সূরা কাহাফ; আয়াত ৩৭-৪৪
সূরা কাহাফ; আয়াত ৩৭-৪৪
সূরার ৩৭ ও ৩৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلًا (37) لَكِنَّا هُوَ اللَّهُ رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِرَبِّي أَحَدًا (38)
“আলোচনার এক পর্যায়ে তার বন্ধু তাকে বলল, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেনমাটি থেকে ও পরে শুক্র থেকে এবং তার পরে পূর্ণাঙ্গ করেছেন মানুষ আকৃতিতে,তুমি কি তাকে অস্বীকার করছ?” (১৮:৩৭)
“কিন্তু আমার রব হচ্ছেন আল্লাহ। আমি আমার প্রভুর সঙ্গে কাউকে শরিক করি না।” (১৮:৩৮)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, পবিত্র কুরআনে একজন ঈমানদার ও একজন কাফের ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। কাফের ব্যক্তি ছিলেন সম্পদশালী। অন্যদিকে, ঈমানদার ব্যক্তি ছিলেন দরিদ্র। সম্পদশালী ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করত না। গত আসরে ওই কাফেরের অযৌক্তিক বক্তব্য আমরা শুনেছি। এ দুই আয়াতে কাফেরের বক্তব্যের বিষয়ে ঈমানদার ব্যক্তির পাল্টা বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। মুমিন ব্যক্তি তার কাফের সঙ্গীর অহংকার ও গর্বকে অনর্থক হিসেবে ঘোষণা করে এখানে বলছেন, তোমাকে মাটি ও শুক্র থেকে সৃষ্টি এবং পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত করেছেন মহান আল্লাহ। তুমি তোমাকে সৃষ্টি কর না এবং এ ক্ষেত্রে তোমার কোনো ভূমিকা নেই। তাহলে কেনো তুমি অহংকার ও গর্বে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছো? কেনো তুমি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে অস্বীকার করছ?
আসলে কিয়ামত বা পুণরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করার অর্থই হলো, আল্লাহকে অস্বীকার করা। কাফের ব্যক্তি সরাসরি বলেনি যে, সে আল্লাহকে অস্বীকার করছে। সে কেবল কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ঈমানদার ব্যক্তিটি তাকে কাফের হিসেবে অভিহিত করেছিল। কারণ কিয়ামতকে অস্বীকার করার অর্থই হলো, মানুষকে পুণরায় জীবিত করার ঐশী শক্তি ও ক্ষমতাকে অস্বীকার করা।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. ধন-সম্পদের প্রতি অতি আকর্ষণ কুফরির ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। কাজেই এ বিষয়ে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
দুই. কাফেরদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কের সময় জোরালো যুক্তি তুলে ধরতে হবে, যাতে তারা সঠিক পথ বেছে নেয়।
সূরা কাহাফের ৩৯ থেকে ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
) وَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ إِنْ تَرَنِ أَنَا أَقَلَّ مِنْكَ مَالًا وَوَلَدًا (39) فَعَسَى رَبِّي أَنْ يُؤْتِيَنِ خَيْرًا مِنْ جَنَّتِكَ وَيُرْسِلَ عَلَيْهَا حُسْبَانًا مِنَ السَّمَاءِ فَتُصْبِحَ صَعِيدًا زَلَقًا (40) أَوْ يُصْبِحَ مَاؤُهَا غَوْرًا فَلَنْ تَسْتَطِيعَ لَهُ طَلَبًا (41)
“আর যখন তুমি নিজের বাগানে প্রবেশ করছিলে তখন তুমি কেন বললে না, আল্লাহ যা চান তাই হয়, তাঁর প্রদত্ত শক্তি ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই ? যদি তুমি সম্পদ ও সন্তানের দিক দিয়ে আমাকে তোমার চেয়ে কম দেখে থাকো।” (১৮:৩৯)
“হয়ত আমার প্রভু আমাকে তোমার বাগান থেকেও আরো ভালো কিছু দেবেন এবং তোমার বাগানে আকাশ থেকে বজ্রপাত ঘটাবেন! ফলে তা (উদ্ভিদ শূন্য) মসৃণ বালিতে পরিণত হবে।” (১৮:৪০)
“অথবা তার পানি ভূগর্ভে নেমে যাবে এবং তুমি তাকে কোনোক্রমেই উঠাতে পারবে না।” (১৮:৪১)
কাফের ও ঈমানদার ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথনের এক পর্যায়ে মুমিন ব্যক্তিটি বলেন, কেনো তুমি তোমার বাগানকে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া সম্পদ বলে মনে কর না এবং এ জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না? তুমি কি জানো না যে, আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতাতেই সব কিছু হয়? তুমি কি মনে করছ বাগান ও বাগানের গাছগুলোর প্রকৃত মালিক তুমি এবং সেখানে আল্লাহর কোনো ভূমিকা নেই? কিন্তু সব কিছুর আসল মালিক হলেন মহান আল্লাহ। তুমি শুধু মাটিতে বীজ বপন কর এবং সেগুলোর তত্ত্বাবধান কর। আসলে পানি, মাটি, মেঘ, বৃষ্টি, আলো, বাতাস, শস্য, লতা-গুল্ম, ঘাস, গাছ- এসবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। বীজের অংকুরোদগমও ঘটে আল্লাহর ক্ষমতাতেই। মোট কথা, কোনো কিছুই আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার বাইরে ঘটে না। ঈমানদার ব্যক্তি আরো বলেন, আল্লাহ চাইলে আরো উন্নত বাগান ও বেশি সম্পদ আমাকে দিতে পারেন এবং তোমার বাগান ও সম্পদকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। কাজেই ধন-সম্পদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ো না এবং অহঙ্কার কর না। কারণ কোনো কিছুই তোমার নিয়ন্ত্রণে নয়। এমনও হতে পারে, ঐশী বজ্রপাত তোমার বাগানকে পুড়িয়ে দিতে পারে। অথবা খরার কারণে ভূপৃষ্ঠের পানি এত বেশি নিচে চলে যেতে পারে যে, ব্যাপক খনন করেও পানির সন্ধান পাওয়া যাবে না।
এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. প্রাকৃতিক কোনো দৃশ্য ও সৌন্দর্য চোখে পড়লে আল্লাহর নাম স্মরণ করা উচিত। সব কিছুই যে আল্লাহর সৃষ্টি, তা সব সময় মনে রাখতে হবে।
দুই. অভাব-অনটন তথা দারিদ্রের কারণে মুমিন ব্যক্তিরা কখনোই হতাশ হয়ে পড়ে না। কারণ ঈমানদারেরা যে কোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর নির্ভর করেন।
সূরা কাহাফের ৪২ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَأُحِيطَ بِثَمَرِهِ فَأَصْبَحَ يُقَلِّبُ كَفَّيْهِ عَلَى مَا أَنْفَقَ فِيهَا وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا وَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُشْرِكْ بِرَبِّي أَحَدًا (42) وَلَمْ تَكُنْ لَهُ فِئَةٌ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مُنْتَصِرًا (43) هُنَالِكَ الْوَلَايَةُ لِلَّهِ الْحَقِّ هُوَ خَيْرٌ ثَوَابًا وَخَيْرٌ عُقْبًا (44)
“(আল্লাহর শাস্তি নেমে আসার ফলে) তার সব ফসল নষ্ট হলো এবং সে তার সম্পত্তিতে যা ব্যয় করেছিল তার জন্য আক্ষেপ করতে লাগল, যখন বাগানের দরজা ও দেয়াল (ভিত্তিসহ) খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙ্গে পড়ল এবং সে অনুশোচনায় এক হাতের ওপর আরেক হাত চাপড়িয়ে বলতে লাগল, হায়! আমার প্রতিপালকের সাথে যদি কাউকে অংশীদার না করতাম।” (১৮:৪২)
“সে সময় আল্লাহর মোকাবেলায় তাকে সাহায্য করার মতো কোনো গোষ্ঠীও ছিল না, আর সে নিজেও এ বিপদের মোকাবিলা করতে সক্ষম ছিল না।” (১৮:৪৩)
“সেখানে (কিয়ামতর দিন) সব কর্তৃত্বই আল্লাহর, যিনি সত্য। তার কাছেই রয়েছে সর্বোত্তম পুরস্কার ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য।” (১৮:৪৪)
ঈমানদার ব্যক্তি কাফেরকে বোঝানোর পরও সে অহঙ্কার ও কুফরি থেকে সরে আসেনি এবং আল্লাহকে অস্বীকার অব্যাহত রেখেছিল। এ অবস্থায় তার ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে এল। ঐশী ক্রোধে তার বাগান ধ্বংস হয়ে গেল। বাগানের মালিক ওই কাফের ব্যক্তি তা দেখে অনুশোচনায় ভুগতে থাকল। কিন্তু সেই সময় তার আর কিছুই করার ছিল না। এ অবস্থায় সে তার ভুল বুঝতে পারে। সে বলে উঠে, হায়! যদি আল্লাহকে ভুলে না যেতাম এবং আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করতাম। সব কিছুর উপরই যে আল্লাহর কর্তৃত্ব, তা যদি মেনে নিতাম। কিন্তু তখন অনুতপ্ত করে লাভ হয়নি। কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই তাকে সাহায্য করার ক্ষমতা ছিল না। এখানেই এটা সুস্পষ্ট হলো যে, সব কিছুর কর্তৃত্ব আল্লাহর হাতে। কিয়ামতের দিনেও সব কর্তৃত্ব থাকবে আল্লাহর হাতে। আল্লাহই মানুষের চূড়ান্ত পুরস্কার ও শাস্তি নির্ধারণ করবেন।
এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. কিয়ামতের দিন মানুষ তার চূড়ান্ত পরিণতি ভোগ করবে। তবে কখনো কখনো এ পৃথিবীতেও অহঙ্কারী ব্যক্তিদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসতে পারে।
দুই. স্বার্থপর লোকেরা সহজেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি করে বসে। তারা আল্লাহকে ভুলে যায় এবং আল্লাহর ক্ষমতাকে অস্বীকার করে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন