বিশ্বনবী (সা.)’র হিজরত ও তাওওয়াবিন বিদ্রোহের বার্ষিকী

বিশ্বনবী (সা.)’র হিজরত ও তাওওয়াবিন বিদ্রোহের বার্ষিকী


ইরানে নির্মিত 'মুখতারনামা' ছায়াছবিতে সুলায়মানের চরিত্রে অভিনয়ের একটি দৃশ্য এবং ডানে 'সুউর' গুহার একটি বাস্তব দৃশ্য
আজ থেকে ১৪৩৫ চন্দ্র বছর আগে এই দিনে (পয়লা রবিউল আউয়াল) মক্কার কাফিররা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে মহান আল্লাহ তাকে ইয়াসরেব তথা মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন।

রাসূল (সা.) এই শহরে হিজরত করার কারণেই শহরটির নাম হয়েছে মাদিনাতুন্নাবী বা নবীর শহর এবং বর্তমানে তা মদীনা নামেই পরিচিত।

প্রথম রবিউল আউয়ালের রাতে বিশ্বনবী (সা.) তাঁর আপন চাচাতো ভাই হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-কে নিজের তথা রাসূল (সা.)’র বিছানায় শুয়ে থাকতে বলেন যাতে ওহী নাজেলের এই কেন্দ্রকে ঘিরে রাখা কাফির ঘাতকরা এটা মনে করে যে, শিকার এখনও নিজ ঘরেই রয়েছে; আর এই সুযোগে অচিহ্নিত অবস্থায় মক্কা ত্যাগ করতে সক্ষম হবেন।

যুবক আলী (আ.) অত্যন্ত আনন্দচিত্তে এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন নিজের জীবন ও অঙ্গহানির ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও।

ভোরবেলা কাফির ঘাতকরা যখন রাসূল (সা.)-কে হত্যা করতে উদ্যত হল তখন তারা সবিস্ময়ে দেখল: একি! মুহাম্মাদের (সা.) কম্বলের নিচ থেকে বের হয়ে এসেছে বীর আলী এবং খোদ মুহাম্মাদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

হতাশ হয়ে পড়া মক্কার কাফিররা ইমাম আলী (আ.)-কে মোকাবেলা করতে ভয় পেল এবং রাসূল (সা.)-কে খুঁজে বের করার জন্য চারদিকে লোক পাঠালো। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) ততক্ষণে আশ্রয় নিয়েছেন মক্কা থেকে বেশ দূরে অবস্থিত ‘সুউর’ নামক গিরি গুহায়।

একদল কাফির মুহাম্মাদ (সা.)’র পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে এই গুহার কাছে। কিন্তু যখন তারা এখানে আসে তখন দেখতে পায় যে গুহার মুখে রয়েছে মাকড়শার জাল এবং একটি পাখী বা কবুতর সেখানে ডিম পেড়েছে। এইসব দৃশ্য থেকে কাফিররা ভাবল যে খুব সম্প্রতি এখানে কেউ আসেনি এবং তারা হতাশ হয়ে চলে যায়। বিপদ কমে গেলে বিশ্বনবী (সা.) মদীনার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখেন।

এদিকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বনবী (সা.) বিছানায় শুয়ে থাকার জন্য আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)’র প্রশংসায় নাজেল হয় সুরা বাকারার এই আয়াত:

‘আর মানুষের মাঝে একজন রয়েছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজের জীবন বাজি রাখে। আল্লাহ হলেন তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান। (বাকারা: ২০৭)

হিজরতের পর মজলুম ইসলাম গতিশীল ও রাষ্ট্রধর্মের বাহক হয়ে ওঠে এবং মানব জাতির কাছে এই ধর্মের বিশ্বজনীনতা আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।

মহানবী (সা.)’র ওফাতের পর হযরত আলী (আ.)’র পরামর্শে এই মাস থেকেই ইসলামী পঞ্জিকা বা বর্ষক্রম চালু করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে জাহেলি যুগের মুশরিকদের সঙ্গে মিল রেখে পয়লা রবিউল আউয়ালের পরিবর্তে পয়লা মহররমকেই আরবি বছরের প্রথম দিন হিসেবে বহাল রাখে ক্ষমতাধর মহলের প্রধান। অথচ পয়লা রবিউল আউয়ালই ছিল হিজরতের ও হিজরি সনের প্রকৃত সূচনার তারিখ।

‘তাওওয়াবিন’দের বিদ্রোহ শুরু

আজ থেকে ১৩৭০ চন্দ্র বছর আগে এই দিনে (পয়লা রবিউল আউয়াল) ‘তাওওয়াবিন’ বা অনুতপ্তরা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র পবিত্র রক্তের বদলা নেয়ার জন্য বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন।

উমাইয়া রক্তপিপাসু শাসক ইয়াজিদের সেনারা খ্রিস্টিয় ৬৮০ সনে বা হিজরি ৬১ সনে কারবালার মরু প্রান্তরে নিষ্পাপ এই ইমামকে পিপাসার্ত রেখে শহীদ করে।

‘তাওওয়াবিন’ বা অনুতপ্তরা ছিল মূলত কুফা ও আশপাশের এলাকার অধিবাসী। তারাই বিশ্বনবী (সা.)’র নাতি ইমাম হুসাইন (আ.)-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইরাকে আসতে যাতে তিনি তাদেরকে জুলুমের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে পারেন। কিন্তু যখন ইয়াজিদ পাশবিকতার জন্য কুখ্যাত ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার শাসক নিয়োগ করে তখন ইমামের এই সমর্থকরা সংখ্যায় কয়েক হাজার (ইমামকে চিঠির মাধ্যমে আমন্ত্রণকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় লাখ খানেক) হওয়া সত্ত্বেও তারা ইমাম হুসাইন (আ.)-কে সমর্থন দেয়ার বা সাহায্য করার সাহস হারিয়ে ফেলেন। ফলে ইমাম হুসাইন ও নবী পরিবারের প্রায় ২০ জন সদস্যসহ ৭২ জন সঙ্গী শাহাদত বরণ করেন কারবালার অসম যুদ্ধক্ষেত্রে। ইমাম হুসাইন (আ.)’র ৬ মাসের শিশুও ছিল শহীদদের মধ্যে অন্যতম।

শহীদদের কর্তিত শির মুবারক বর্ষায় বিদ্ধ করে এবং নবী-পরিবারের নারী ও শিশুদেরকে যখন বন্দী করে পায়ে হাঁটিয়ে কুফা শহরে ঘোরানো হয় তখন ইমামকে আমন্ত্রণকারী এইসব কুফাবাসী গভীর শোকে মর্মাহত হন। তারাই ইয়াজিদের মৃত্যুর পর পরই কুফা থেকে ইবনে জিয়াদকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য বিদ্রোহ শুরু করেন।

আজকের এই দিনে ‘তাওওয়াবিন’ বা অনুতপ্তরা শহীদ ইমাম হুসাইন (আ.)’র মাজার জিয়ারত করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে কাফনের সাদা পোশাক পরে ‘হয় কারবালার ঘাতকদের নির্মূল করব অথবা এই লড়াইয়ে নিজের শহীদ হব’ বলে শপথ নেন। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার। বিশ্বনবী (সা.)’র ৯৩ বছর বয়স্ক সাহাবী সুলায়মান বিন সুরাদ আল খুজাই ‘তাওওয়াবিন’ বা অনুতপ্তদের নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন ট্রান্স-অক্সিয়ানা বা মধ্য-এশিয়ায় মুসলমানদের বিজয়ের অন্যতম স্থপতি।

‘তাওওয়াবিন’ বা অনুতপ্তরা সিরিয়া থেকে আসা সামরিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি সুসজ্জিত উমাইয়া সেনাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য পেলেও অবশেষে ‘তাওওয়াবিন’ বা অনুতপ্তদের বেশির ভাগ সদস্যই শহীদ হন। যারা বেঁচে ছিলেন তারা মহাবীর মুখতার সাকাফির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কারবালার ঘাতকদের নির্মূল করার আন্দোলনে যোগ দেন। মুখতারের এই আন্দোলন নবীর নাতির হত্যাকারী বা ঘাতকদের মধ্য থেকে ইবনে জিয়াদ, ওমর ইবনে সাদ, শিমার, হারমালা ও খুউলিসহ বেশিরভাগ ঘাতকদেরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছিল।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন