সূরা হাজ্জ; আয়াত ৪৬-৫১

সূরা হাজ্জ; আয়াত ৪৬-৫১


সূরা হাজ্জের ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَا أَوْ آَذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَكِنْ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ (46)
"তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি? যাতে তাদের এমন হৃদয় (ও বিচার-বুদ্ধি) হয় যা দিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং এমন কান হয় যা দিয়ে শুনতে পায়, ‘প্রকৃতপক্ষে (বাহ্যিক) চক্ষু অন্ধ হয় না; বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়।" (২২:৪৬)

আগের আয়াতে কয়েকটি জাতির জুলুমের পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। এই জাতিগুলোর জনপদ বা শহর ধ্বংস হয়ে গেছে। এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, ওই জালিমরা অতীতের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেয়নি এবং তা থেকে শিক্ষা নেয়নি। তাদের চোখ, কান ও বিবেক যদি সত্যকে দেখতে পেত এবং সত্যকে মেনে নিত তাহলে তাদের পরিণতির শিকার হতে হত না।
তারা অতীতের রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদগুলোর ধ্বংসস্তূপ দেখত, কিন্তু তা সত্ত্বেও জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত হত না। বরং আরো সম্পদ ও ক্ষমতার পেছনে ছুটত। অন্য কথায় তাদের চোখ সত্যকে ঠিকই দেখতে পেত, কিন্তু তাদের অন্তর এ সত্যকে মানত না যে তাদের জন্যও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। তাদের কানগুলো অতীতের ঘটনাগুলোর বৃত্তান্ত শুনেছে, কিন্তু তারা তাদের বিবেকের এ ডাক শুনতে পেত না যে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তারা বাহ্যিকভাবে দেখতে পেত ও শুনতে পেত, কিন্তু বাস্তবে ছিল অন্ধ ও বধির। ফলে সত্যকে দেখত না ও সত্যের বাণী শুনতে পেত না।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. অতীতের ইতিহাস জানার জন্য ও সেইসব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য ভ্রমণ করা আমাদের আজকের জীবনের জন্য খুবই জরুরি ও কল্যাণকর কাজ।
২. জুলুম-নির্যাতন জুলুমকারীকে এমন অবস্থায় উপনীত করে যে সে আর বাস্তবতা বা সত্যকে দেখতে পায় না; কিংবা যদি দেখতেও পায় ও বুঝতেও পারে তা সত্ত্বেও সে সত্যকে গ্রহণ করে না।

সূরা হাজ্জের ৪৭ ও ৪৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَيَسْتَعْجِلُونَكَ بِالْعَذَابِ وَلَنْ يُخْلِفَ اللَّهُ وَعْدَهُ وَإِنَّ يَوْمًا عِنْدَ رَبِّكَ كَأَلْفِ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ (47) وَكَأَيِّنْ مِنْ قَرْيَةٍ أَمْلَيْتُ لَهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ ثُمَّ أَخَذْتُهَا وَإِلَيَّ الْمَصِيرُ (48)
"(হে রাসূল!) তারা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, অথচ আল্লাহ কখনই তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। এবং তোমার প্রতিপালকের কাছে একদিন তোমাদের গণনার হাজার বছরের সমান।" (২২:৪৭)
"এবং কত জনপদ ছিল যেগুলোকে আমি অবকাশ দিয়েছিলাম এমন অবস্থায় যে, তারা (অধিবাসীরা) অবিচারক ছিল; পরে আমি তাদের পাকড়াও করলাম তথা শাস্তি দিয়েছি এবং (পরিশেষে সবাইকে) আমারই কাছে ফিরতে হবে।" (২২:৪৮)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন মুশরিকদের সতর্ক করার জন্য বলতেন, তোমরাও অতীত জাতিগুলোর মত আল্লাহর শাস্তি ডেকে এনো না নিজেদের জন্য, তখন তারা ঠাট্টা করে বলত: যদি তোমার ক্ষমতা থাকে তাহলে তোমার আল্লাহকে বল যত তিনি তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের শাস্তি দেন। আল্লাহ এর উত্তরে তাদের বলছেন, তোমরা তাড়াহুড়া কর না। কারণ, আল্লাহ অতীতের কাফির ও জালিমদেরকেও দ্রুত বা তাতক্ষণিক শাস্তি দেননি, বরং সুযোগ দিয়েছেন সঠিক পথে ফিরে আসার বা তওবা করার। কিন্তু যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তারা মিথ্যার ওপর অবিচল থাকতে চায় এবং অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকতে প্রস্তুত নয় তখন আল্লাহ তাদের পাকড়াও করলেন ও ধ্বংস করে দিলেন।

এখানে মহান আল্লাহ আরো একটি সূক্ষ্ম বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। আর তা হল, মানুষের হাজার হাজার বছর মহান আল্লাহর কাছে এক দিনেরও সমান নয়। তাই আল্লাহর শাস্তি সত্যিই আসবে কিনা তা দেখা বা পরীক্ষা করার জন্য কাফিরদের তাড়াহুড়া অর্থহীন। মহান আল্লাহর কাছে এক ঘণ্টা, এক দিন ও এক বছরের মধ্যে কোনো তফাত নেই। যখনই নির্ধারিত সময় উপস্থিত হবে তখনই সত্য-প্রত্যাখ্যানকারী কাফিররা আল্লাহর আজাবের স্বাদ ভোগ করবে।

অতীতের দুর্বিনীত জাতিগুলোও আল্লাহর শাস্তি দেখানোর জন্য নিজ নিজ নবী-রাসূলের কাছে দাবি জানাত। তারা বিদ্রুপ করে বলত, আল্লাহর আজাব বা শাস্তি আসবে- তোমার এমন দাবি যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহকে বল শিগগিরই আমাদের ওপর আজাব নাজেল করতে।

এই আয়াত থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দু'টি দিক হল:
১. আল্লাহর শাস্তি সত্যিই আসবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ না করে বা খোদায়ী শাস্তিকে নির্ধারিত সময়ের আগেই দেখতে চাওয়ার ধ্বংসাত্মক অলীক আবদার না করে অতীত অপরাধের ক্ষতি সংশোধনের চেষ্টা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কেবল এভাবেই আল্লাহর শাস্তি আসতে বিলম্ব ঘটার রহমত ও সময়সীমাকে কাজে লাগানো উচিত।
২. মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহকে আমাদের সাথে তুলনা করা ঠিক নয়। মহান আল্লাহর রহমত তাঁর ক্রোধের চেয়ে অনেক বেশি। পাপ করার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ পাপীকে শাস্তি দেন না।

সূরা হাজ্জের ৪৯, ৫০ ও ৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا أَنَا لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ (49) فَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ (50) وَالَّذِينَ سَعَوْا فِي آَيَاتِنَا مُعَاجِزِينَ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ (51)
"(হে নবী! আপনি) বলুন, ‘হে মানবজাতি! আমি তো কেবল তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী।" (২২:৪৯)
"সুতরাং যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা।" (২২:৫০)
"এবং যারা আমাদের নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করার বা সেগুলোকে মিথ্যা বলে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়েছে এবং যারা মনে করে আমাদেরকে অক্ষম করা সম্ভব হবে তারাই তো জাহান্নামের অধিবাসী।" (২২:৫১)

কাফির-মুশরিকরা খোদায়ী শাস্তির সত্যতার ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ পোষণ করত। তারা বিদ্রুপ করে রাসূল (সা.)-কে বলত, "যদি তোমার দাবি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ওপর তোমার খোদার শাস্তি নাজিল কর।" এই আয়াতে আল্লাহ রাসূল (সা.)-কে দিয়ে ওই কাফির-মুশরিকদের উদ্দেশে বলছেন, নবী-রাসূলদের কাজ হল কেবল সতর্ক করা ও উপদেশ দেয়া, শাস্তি দেয়া নয়। মন্দ ও নোংরা কাজ করলে যে শাস্তি পেতে হবে এবং সুন্দর ও ভাল কাজ করলে যে পুরস্কার রয়েছে তা তুলে ধরা যাতে মানুষ তাদের কাজের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে সঠিক পথটি বেছে নেয়।

নবী-রাসূলরা হুঁশিয়ারি দেয়ার পাশাপাশি সুসংবাদও দিতেন। তাঁরা কাফিরদের বলতেন, যদি গোঁড়ামি ও একগুঁয়েমি ছেড়ে দিয়ে ঈমান আন তাহলে আল্লাহ তোমাদের অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের বিশেষ অনুগ্রহ বা নেয়ামতও তাদের দান করবেন। কিন্তু তারা যদি মিথ্যা ও কুফরির পথ বেছে নেয় এবং আল্লাহর কিতাবের বিরোধিতা করে ও এটা মনে করে যে এই কাজে সফল হবে তাহলে এই দুনিয়ায় তো সফল হবেই না, আর পরকালেও জাহান্নামের আগুনের খোরাক হবে।

এ তিন আয়াতের শিক্ষা হল:
১. নবী-রাসূলরা জনগণকে ধর্ম মেনে নিতে বাধ্য করেন না এবং কাফিরদেরকেও শাস্তি দেন না। তাদের দায়িত্ব হল, কেবল সত্যকে তুলে ধরা ও সতর্ক করা।
২. নবী-রাসূলরা স্পষ্ট ভাষায় ও সবার জন্য বোধগম্য করে মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন কঠিন ও জটিল কিংবা অ-বোধগম্য ভাষায় নয়।
৩. কাফিররা খোদায়ী ধর্মগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করে এবং মুমিনদের ব্যর্থ বা পরাজিত করার ব্যাপক চেষ্টা চালায়। তাই মু'মিন বা বিশ্বাসীদের উচিত সুস্পষ্ট যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে আল্লাহর ধর্মের পক্ষ নেয়া।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন