সূরা হাজ্জ; আয়াত ৬৩-৬৬
সূরা হাজ্জ; আয়াত ৬৩-৬৬
সূরা হাজ্জের 63 ও ৬৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَتُصْبِحُ الْأَرْضُ مُخْضَرَّةً إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ (63) لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنَّ اللَّهَ لَهُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ (64)
"তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহই আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, ফলে ভূমি সবুজ-শ্যামল হয়ে উঠে? এবং নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় সুক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞানী।" (২২:৬৩)
"যা আকাশ ও ভূ-মণ্ডলে আছে তা তাঁরই; এবং নিশ্চয় একমাত্র আল্লাহই অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত।" (২২:৬৪)
আগের কয়েকটি পর্বের আলোচনায় বিশ্ব জগতে আল্লাহর অতুল ক্ষমতার কিছু নিদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন, রাত ও দিনের আবর্তন আল্লাহর অশেষ ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন। এখানে মহান আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতার আরো এক নিদর্শন হিসেবে বৃষ্টি বর্ষণের কথা এসেছে। মহান আল্লাহ বলছেন, বৃষ্টি বর্ষণের ফলে জীবনের উন্মেষ ঘটে ও বেড়ে ওঠে সবুজ গাছপালা, আর এসবই আকস্মিক এবং উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা-বিহীন কোনো ঘটনা নয়, কিংবা নয় স্বয়ংক্রিয় ঘটনা। বরং এইসব প্রাকৃতিক ঘটনা মহান আল্লাহর পরিকল্পনার আওতায় এবং তাঁর সূক্ষ্ম জ্ঞান ও অশেষ দয়ার বরকতে ঘটে থাকে।
মহান আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টি ও মানুষের স্রস্টা। তিনিই সব সৃষ্টি ও অস্তিত্বের মালিক। সৃষ্টিকুল সব সময় আল্লাহর দয়া-দাক্ষিণ্য ভোগ করছে। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ প্রশংসা ও ইবাদতের যোগ্য।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. মহান আল্লাহ এই বিশ্ব জগতে জীবকূলের জীবন যাপনের ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার বিধান দিয়েছেন। আর এইসব বিধানের আলোকেই তিনি অস্তিত্বের জগত পরিচালনা করছেন।
২. একমাত্র মহান আল্লাহই হচ্ছেন স্বনির্ভর ও অমুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুই তাঁর মুখাপেক্ষী।
সূরা হাজ্জের ৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ وَالْفُلْكَ تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَيُمْسِكُ السَّمَاءَ أَنْ تَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِهِ إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ (65)
"তুমি কি লক্ষ্য করনি যে, ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে আল্লাহ সেগুলোকে তোমাদের অধীন ও বশীভূত করে দিয়েছেন এবং নৌযানকেও যা তাঁর নির্দেশে সমুদ্রে চলাচল করে; এবং তিনিই আকাশকে স্থির রেখেছেন, যা তাঁর ইচ্ছা ছাড়া ভূপৃষ্ঠে ভেঙ্গে পড়তে পারে না। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অতিশয় সদয়, পরম দয়ালু।" (২২:৬৫)
এ আয়াতে মহান আল্লাহর আরো একটি অনুগ্রহের কথা এসেছে। আল্লাহ বলছেন, আমি পৃথিবীর ভূভাগ ও তরল অংশ তথা নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর- এসবই মানুষের কর্তৃত্বাধীন করে দিয়েছি। আমি মানুষকে এতটা বুদ্ধি ও ক্ষমতা দিয়েছি যে তার ফলে তারা পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নানা পন্থায় তা থেকে উপকৃত হচ্ছে। মানুষের বিকাশ ও অগ্রগতির প্রাথমিক উপাদানগুলো আল্লাহই মানুষকে সরবরাহ করেছেন। যেমন, খাদ্য-সামগ্রী, পোশাক, ঘর-বাড়ী ও পরিবহনের জন্য যা যা দরকার তা সংগ্রহের বুদ্ধি ও উপাদানগুলো আমি আল্লাহই মানুষকে যুগিয়ে থাকি।
নানা শিল্প-কারখানার প্রাথমিক উপাদান ও কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয় পাহাড় ও মাটির গভীরে থাকা নানা খনি থেকে। ফলে মানুষ ব্যবহার করতে পারছে ভোগের ও ব্যবহারের নানা সামগ্রী। ভূভাগে পণ্য পরিবহন ও ভ্রমণের জন্য মানুষ ঘোড়া, গাধা, গরু ও উট ব্যবহার করে। আর সাগরে পরিবহন ও ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করে নৌকা ও জাহাজের মত নানা নৌযান।
আয়াতের শেষাংশে মহান আল্লাহ বলছেন, আমি মহাকাশে সৌর-জগতগুলো ও গ্রহ-উপগ্রহগুলোকে কাছাকাছি রাখিনি। বরং সেগুলোকে ব্যাপক দূরত্বের মধ্যে রেখেছি এবং প্রত্যেক গ্রহ-উপগ্রহের ও সৌর-জগতের আবর্তনের জন্য সুনির্দিষ্ট কক্ষপথ স্থির করে রেখেছি বলেই সেগুলো কখনও পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায় না। কোনো একটি গ্রহ কখনও পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খেলে ধ্বংস হয়ে যেত পৃথিবী। আর এভাবেই পৃথিবীর মানুষকে আমি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করছি।
এই আয়াতের দুটি শিক্ষা হল:
১. মহান আল্লাহ পৃথিবীর ওপর মানুষকে কর্তৃত্ব দান করেছেন। ফলে তারা এর নানা সম্পদ ব্যবহার করতে সক্ষম।
২. মহান আল্লাহর ইচ্ছা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার কারণেই সৃষ্টি জগতের ব্যবস্থাপনা অটুট রয়েছে এবং এই জগত ধ্বংস হচ্ছে না। তাই আল্লাহ কখনও এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্ব-জগতকে নিজের অবস্থার ওপর ছেড়ে দিলে তা ধ্বংস হয়ে যাবে।
সূরা হাজ্জের ৬৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَهُوَ الَّذِي أَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَكَفُورٌ (66)
"এবং তিনি তো তোমাদের জীবন দান করেছেন, পরে তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর তিনিই আবারও তোমাদের জীবিত করবেন। নিশ্চয়ই মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ!" (২২:৬৬)
প্রকৃতিতে জীবন ও মৃত্যু মহান আল্লাহর ক্ষমতার আরো দুই গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। মৃত ভূমি বা মাটি থেকে তিনি ঘটান জীবনের উন্মেষ। মানুষ সৃষ্টির পর আল্লাহই মানুষকে দেন নানা ধরনের ক্ষমতা ও প্রতিভা। অবশেষে একদিন মানুষ মারা যায় আল্লাহরই ইচ্ছায়। ফলে মানুষ আবারও ফিরে যায় মাটির কোলে। কবরের বারজাখি বা মধ্যবর্তী জীবনের পর আবারও মাটির কোল থেকে বের করে এনে মানুষকে হাজির করা হবে বিচার-দিবসের মহাবিচারালয়ে।
এখানে আল্লাহ মানুষের নিন্দা জানিয়ে বলছেন, মানুষকে এত নেয়ামত দেয়ার পরও তারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ নয়। তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে পাপে লিপ্ত হয় এবং কেউ কেউ আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে।
মানবজাতি বিজ্ঞানের এত অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনও জীবনের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। তারা প্রাণহীন উপাদান থেকে প্রাণযুক্ত কোনো অস্তিত্ব এখনও তৈরি করতে পারেনি। অথচ তাদের কেউ কেউ প্রাণের স্রস্টা আল্লাহর অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং নানা পন্থায় বিশ্ব-জগতে আল্লাহর ভূমিকাকে উপেক্ষা করছে।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. মৃত্যু কেবল এই পার্থিব জগতে মানুষের জীবনের সমাপ্তি মাত্র। কিন্তু ভিন্ন এক জগতে মানুষের জীবন ঠিকই অব্যাহত থাকবে।
২. পারলৌকিক জীবনের মুক্তির জন্য এই পৃথিবীতে বিরাজমান সুযোগ-সুবিধাগুলোকে কাজে লাগানোই হচ্ছে স্রস্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সবচেয়ে ভালো পন্থা।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন