সূরা কাহাফ; আয়াত ৭৯-৮২

সূরা কাহাফ; আয়াত ৭৯-৮২


সূরা কাহাফের ৭৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
َمَّا السَّفِينَةُ فَكَانَتْ لِمَسَاكِينَ يَعْمَلُونَ فِي الْبَحْرِ فَأَرَدْتُ أَنْ أَعِيبَهَا وَكَانَ وَرَاءَهُمْ مَلِكٌ يَأْخُذُ كُلَّ سَفِينَةٍ غَصْبًا (79)
“ওই যে নৌকা (যেটিকে আমি ছিদ্র করে দিয়েছিলাম, সেটি ছিল) কিছু দরিদ্র ব্যক্তির। ওরা সমূদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করতো, আমি ইচ্ছা করলাম নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করতে, কারণ ওদের সামনে ছিল এমন এক রাজা, যে বলপ্রয়োগ করে সব নৌকা ছিনিয়ে নিত।”(১৮:৭৯)

আগের পর্বে বলা হয়েছে, আল্লাহর নবী হযরত খিযির তিনটি অদ্ভুত কাজ করেন যা মেনে নেয়া হযরত মুসার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ কারণে তিনি প্রতিটি কাজের প্রতিবাদ জানান। হযরত খিযির বলেন, এরপর আর আমাদের একত্রে থাকা সম্ভব নয় এবং এখান থেকেই আমাদের আলাদা হয়ে যেতে হবে। তবে তার আগে আমার তিনটি কাজের ব্যাখ্যা তোমাকে জানাতে চাই। যে নৌকাটিতে আমরা উঠেছিলাম সেটি ছিল কিছু গরীব লোকের। তারা কয়েকজন মিলে নৌকাটি নির্মাণ করেছিল এটির মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের জন্য। আমি জানতাম যে নদীর অপর পাড়ে রয়েছে একজন অত্যাচারী শাসক। তার সামনে যে কোনো ভালো বা ত্রুটিমুক্ত নৌকা পড়লে তা জোর করে ছিনিয়ে নেয়। আমি নৌকাটিকে এমনভাবে ছিদ্র করে দেই যাতে ওই শাসক এটিকে কব্জা না করে। কারণ, ওই শাসক ছিদ্রযুক্ত নৌকা ছিনিয়ে নিত না। পরবর্তীতে এটির দরিদ্র মালিকরা নৌকাটিকে মেরামত করে তাদের জীবিকা অর্জনের কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। কাজেই তুমি আমার কাজের বাহ্যিক দিকটি দেখে রেগে যাচ্ছিলে আর আমি দরিদ্র লোকগুলোকে বাঁচিয়ে দিতে পেরে মনে মনে আনন্দিত হচ্ছিলাম।

এখানে মনে রাখতে হবে, হযরত খিযির নৌকাটির তলদেশে এমনভাবে ছিদ্র করেননি যাতে এটি তলিয়ে যায়। তিনি নৌকাটিতে এমনভাবে খুঁত সৃষ্টি করেন যাতে অত্যাচারী শাসক এটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. নবী-রাসূলরা কখনও ভালো কাজ করা থেকে বিরত থাকেন না। সব মানুষ মিলেও যদি এ কাজের প্রতিবাদ করা হয়, তারপরও না।
২. আল্লাহর নবী-রাসূলরা দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সদয়। তাদেরকে অত্যাচারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তারা পরিশ্রম করেছেন।

সূরা কাহাফের ৮০ ও ৮১ নম্বর আয়াতের আল্লাহ বলেছেন-
وَأَمَّا الْغُلَامُ فَكَانَ أَبَوَاهُ مُؤْمِنَيْنِ فَخَشِينَا أَنْ يُرْهِقَهُمَا طُغْيَانًا وَكُفْرًا (80) فَأَرَدْنَا أَنْ يُبْدِلَهُمَا رَبُّهُمَا خَيْرًا مِنْهُ زَكَاةً وَأَقْرَبَ رُحْمًا (81)
“আর ওই কিশোরটি (যাকে আমি হত্যা করেছি) তার পিতামাতা ছিল বিশ্বাসী (বা মুমিন), আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসে তাদের বিব্রত করবে।”(১৮:৮০)
“অতঃপর আমি চাইলাম যে, ওদের প্রতিপালক যেন ওদের ওর পরিবর্তে এমন এক সন্তান দান করেন যে পবিত্রতায় মহত্তর ও ভক্তি ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর হবে।”(১৮:৮১)

হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী সব কাজ করতেন। এ কারণে একজন নিরপরাধ কিশোরকে হত্যা করা তার দৃষ্টিতে জায়েয বা সঠিক ছিল না। কারণ, সে তখন পর্যন্ত কোনো গোনাহ বা পাপকাজ করেনি অথবা কাউকে হত্যা করেনি। কিন্তু হযরত খিযির তাকে অন্যায় করার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ে দেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, সৃষ্টিজগতের সবকিছুর প্রতিপালক হিসেবে যে কোনো নির্দেশ দেয়ার অধিকার আল্লাহর আছে। তিনি তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী একজন নিরপরাধ কিশোরকেও হত্যা করতে পারেন। এই কিশোর পূর্ণ বয়সে কাফের হয়ে যাবে বলে আল্লাহ তাকে হত্যা করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, ওই কিশোরের মা-বাবা এরপর আরেকটি সন্তান লাভ করেছিলেন যিনি ধর্মকর্ম পালন এবং পরহেজগারিতে ছিলেন অতুলনীয়।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল:
১. কাফের ও বেঈমান সন্তানের চেয়ে সন্তান না থাকা বা তার মরে যাওয়া ভালো।
২. আল্লাহ তার মু'মিন বান্দার কাছ থেকে কিছু নিয়ে নিলে তাকে এর চেয়ে উত্‌কৃষ্ট কিছু দান করে। কাজেই আমাদেরকে বিপদে দৈর্য ধরতে হবে।
৩. সন্তানকে হতে হবে ঈমানদার ও যোগ্য এবং পিতা-মাতার প্রতিও তাকে সদয় হতে হবে।

সূরা কাহাফের ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَامَيْنِ يَتِيمَيْنِ فِي الْمَدِينَةِ وَكَانَ تَحْتَهُ كَنْزٌ لَهُمَا وَكَانَ أَبُوهُمَا صَالِحًا فَأَرَادَ رَبُّكَ أَنْ يَبْلُغَا أَشُدَّهُمَا وَيَسْتَخْرِجَا كَنْزَهُمَا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِي ذَلِكَ تَأْوِيلُ مَا لَمْ تَسْطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا (82)
“আর ওই প্রাচীরটি (যেটিকে আমি মেরামত করে দিয়েছিলাম) সেটি ছিল নগরবাসী দুই পিতৃহীন কিশোরের, এর নিচে ছিল ওদের গুপ্তধনএবং ওদের পিতা ছিলেন সত্‌কর্মপরায়ণ ব্যক্তি; সুতরাং তোমার প্রতিপালক দয়াপরবশ হয়ে ইচ্ছা করলেন যে, ওরা বয়োপ্রাপ্ত হোক এবং ওদের ধনভাণ্ডার উদ্ধার করুক। আমি নিজে থেকে কিছু করিনি; তুমি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণে অপারগ হয়েছিলে এটি হল তার ব্যাখ্যা।” (১৮:৮২)

আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছি, পিতা-মাতার ঈমান ঠিক রাখার জন্য তাদের সন্তানকে হত্যার দায়িত্ব পেয়েছিলেন হযরত খিযির। আর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মৃত বাবা ঈমানদার ও সত্‌কর্মশীল ছিলেন বলে আল্লাহ তাঁর সন্তানদের প্রতি সদয় হন। তাদের জন্য তাদের ঈমানদার পিতার রেখে যাওয়া গুপ্তধন যাতে অন্য কারো হাতে না পড়ে সেজন্য হযরত খিযিরকে ওই প্রাচীরটি মেরামত করে দিতে বলেন।
এ আয়াতের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এখানে হযরত খিযির বলছেন, হে মুসা! আমি যে কাজগুলো করেছি তা ছিল আল্লাহর নির্দেশ এবং এবং আমি নিজে থেকে এর একটি কাজও করিনি।
ফেরেশতারাও আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের ভালো-মন্দ দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করেন। আল্লাহর নির্দেশে তারা বান্দাদের জীবন ও মৃত্যুর বিষয়টি দেখাশুনা করেন। হযরত খিযির এ কাজগুলো করে দেখালেন যাতে হযরত মুসা উপলব্ধি করেন, প্রতিটি সৃষ্টি আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হল:
১- সন্তানের জন্য সম্পদ রেখে যাওয়া দোষণীয় নয় এবং ইয়াতিমের সম্পদ তার পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে।
২- পিতার ভালো কাজের ইতিবাচক ফল সন্তান ভোগ করতে পারে। পিতার মৃত্যুর মাধ্যমে তার কাজের ফল বিলুপ্ত হয়ে যায় না।
৩- জীবনের প্রতিটি সুখ ও দুঃখের পেছনে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে যা বেশিরভাগ সময়ই তাত্‌ক্ষণিকভাবে মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কাজেই অনর্থক আল্লাহকে দায়ী করা যাবে না।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন