সূরা হাজ্জ; আয়াত ৩০-৩৪

সূরা হাজ্জ; আয়াত ৩০-৩৪


সূরা হাজ্জের সূরার ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ وَأُحِلَّتْ لَكُمُ الْأَنْعَامُ إِلَّا مَا يُتْلَى عَلَيْكُمْ فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ (30)
"এটাই (হজ্জের বিধান) এবং যে কেউ আল্লাহর সম্মানিত বিধানসমূহকে সম্মান করবে তা তার প্রতিপালকের কাছে তার জন্য উত্তম। এবং সেই প্রাণীগুলো ছাড়া যা তোমাদের কাছে বিবৃত করা হবে, সব চতুষ্পদ গবাদি পশু তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা মূর্তিগুলোর মত নানা অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক এবং মিথ্যা ও অসার কথা থেকেও দূরে থাক।" (২২:৩০)

আগের আয়াতগুলোতে হজ্জের কিছু বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে ওইসব বিধানকে পবিত্রতার সীমানা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে এইসব বিধান মেনে চলা বা সেসবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন জরুরি এবং অপরিহার্য। এ ছাড়াও পবিত্র মক্কা শহর, মসজিদুল হারাম ও কাবা ঘরের বিশেষ মর্যাদা থাকায় এইসবের সম্মান রক্ষাও জরুরি এবং এসবের যে কোনো ধরনের অবমাননা থেকে দূরে থাকতে হবে। এই আয়াতে মহান আল্লাহ হালাল ও হারামের কিছু বিধান তুলে ধরেছেন এবং অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকার ওপর জোর দিয়েছেন। বস্তুগত কিছু অপবিত্রতা হল হারাম খাবার খাওয়া আর আধ্যাত্মিক কিছু অপবিত্রতা হল শির্ক, মূর্তিপূজা এবং অসার ও অশালীন কথা-বার্তা।

এই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
১. খোদায়ী ফরমানগুলোকে খোদায়ী পবিত্রতা হিসেবে পুরোপুরি মান্য করতে হবে এবং এভাবে সেসবের অত্যুচ্চ সম্মান বজায় রাখতে হবে।
২. যেসব কথা বিবেক-বুদ্ধি ও কুরআনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় সেসব কথাই অসার এবং অশোভনীয়। তাই মুমিনদেরকে এ ধরনের কথা বলা থেকে দূরে রাখতে হবে।

সূরা হাজ্জের ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
حُنَفَاءَ لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِينَ بِهِ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ (31) ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ (32)
إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ (31) قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ (32)

"আল্লাহর প্রতি সত্যনিষ্ঠ (মিথ্যা পরিহারকারী) হয়ে (হজ্জের অনুষ্ঠানগুলো পালন কর) এবং তাঁর সঙ্গে অংশী কর না; এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে অংশী করে সে যেন আকাশ থেকে পতিত হল, অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা দমকা হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বহু দূরে নিক্ষেপ করল (আর এভাবে জীবন থেকে খসে পড়ল)।" (২২:৩১)
"হ্যাঁ, এটাই (আল্লাহর বিধান) এবং যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করবে, নিশ্চয়ই এটা (সম্মান প্রদর্শন) হৃদয়সমূহের সাবধানতা বা খোদাভীতি থেকে উদ্ভূত (ও আত্মসংযমের নিদর্শন)।" (২২:৩২)

এই আয়াতে পবিত্র হজ্জের একত্ববাদী অনুষ্ঠানের মধ্যে শির্কের বা অংশীবাদিতার দুষণযুক্ত কোনো আচরণ না করার ওপর আবারও জোর দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেন: তোমরা কেবল আল্লাহর জন্য আন্তরিকভাবে কাজ কর এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো কাজ কোরো না। আর এটা এমন একটি বিষয় যা আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে দান করেছেন।

আয়াতের পরবর্তী অংশে অত্যন্ত স্পষ্ট ও পরিপক্ব উদাহরণ দিয়ে আল্লাহ বলছেন : যাদের কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত নয় তাদের অবস্থা হল সেই ব্যক্তির মত যে আকাশ থেকে থেকে পড়ে গেছে অথবা লাশ খেকোদের শিকার হয়েছে, আর যদি তাদের নাগপাশ বা থাবা থেকে রক্ষাও পায় তবুও প্রবল ঝড় তাকে যে কোনো দিকে উড়িয়ে নিয়ে ফেলে দেয়।

হ্যাঁ, তৌহিদ তথা এক আল্লাহর ইবাদত মানুষকে আল্লার দিকে টেনে নেয়, আর শির্ক বা আল্লাহর সঙ্গে অংশীবাদীতা মানুষকে আল্লাহর রহমতের অসীম আকাশ থেকে অজ্ঞতা, অনৈক্য ও বিচ্যুতির অতলে তলিয়ে দেয়।

আর যারা আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেয়, খোদাভীতি বা পরহিজগারিতা অবলম্বন করে তারা সব ধরনের বিচ্যুতি থেকে মুক্ত থাকে। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ওপর ভরসা করে তারা সব সময়ই বিচ্যুতি ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বিপদের মুখে থাকে।

অবশ্য তাকওয়ার রয়েছে নানা স্তর। আত্মিক পর্যায়ে তাকওয়া অর্জিত হলে মানুষ মন থেকে খোদা ছাড়া অন্য সব কিছুর আকর্ষণ দূর করে ফেলেন এবং আল্লাহর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেন। ফলে এই শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয়কেও মহান বিষয় হিসেবে সম্মান করেন।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:
১. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ওপর ভরসা করা হলে এর অনিবার্য পরিণতি হবে পতন, এমনকি ভরসার স্থল যদি পরাশক্তিও হয়ে থাকে।
২. ইবাদত বা সত কাজ পরিমানে বেশি করা হল কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আন্তরিকতা। কাবা ঘর তাওয়াফ করাও যদি আন্তরিক উদ্দেশ্যে বা আল্লাহকে সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা না হয় তাহলে তাতে মানুষের কোনো উন্নতি ঘটবে না বরং পতন ঘটবে।
৩. একত্ববাদকে ও আন্তরিকতাকে আঁকড়ে ধরলে মানুষ সব ধরনের বাইরের চাপ ও ভেতরের তথা কুপ্রবৃত্তির চাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে এবং প্রশান্তি অর্জন করতে পারবে। অন্যদিকে শির্ক মানুষকে ভেতর ও বাইরে অনিরাপদ এবং উদ্বিগ্ন রাখে।

সূরা হাজ্জের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لَكُمْ فِيهَا مَنَافِعُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى ثُمَّ مَحِلُّهَا إِلَى الْبَيْتِ الْعَتِيقِ (33) وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ (34)
"তোমাদের জন্য এগুলোর (কুরবানির পশুর) মধ্যে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নানা উপকার রয়েছে; এরপর তাদের কুরবানির স্থান হল প্রাচীন গৃহের (কাবার) কাছাকাছি।" (২২:৩৩)
"আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, যাতে তারা সেসব গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণীর ওপর (জবাইকালে) আল্লাহর নাম নেয় যেগুলো তিনি তাদের জীবিকাস্বরূপ দিয়েছেন। বস্তুত, তোমাদের উপাস্য সে-ই অদ্বিতীয় আল্লাহ, সুতরাং তাঁরই (নির্দেশের) অনুগত হও এবং বিনয়াবনতদের সুসংবাদ দাও।" (২২:৩৪)

একদল মুসলমান কুরবানির জন্য আনা পশুর দুধকে নিজেদের জন্য হারাম মনে করত। তারা এইসব পশুর পিঠে আহরণ বা এগুলোকে যানবাহন হিসেবে ব্যবহার করাকেও অবৈধ বলে মনে করত। অথচ আল্লাহ তাদেরকে এ ধরনের কোনো নির্দেশ দেননি। বরং ওই বিভ্রান্ত মুসলমানরাই নিজস্ব রুচির আলোকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা ধর্মের বিধান বলে প্রচার করে।

সূরা হাজ্জের ৩৩ নম্বর আয়াতে এই কুসংস্কারের গোঁড়ায় তীব্র আঘাত হেনে মহান আল্লাহ বলছেন : কুরবানি করার আগ পর্যন্ত কুরবানির পশু থেকে উপকৃত হওয়া বৈধ। অন্য যে কোনো গৃহপালিত পশুর মতই মালিক কুরবানির পশু থেকে জবাইয়ের আগ পর্যন্ত উপকৃত হতে পারেন।

পরবর্তী আয়াতে একটি সামগ্রিক বিধান উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলছেন: কুরবানি করার প্রথা একটি ইবাদত। এই প্রথা সব খোদায়ী ধর্মেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু মুশরিকরা এই প্রথাটিকে কুসংস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে। তারা কুরবানি করার সময় নানা মূর্তির নাম নেয়। অথচ কুরবানি করার অর্থ হল আল্লাহর পথে মানুষেরই কুরবানি হওয়ার প্রতীক। অবশ্য এর মাধ্যমে অভুক্ত ও দরিদ্ররাও উপকৃত হয়।

আয়াতের শেষাংশে আল্লাহর বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে পুরোপুরি অনুগত ও একনিষ্ঠ হওয়ার ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি বিনয়াবনত মানুষদেরকে পুরস্কারের সুসংবাদ দিতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এ আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:
১. ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিরুচি ও ঝোঁক-প্রবণতাকে আমদানি করা ঠিক নয়। কারণ, এর মাধ্যমে ধর্মের মধ্যে কুসংস্কার জায়গা করে নেয়।
২. একজন মুমিন বা বিশ্বাসী মুসলমান তার সব কাজই করবেন আল্লাহর নাম নিয়ে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এমনকি তিনি যে গোশত খাবেন তার ওপরও আল্লাহর নাম নেয়া হয়।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন