সূরা হাজ্জ; আয়াত ১২-১৬
সূরা হাজ্জ; আয়াত ১২-১৬
يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُ وَمَا لَا يَنْفَعُهُ ذَلِكَ هُوَ الضَّلَالُ الْبَعِيدُ (12) يَدْعُو لَمَنْ ضَرُّهُ أَقْرَبُ مِنْ نَفْعِهِ لَبِئْسَ الْمَوْلَى وَلَبِئْسَ الْعَشِيرُ (13)
"সে আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুকে আহ্বান করে যে না তার কোন ক্ষতি করতে পারে, আর না কোন উপকার করতে পারে; এ তো ঘোর বিভ্রান্তি!" (২২:১২)
"সে এমন সত্তাকে আহ্বান করে নিশ্চয় যার অনিষ্ট তার উপকারের চেয়ে অনেক বেশি; কত নিৃকষ্ট অভিভাবক এবং কত নিকৃষ্ট সহচর!"(২২:১৩)
আগের আলোচনায় দুর্বল ঈমানদারদের প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন বলেছে যে, দুনিয়ার স্বার্থ বজায় থাকলে এরা দ্বীনদার ও ধর্মের পক্ষে থাকে। কিন্তু দুনিয়ার স্বার্থ না থাকলে বা সামান্য কোনো বিপদ আসলেই তারা ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও খোদাদ্রোহী হয়ে যায়।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: দুর্বল ঈমানের অধিকারী এই শ্রেণীর ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে সত্য থেকে দূরে সরতে থাকে। ফলে তারা আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে কুসংস্কারের দিকে ধাবিত হয়। তারা মনে করে কোনো কোনো তারকা অথবা নিষ্প্রাণ পাথর তাদের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তাই তারা নানা পদ্ধতিতে এই বস্তুগুলোর কাছে সমস্যা সমাধানের জন্য আর্জি জানায় এবং তারা এইসব বস্তুর সঙ্গে এক ধরনের উপাসনাসুলভ আচরণে লিপ্ত হয়।
দুঃখজনকভাবে সভ্যতার এই যুগেও অনেক মানুষ ঘোড়ার পায়ের ক্ষুর বাধাই করার লোহা ও সাপের হাড়কে সৌভাগ্যের নিদর্শন বলে মনে করে এবং এইসব নিষ্প্রাণ বস্তুর কাছে সৌভাগ্য পাওয়ার আর্জি পেশ করে! আবার অনেকে পার্থিব আরাম-আয়েশ ও সুখের জন্য এক শ্রেণীর মানুষের অন্ধ অনুসরণ করে। অথচ এই শ্রেণীর মানুষ অন্য মানুষের উপকারের চেয়ে বরং বেশি ক্ষতি করে থাকে। যেমন, এরা বিপদের সময় মানুষকে কোনো সহায়তা করতে পারে না।
ফেরাউনের অনুসারীরা আল্লাহর পরিবর্তে ফেরাউনকেই খোদা মনে করত ও তার উপাসনা করত। কিন্তু ফেরাউন বিপদের সময় তাদের কোনো সহায়তাই করতে পারেনি। ফেরাউন ও তার অনুসারীরা সবাইই নীল নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিল।
এ দুই আয়াতের শিক্ষা হল:
১. আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে- এ ধরনের বিশ্বাস শির্কসুলভ ও বিভ্রান্তি মাত্র।
২. যারা আমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় ও অন্য কোনো বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দেয় তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। কারণ, এই ব্যক্তিগুলো বিপদের সময় আমাদের কোনো সাহায্যই করতে পারে না।
সূরা হাজ্জের ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ (14)
"নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সতকর্ম করে আল্লাহ তাদের সেই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত; নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।" (২২:১৪)
বিভ্রান্ত লোকদের কঠোর শাস্তি বা পরিণতি তুলে ধরার পর এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, যারা দুনিয়ার জীবনের শেষ পর্যন্ত ঈমানের ওপর অবিচল থাকবে এবং যারা সতকাজ করেছে ও পবিত্র বা পাপমুক্ত থেকেছে তারা পরকালে জান্নাতের অধিবাসী হবে। আল্লাহ যে ওয়াদা করেন তা বাস্তবায়ন করেন। আল্লাহ তার বান্দাদের অবস্থা সম্পর্কে জানেন এবং আল্লাহ তার বান্দাদের পুরস্কার দিতে সক্ষম।
এ আয়াতের দুটি শিক্ষা হল:
১. ঈমান বা বিশ্বাস ছাড়া সতকর্ম অর্থহীন আবার সতকর্ম ছাড়াও শুধু মৌখিক ঈমানের কোনো মূল্য নেই। মুক্তি ও সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হল সতকর্মসহ ঈমান।
২. কাফেররা খোদার পরিবর্তে মানুষের কাছে সাহায্য চায়। অথচ এই মানুষেরা তাদেরকে পৃথিবীতেই কোনো উপকার করতে পারে না, আখিরাত বা পরকালে উপকার করা তো দূরের কথা। অন্যদিকে মুমিনরা আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়। কারণ, তিনি তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম। তিনি বিচার দিবসের মালিক ও বিচারক।
সূরা হাজ্জের ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
مَنْ كَانَ يَظُنُّ أَنْ لَنْ يَنْصُرَهُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ فَلْيَمْدُدْ بِسَبَبٍ إِلَى السَّمَاءِ ثُمَّ لِيَقْطَعْ فَلْيَنْظُرْ هَلْ يُذْهِبَنَّ كَيْدُهُ مَا يَغِيظُ (15) وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ آَيَاتٍ بَيِّنَاتٍ وَأَنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يُرِيدُ (16)
"যে কেউ এ ধারণা পোষণ করে যে, ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ তাকে (তাঁর নবীকে) কখনই সাহায্য করবেন না, (অথচ বাস্তবে সে প্রত্যক্ষ করে যে, আল্লাহ তাঁর নবীকে সাহায্য করেছেন এবং এতে সে রাগান্বিত হয়) তবে সে যেন একটি রজ্জুর সাহায্যে আকাশের দিকে অগ্রসর হয়, অতঃপর তা (তথা জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক) ছিন্ন করে, এরপর সে দেখুক যে, তার কৌশল সে বিষয়টি দূর করে কি না, যা তাকে ক্রোধান্বিত করেছে।" (২২:১৫)
"এরূপে আমরা তা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসহ এবং অবশ্যই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন।" (২২:১৬)
এই আয়াতে মহান আল্লাহ ইসলামের ক্রমবিকাশের ফলে কাফিরদের ক্ষোভ ও ক্রোধের কথা তুলে ধরেছেন। কারণ, তারা ভাবতে পারেনি যে আল্লাহ তাঁর নবীকে সাহায্য করায় ইসলাম এভাবে ছড়িয়ে পড়বে ও বিজয়ী হতে থাকবে। তাই তারা নানা উপায়ে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করছিল। আল্লাহ জবাবে বলছেন: তোমরা যদি খুবই ক্রুদ্ধ হয়ে থাক তাহলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে দেখতে পার, হয়তো এতে তোমাদের ক্রোধের উপশম হবে।
আসলে যারা হিংসুক তারা অন্যদের উন্নতি দেখে নিজের মৃত্যু কামনা করে বলে: হায় আমরা যদি না থাকতাম তাহলে আজ ওমুকের এই অবস্থা দেখতে হত না! মহান আল্লাহ ইসলাম বিরোধীদেরও একই দশার কথা উল্লেখ করছেন। তিনি তাদের বলছেন: ইসলামের সাফল্য ও অগ্রগতি সহ্য করতে না পারলে আত্মহত্যা করে নিজেকে শান্ত কর। কারণ, মুহাম্মাদ (সা.) যা জনগণের কাছে প্রচার করছেন তা হচ্ছে আল্লাহর স্পষ্ট নিদর্শন বা আয়াত। তাই যারা সত্যকে চায় ও সত্যকে মেনে নেয় তারা মুহাম্মাদ (সা.) দাওয়াতের সত্যতা বুঝতে পেরে তা গ্রহণ করছে ও ঈমান আনছে। অথচ সত্য বিরোধীরা বিশ্বনবী (সা.)'র দাওয়াতকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। আর এ ধরনের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সুপথ পায় না।
এ দুই আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:
১. আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবেলায় ক্ষুব্ধ না হয়ে তাঁর দয়া ও রহমতের প্রতি আশাবাদী হওয়া উচিত। কারণ, এটাই হল নাজাত বা মুক্তির পথ।
২. সুপথ দেখানো আল্লাহর কাজ। কুরআন সুপথ পাওয়ার মাধ্যম। তারাই কুরআন থেকে সুপথ পায় যাদের অন্তর আল্লাহর নুরে আলোকিত হয়েছে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন