সূরা কাহাফ; আয়াত ৮৩-৮৮

সূরা কাহাফ; আয়াত ৮৩-৮৮

সূরা কাহাফ; আয়াত ৮৩-৮৮


সূরা কাহাফের ৮৩ থেকে ৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَيَسْأَلُونَكَ عَنْ ذِي الْقَرْنَيْنِ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُمْ مِنْهُ ذِكْرًا (83) إِنَّا مَكَّنَّا لَهُ فِي الْأَرْضِ وَآَتَيْنَاهُ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ سَبَبًا (84) فَأَتْبَعَ سَبَبًا (85)
“ওরা তোমাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে, বল- আমি তোমাদের কাছে তার বিষয়ে বর্ণনা করব।” (১৮:৮৩)
“আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব (ও শাসনক্ষমতা) দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায় ও পন্থা নির্দেশ করেছিলাম।” (১৮:৮৪)
“সে এক পন্থা অবলম্বন করল (এবং সফর শুরু করল)।” (১৮:৮৫)

এ সূরার আগের আয়াত পর্যন্ত আসহাবে কাহাফ এবং হযরত মুসা ও হযরত খিযিরের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আজকের এ তিন আয়াত শুরু হয়েছে যুলকারনাইনের ঘটনা বর্ণনা করে। সূরা কাহাফের ৮৩ নম্বর আয়াত থেকে টানা ১৫টি আয়াত জুড়ে এ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

এ সূরার শুরুতে যেমনটি বলেছি, মক্কার মুশরিকরা মদীনার একজন ইহুদি পণ্ডিতের পরামর্শে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর কাছে তিনটি বিষয়ে জানতে চায়। ওই তিনটি বিষয় ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা, যা জানা বা না জানার ওপর তাদের দৃষ্টিতে রাসূলের নবুওয়াতের সত্যতা নির্ভর করছিল। ওই তিন বিষয়ের একটি ছিল যুলকারনাইন। এ কারণে এ আয়াতের শুরুতেই বলা হয়েছে : হে রাসূল, আপনার কাছে ওরা যুলকারনাইন সম্পর্কে জানতে চায়। ওদেরকে বলুন, আমি যুলকারনাইনের জীবনের একটি ছোট্ট দিক তোমাদের সামনে তুলে ধরছি। সে ছিল এমন একজন মানুষ যাকে আল্লাহ সব ধরনের নেয়ামত ও বহু সৃষ্টির রহস্য ও তথ্যসম্ভার দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন। এর ফলে তিনি সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রকৃতিকে ব্যবহার করতে পেরেছেন। আল্লাহর দেয়া এ নেয়ামত তিনি মানুষের উপকারেও ব্যবহার করেছেন।

তাঁকে কেনো যুলকারনাইন বলা হয়েছে সে সম্পর্কে হাদিসে বিভিন্ন কথা এসেছে। কেউ কেউ বলেছেন, তার মাথার চুল দু’টি শিঙের মতো বোনা থাকতো। আবার কেউ বলেছেন, তার টুপিতে দু’টি ছোট ছোট শিং বসানো ছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে কারনাইন দিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে বোঝানো হয়েছে। তিনি যেহেতু প্রকৃতিকে ব্যবহার করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সফর করে বেড়াতেন এবং প্রকৃতির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল, তাই তাকে যুলকারনাইন বলা হয়েছে।
আসমানি গ্রন্থ তাওরাত ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো মুফাসসির পারস্যের ন্যায়পরায়ণ শাসক সাইরাসকে যুলকারনাইন হিসেবে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ আবার দ্বিগ্বিজয়ী শাসক আলেক্সান্ডারের কথা উল্লেখ করেছেন। সাইরাস ও আলেক্সান্ডার প্রায় একই সময়ে এই পৃথিবীতে শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে সাইরাস ইরান শাসন করতেন।

এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. প্রাকৃতিক উপকরণকে মানুষের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য বৈজ্ঞানিক ও শিল্পদক্ষতা অর্জন করা আল্লাহর একটি বিশেষ নেয়ামত। মহান আল্লাহ তাঁর সুনির্দিষ্ট কিছু বান্দাকে এ ক্ষমতা দান করেছেন।
২. ঐতিহাসিক ঘটনা ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষদের জীবনের কাহিনী মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়ায় এবং মানুষ ভবিষ্যত পথচলার জন্য শিক্ষা অর্জন করতে পারে।
সূরা কাহাফের ৮৬, ৮৭ ও ৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

حَتَّى إِذَا بَلَغَ مَغْرِبَ الشَّمْسِ وَجَدَهَا تَغْرُبُ فِي عَيْنٍ حَمِئَةٍ وَوَجَدَ عِنْدَهَا قَوْمًا قُلْنَا يَا ذَا الْقَرْنَيْنِ إِمَّا أَنْ تُعَذِّبَ وَإِمَّا أَنْ تَتَّخِذَ فِيهِمْ حُسْنًا (86) قَالَ أَمَّا مَنْ ظَلَمَ فَسَوْفَ نُعَذِّبُهُ ثُمَّ يُرَدُّ إِلَى رَبِّهِ فَيُعَذِّبُهُ عَذَابًا نُكْرًا (87) وَأَمَّا مَنْ آَمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُ جَزَاءً الْحُسْنَى وَسَنَقُولُ لَهُ مِنْ أَمْرِنَا يُسْرًا (88)
“(যুলকারনাইন তার পথচলা অব্যাহত রাখে এবং) চলতে চলতে সে যখন সূর্যাস্তস্থলে পৌঁছায়, তখন সে সূর্যকে এক পঙ্কিল জলাশয়ে অস্তগমন করতে দেখে এবং সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পায়। আমি বললাম- হে যুলকারনাইন, তুমি ওদের শাস্তি দিতে পার, কিংবা সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার।” (১৮:৮৬)
“সে বলল- যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করবে আমি তাকে শাস্তি দেব, অতঃপর সে তার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাবে এবং তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন।” (১৮:৮৭)
“তবে যে ঈমান আনে ও সত্‌কাজ করে তার জন্য প্রতিদানস্বরূপ আছে কল্যাণ এবং তার প্রতি সদয় আচরণ করব।” (১৮:৮৮)

এ তিন আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী, যুলকারনাইন সফর করতে করতে এমন একটি এলাকায় পৌঁছান যেখানে সূর্যাস্তে দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম হয়ে মানুষের সামনে ধরা দেয়। সমূদ্র তীরে দাঁড়িয়ে যেমন মনে হয় পানির মধ্যে সূর্যটি ডুবে যাচ্ছে তেমনি ওই এলাকায় দাঁড়িয়ে মনে হয় কর্দমাক্ত বিশাল জলাশয়ের মধ্যে সূর্যাস্ত হচ্ছে। ওই এলাকায় পূণ্যবান ও পাপী দু’ধরনের মানুষই বসবাস করত। আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত বান্দা যুলকারনাইন ওই এলাকার পূণ্যবানদের পুরস্কার দেয়ার দায়িত্ব পান। সেইসঙ্গে তাকে পাপী ব্যক্তিদেরকে এই দুনিয়াতেই শাস্তি দেয়ার দায়িত্বও দেয়া হয়।

অবশ্য ভালো ও খারাপ কাজের পুরস্কার ও শাস্তি দেয়ার প্রকৃত মালিক আল্লাহ এবং তার চূড়ান্ত বিচারও হবে কিয়ামতের ময়দানে। কিন্তু আল্লাহ যুলকারনাইনকে পাপী ও পুণ্যবানদের সনাক্ত করার ক্ষমতা দান করার পাশাপাশি তাদেরকে পুরস্কার ও শাস্তি দেয়ারও ক্ষমতা দেন। তবে এই পুরস্কার ও শাস্তির ফলে মানুষ কিয়ামতের বিচার থেকে রক্ষা পাবে না। যুলকারনাইনকে ওই এলাকার পাপী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দিলে তিনি একথাই বলেছিলেন যে, চূড়ান্ত শাস্তি দেয়ার মালিক আল্লাহ এবং কিয়ামতের দিন তিনি তা দিতে ভুল করবেন না।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. পবিত্র কুরআন অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করতে মানুষকে উত্‌সাহিত করেছে।
২. নিজের প্রিয় বান্দাদেরকে আল্লাহ বিশেষ কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। তারা সে সব ক্ষমতা ইচ্ছা অনুযায়ী প্রয়োগ করতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা অন্যায়ভাবে তাদের এ ক্ষমতা কখনোই প্রয়োগ করননি।
৩. পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি শিরক ও কুফরি করে সে সবার আগে নিজের প্রতি জুলুম করে। কারণ, এ আয়াত অনুযায়ী সে ঈমানের বিপরীতে অবস্থান নেয়।
৪. শাসকদের কাজ হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করা। সেই সঙ্গে অন্যায়কারীকে যথোপযুক্ত শাস্তি দেয়াও তাদের কর্তব্য।
৫. নবী-রাসূলরা পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে পুন্যবানরা ভালো কাজে উত্‌সাহিত এবং পাপী ব্যক্তিরা উপযুক্ত শাস্তি পায়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন