا يَسْتَطِيعُونَ سَمْعًا (101)
“এবং সেদিন আমরা তাদের এমন অবস্থায় ছেড়ে দেব যে, তারা পরস্পর তরঙ্গাঘাতের ন্যায় মিশে যাবে এবং শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেওয়া হবে। অতঃপর আমরা তাদের সকলকে সমবেত করব।” (১৮:৯৯)
“এবং সেদিন আমরা জাহান্নামকে অবিশ্বাসীদের সামনে প্রকাশ্যভাবে উপস্থিত করব।” (১৮:১০০)
“যাদের চোখগুলোতে আমার স্মরণ থেকে (বিস্মৃতির) পর্দা ছিল এবং তারা সত্য কথা শুনতেও সক্ষম ছিল না।” (১৮:১০১)
সূরা আম্বিয়ার ৯৬ নম্বর আয়াতের সঙ্গে এ আয়াতের তুলনা করলে দেখা যাবে কিয়ামতের প্রাক্কালে হযরত যুলকারনাইন (আ.)’র বাঁধ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ইয়াজুজ-মাজুজ নামে কুখ্যাত হিংস্র গোত্রের লোকেরা আবারও নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা শুরু করবে। তারা জোয়ারের গতিতে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।তাদের নৃশংসতা ইস্রাফিলের শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। শিঙ্গার ওই ফুঁকের ফলে দুনিয়ার সব মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং দ্বিতীয় ফুঁকের পর আবারও জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে সমবেত হবে। এ সময় কাফেররা দোযখে যাবে। কারণ, পৃথিবীতে তাদের অন্তরের চোখ ও কান সত্যকে দেখতে ও শুনতে পারত না আল্লাহর প্রতি চরম উদাসীনতার কারণে।
এ তিন আয়াতের ক'টি শিক্ষা :
১. কিয়ামতের বা ইহকালীন জগতের পরিসমাপ্তির নিদর্শন হল মানুষের মধ্যে নৈরাজ্য ও হিংস্র জাতিগুলোর হামলা ছড়িয়ে পড়বে।
২. বেশিরভাগ প্রাকৃতিক ঘটনা আল্লাহর নেয়ামত, ক্ষমতা ও রহমতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই শিক্ষা বা উপদেশ গ্রহণ করে না এবং মনে হয় যেন, তারা আল্লাহর নেয়ামত, ক্ষমতা ও রহমত দেখছে না।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন