সূরা কাহাফ; আয়াত ২৭-৩১
সূরা কাহাফ; আয়াত ২৭-৩১
সূরা কাহাফের ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَلَنْ تَجِدَ مِنْ دُونِهِ مُلْتَحَدًا (27)
“তোমার প্রতিপালকের কিতাব থেকে তোমার প্রতি যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তা (মানুষের সামনে) পড়, আল্লাহর বাণী অপরিবর্তনীয় এবং কখনই তিনি ছাড়া তুমি অন্য কোনো আশ্রয়স্থল পাবে না।” (১৮:২৭)
আসহাবে কাহাফের ঘটনা বর্ণনার পর এই আয়াতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, গুহাবাসী ঈমানদার ব্যক্তিদের সম্পর্কে উদ্ভট ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বহু গল্প বাজারে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু ওহীর মাধ্যমে আপনার কাছে যে সত্য কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তা মানুষকে জনিয়ে দিন এবং অন্যরা কী বলছে সেদিকে নজর দেয়ার কোনো প্রয়োজন আপনার নেই।
কাফের ও মুশরিকরা নানা অজুহাতে বিশ্বনবীর কাছে কুরআনের কোনো কোনো আয়াতে পরিবর্তন আনার দাবি জানাতো। কিন্তু এই আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী বিশ্বনবীকে কাফেরদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে এ কথা বলতে বলা হয়েছে যে, পবিত্র কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে এবং তাতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। কেউ যদি এরকম ধৃষ্ঠতাপূর্ণ কাজ করতে যায় তবে তাকে সৃষ্টিকর্তার মহা ক্রোধের মুখে পড়তে হবে।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হল:
১. পবিত্র কুরআন আল্লাহর বাণী। কাজেই এতে এ পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন আসেনি এবং ভবিষ্যতেও আসবে না।
২. পবিত্র কুরআন সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ। এরপর আর কোনো আসমানি গ্রন্থ এ পৃথিবীতে আসবে না।
সূরা কাহাফের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا (28)
“তুমি নিজেকে ওদেরই সংসর্গে রাখবে, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে আহ্বান করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, পার্থিব জীবনের সুখ-সৌন্দর্য কামনা করে তাদের দিকে তোমার দৃষ্টি ফিরিও না। যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করেছি, যে তার আপন খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে- তুমি তার অনুসরণ কর না।” (১৮:২৮)
ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, কুরাইশ বংশের কিছু নেতৃস্থানীয় কাফের বিশ্বনবীকে এই শর্ত দিয়েছিল যে, তিনি যদি সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন সমাজের নেতা ও ধনিক শ্রেণীর সঙ্গে ওঠা-বসা করেন তাহলে তারা ঈমান আনবে। তারা চরম ধৃষ্ঠতার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলে- এসব দরিদ্র মানুষ যতদিন তোমার আশপাশে থাকবে ততদিন আমরা তোমার কাছে আসবো না এবং তোমার কোনো কথাও শুনবো না।
মজার ব্যাপার হল- হযরত নুহ (আ.)’র যুগেও সমাজের ধনিক শ্রেণী আল্লাহর নবীর কাছে একই ধরনের দাবি জানিয়েছিল। জবাবে হযরত নুহ বলেছিলেন, আমি ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে তাদের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ত্যাগ করতে পারি না।
এই আয়াতে এ ধরনের কুত্সিত্ চিন্তা-ভাবনার নিন্দা জানিয়ে বিশ্বনবীকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, কাফেরদের এ ধরনের কথায় কান দেবেন না এবং সালমান ফারসি ও আবু যার গিফারির মতো দৃঢ় ঈমানের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে শুধুমাত্র তাদের আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য ত্যাগ করবেন না। সেইসঙ্গে যারা আল্লাহকে ভুলে এ পৃথিবীর সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবেন না। যারা সারাক্ষণ ইন্দ্রয়পুজায় লিপ্ত রয়েছে এবং এক মুহূর্তের জন্যও পৃথিবীর ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকতে ইচ্ছুক নয়, তাদের সঙ্গও আপনাকে পরিত্যাগ করতে হবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল-
১. দরিদ্র মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা অনেকের কাছে কষ্টকর। কিন্তু আল্লাহ সম্পদশালী কাফেরদের চেয়ে ঈমানদার দরিদ্র লোককে বেশি পছন্দ করেন।
২. মুসলিম সমাজের নেতাদের পৃথিবীর প্রতি আকর্ষণ এত বেশি হয়ে যেতে পারে যে, মহান আল্লাহ তার সবচেয়ে প্রিয় বান্দা অর্থাত্ বিশ্বনবীকেও এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন।
সূরা কাহাফের ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا وَإِنْ يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا (29)
“তুমি বল- সত্য তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে এসেছে; সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনতে এবং যার ইচ্ছা কাফের হয়ে যেতে পারে। আমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য আগুন প্রস্তুত রেখেছি- যার আবরণ ওদের পরিবেষ্টন করবে। ওরা পানি চাইলে ওদের গলিত ধাতুর মতো পানীয় দেয়া হবে। যা তাদের মুখমণ্ডল ঝলসে দেবে, এটি (হবে) কত নিকৃষ্ট পানীয় এবং এ জায়গা (হবে) কত নিকৃষ্ট আশ্রয়।” (১৮:২৯)
সম্পদশালী কাফেরদের অযৌক্তিক দাবির জবাব দিতে গিয়ে এই আয়াতে বলা হচ্ছে: তাদের ঈমান আনা বা না আনায় রাসূলুল্লাহ বা আল্লাহর কিছু এসে যায় না, কাজেই এ ধরনের শর্ত অনর্থক। আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এখন যার খুশি সে ঈমান আনবে এবং যার খুশি সে কাফের থাকবে। কাউকে ঈমান আনার জন্য পীড়াপীড়ি করা হয়নি। ঈমান আনার জন্য শর্ত আরোপকারী হাজারো কাফেরের চেয়েও একজন সত্যিকারের ঈমানদার উত্তম। এ ছাড়া, যারা দুনিয়ায় দুর্নীতি, আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত রয়েছে তাদের জন্য আখেরাতে থাকবে নিকৃষ্টতম স্থান ও নিকৃষ্টতম খাবার ও পানীয়। তাদের আজকের সম্পদের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই কারণ, এ দুনিয়ার চাকচিক্য অচিরেই শেষ হয়ে যাবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল-
১. মানুষের ঈমান আনা বা না আনার ওপর ইসলামের সত্যতা নির্ভর করছে না। পবিত্র কুরআন ও আল্লাহ মহাসত্য। পৃথিবীর সব মানুষ কাফের হয়ে গেলেও এ সত্যে বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটবে না।
২. ঈমান আনা বা না আনার ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে ঈমানদার ও কাফেরদের পরিণতির কথাও কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। কিয়ামতের দিন কাফেরদের যে কী কঠিন শাস্তি পেতে হবে তা এই আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
সূরা কাহাফের ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ مَنْ أَحْسَنَ عَمَلًا (30) أُولَئِكَ لَهُمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ نِعْمَ الثَّوَابُ وَحَسُنَتْ مُرْتَفَقًا (31)
“যারা ঈমান আনে ও সত্কাজ করে, (তারা জেনে রাখুক) আমি তাদের পুরস্কৃত করি, সত্কাজের শ্রম-ফল নষ্ট করি না।” (১৮:৩০)
“ওদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে ওদের স্বর্ণ-কঙ্কণে অলঙ্কৃত করা হবে, ওরা পরবে সূক্ষ্ম ও স্থূল রেশমের সবুজ বস্ত্র ও সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে; (এটি হবে) কত সুন্দর পুরস্কার ও কি উত্তম আশ্রয়-স্থল।” (১৮:৩১)
পৃথিবীতে ভোগ-বিলাস ও ইন্দ্রিয়পুজায় মত্ত ব্যক্তিদের কঠিন শাস্তির খবর জানানোর পর এই আয়াতে সত্কর্মশীল ঈমানদার ব্যক্তিদের পুরস্কারের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, এই পৃথিবীতে যাদেরকে দরিদ্র ও অসহায় দেখছো তাদেরকেই বিশ্বনবীর প্রতি আনুগত্য এবং আল্লাহর পথে অটল থাকার পুরস্কার হিসেবে কেয়ামতের কঠিন দিনে সর্বোত্তম ভোগের উপকরণ দেয়া হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তিও জান্নাতের এক মুহূর্তের আরাম-আয়েশ এ পৃথিবীতে তৈরি করতে পারেনি। পৃথিবীর সম্পদশালী ব্যক্তি দামী পোশাক পরিধান ও প্রাসাদে বসবাস করলেও জান্নাতবাসীকে যে উন্নত পোশাক ও অট্টালিকা দেয়া হবে তার সঙ্গে এ পৃথিবীর প্রাসাদগুলোর কোনো তুলনাই চলে না।
এ দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হল:
১. ঈমানদার ব্যক্তিরা আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু হারিয়েছেন কিয়ামতের দিন তাদের সে ক্ষতি আল্লাহ পুষিয়ে দেবেন এবং তার চেয়েও বেশি কিছু তাদেরকে দান করবেন।
২. আমাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় কাজ করতে হবে। কারণ তাঁর জন্য কাজ করলে পুরস্কার অবধারিত এবং আল্লাহর পুরস্কার ক্ষণস্থায়ী বা ধ্বংসশীল নয়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন