ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর জীবন বিবরণী
ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর জীবন বিবরণী
ইমামের জন্ম :
শিয়াদের ১১তম ইমাম হযরত ইমাম হাসান বিন আলী আসকারী (আলাইহিস সালাম), শেইখ কুলাইনী’র বর্ণনার ভিত্তিতে ২৩২ হিজরীর পবিত্র রমজান অথবা রবিউস সানী মাসের ৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। শাহাদাতের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৮ বছর। ইবনে খাল্লাকান বর্ণনা করেছেন ২৩১ হিজরীর কোন এক মাসের বৃহস্পতিবার তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এছাড়া তাঁর জন্মের বিষয়ে আরো একটি মত রয়েছে; তিনি ২৩২ হিজরী’র ৮ই রবিউস সানী জন্মগ্রহণ করেন। শেইখ মুফিদ ও সায়াদ বিন আব্দুল্লাহ্ রবিউস সানী মাস শীর্ষক মতটিকে গ্রহণ করেছেন। মাসউদী’র বর্ণনা অনুযায়ী শাহাদাতের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৯ বছর; অতএব, তার মতে ইমাম ২৩১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
অধিকাংশ রাভীদের (রেওয়ায়েত বর্ণনাকারী) বর্ণনার ভিত্তিতে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ২৬০ হিজরীর ৮ই রবিউল আওয়াল শহীদ হন। এছাড়া অপর একটি মতও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ২৬০ হিজরীর জমাদিউল আওয়াল মাসে শহীদ হয়েছিলেন।
যেহেতু ১০ম ইমাম হযরত হাদী (আ.) ২৫৪ হিজরীতে শহীদ হয়েছিলেন -এর ভিত্তিতে শেইখ মুফিদ (রহ.) এর রেওয়ায়েতে ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর ইমামতের সময়কাল ছিল ৬ বছর এবং সায়াদ বিন আব্দুল্লাহর মতে ৫ বছর ৮ মাস।
পিতা-মাতা : তাঁর সম্মানিত পিতা ছিলেন ১০ম ইমাম হযরত ইমাম হাদী (আ.)। তাঁর সম্মানিত মা’য়ের নামের বিষয়ে ভিন্ন মতামত রয়েছে। কিছু কিছু গ্রন্থে ‘হাদীস’ অথবা ‘হাদীসাহ’, আবার অন্য কিছু গ্রন্থে তার নাম ‘সুসান’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উয়ুনুল মু’জিযাত গ্রন্থে তার প্রকৃত নাম ‘সালিল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, উক্ত গ্রন্থে ((کانت من العارفات الصالحات)) বাক্যের মাধ্যমে তাঁর প্রশংসা করা হয়েছে।
উপাধীসমূহ : তাঁর জন্য ‘আল-সামেত’, ‘আল-হাদী’, ‘আল-রাফিক’, ‘আল-যাকী’ ও ‘আল-নাকী’ ইত্যাদি উপাধী উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু কিছু ঐতিহাসিক ‘আল-খালেস’কে তাঁর উপাধী তালিকায় সংযুক্ত করেছেন।
কুনিয়া : তাঁর কুনিয়াহ ছিল ‘ইবনুর রেজা’; ইমাম জাওয়াদ (আ.) ও ইমাম আসকারী (আ.) উভয়েই এ কুনিয়াহ’তেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। যেভাবে ইমাম হাদী এবং ইমাম আসকারী (আ.) ‘আসকারিয়াইন’ কুনিয়া’তে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।
ইমামের শারীরীক গঠন : আহমাদ বিন উবাইদুল্লাহ বিন খাকান তার বাহ্যিক গঠনকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি কালো চোখ, সুদর্শন, সুঠাম দেহ এবং মধ্যম উচ্চতার অধিকারী ছিলেন।
তাঁর ইমামতকাল
ইমাম হাদী (আ.) এর শাহাদাতের পর ২৫৪ হিজরীতে তাঁর নাসসের (ডিক্রি) ভিত্তিতে তাঁর সুযোগ্য পুত্র ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ১২ ইমামি শিয়াদের ইমাম হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। ইমাম হাদী (আ.) এর ওসিয়ত এবং তাঁর সন্তানের ইমামতের বিষয়ে যে সকল রেওয়ায়েত উল্লিখিত হয়েছে, তা শিয়াদের বহু ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয় এবং এ ওসিয়ত ও নাসসের ভিত্তিতে –যা শিয়াদের দৃষ্টিতে ইমামতের সঠিক হওয়ার অন্যতম নিদর্শন- শিয়ারা ইমাম হাসান আসকারী (আ.) কে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে।
সামেররা’তে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)
শেইখ মুফিদ (রহ.) এর ভাষ্য অনুযায়ী ১০ বছর ও কিছু সময় যাবত আসকার (সামেররা)-এ আব্বাসী খলিফাদের নজরবন্দী হয়ে জীবন-যাপন করেন। এ রেওয়াযেতের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয় যে, ইমাম (আ.) এর তাঁর সন্তানের সাথে সামেররা’তে ২৪৩ অথবা ২৪৪ হিজরীতে এসেছিলেন। কিন্তু ইবনে খাল্লাকানের ঐ সময়কে ২০ বছর ৯ মাস বলে উল্লেখ করেছেন। এ কারণেই ঐ দুই ইমাম আসকারিয়াইন নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।
এ বিষয়টি নিশ্চিত যে, ইমাম রেজা (আ.) কে নিজের শহরে আনার পেছনে মা’মুন যে উদ্দেশ্যে ছিল একই উদ্দেশ্যে এ দুই ইমাম (আলাইহিমাস সালাম) কে সামেররা –তত্কালীন আব্বাসীয় খলিফার শাসন কেন্দ্র- আনার পেছনে একই উদ্দেশ্য ছিল। কেননা ইমামের সাথে শিয়াদের সম্পর্ক এবং ইসলামি ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী ইমামের একান্ত ভক্ত ও হুকুমতের জন্য হুমকি এমন শিয়াদেরকে চিহ্নিত করণ ও তাদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এ কাজের মাধ্যমে সহজতর ছিল। যতদিন ইমাম (আ.) এ শহরে জীবন-যাপন করেছিলেন –কয়েক দফায় কারাবন্দী করে রাখার দিনগুলি ছাড়া- তিনি সাধারণ মানুষের ন্যায় সমাজে উপস্থিত ছিলেন এবং স্বভাবতই তাঁর সকল কর্ম ও আচরণ তত্কালীন শাসকের দৃষ্টির বাইরে ছিল না। কেননা ইমাম হাসান আসকারী (আ.)সহ অন্যান্য ইমামরা যদি পরিপূর্ণভাবে স্বাধিন থাকতেন তবে তাঁরা মদিনাকে জীবন-যাপনের জন্য বেছে নিতেন। এ কারণে ইমামের দীর্ঘ সময়ের জন্য সামেরাতে অবস্থান তত্কালীন খলিফা কর্তৃক তাকে গৃহবন্দী করে রাখা ছাড়া অন্য কোন ব্যাখ্যা এর পেছনে দাঁড় করানো যায় না। বিশেষভাবে শিয়াদের একটি সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক, যা অনেকদিন পূর্ব হতে সংগঠিত হয়েছিল খলিফার দৃষ্টিতে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে বিবেচিত হত এবং এ বিষয়ে খলিফা সন্ত্রস্ত ও উদ্বিগ্ন ছিল তাই সে যেকোনভাবে এর উপর নজরদারীর চেষ্টা চালায়।
এ কারণেই ইমামের উপর কড়া নির্দেশ ছিল যে, প্রায়শই যেন ইমামের উপস্থিতির বিষয়টি শাসকের সম্মুখে ঘোষণা করা হয়। ইমামের খাদেমদের একজনের বর্ণনামতে তিনি প্রতি শনি ও বৃহস্পতিবার দারুল খেলাফা’তে হাজিরা দিতে বাধ্য ছিলেন। যদিও এ ধরণের উপস্থিত প্রকাশ্যে তার জন্য সম্মান বলে মনে হত কিন্তু প্রকৃতঅর্থে এর মাধ্যমে খলিফা ইমামের উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত এবং তার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হত। এ বিষয়ে খলিফা এতটাই সতর্ক ছিল যে, একদা খলিফা সাহেবুল বাসরার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় ইমামকেও নিজের সাথে নিয়ে গিয়েছিল এবং ইমাম (আ.) এর সাহাবীরা তার যাত্রা পথে তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছিল। এ ঘটনা হতে স্পষ্ট হয়ে যায় ইমাম (আ.) এর সাহাবীদের ইমামের সাথে সাক্ষাতের জন্য ঐ সামান্য সময়টুকু পেয়েছিল এবং তাঁর সাথে তাঁর বাড়ীতে সরাসরী সাক্ষাত করা কখনই সম্ভব ছিল না।
ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ বলেন : কিছু অর্থ গ্রহণের জন্য তাঁর (আ.) আসার পথে অপেক্ষায় বসে রইলাম এবং তিনি অতিক্রম করার সময় তার নিকট হতে আর্থিক সহযোগিতা প্রার্থনা করেছিলাম।
আবু বাকর ফাহফাকী বলেন : একটি কাজে –ইমামের সাথে সাক্ষাতের জন্য- সামেররা ত্যাগ করলাম ‘মওকেবে’র দিন ইবনে কুতাইবাহ বিন দাউদ সড়কে ইমামের অপেক্ষায় বসে রইলাম যাতে তিনি দারুল আম্মাহ’র দিকে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে পারি।
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযিয বালখিও ইমামে দারুল আম্মাহ’র দিকে যাওয়ার সময় ‘আল-গানাম’ সড়কে তার সাথে সাক্ষাতের অপেক্ষায় ছিলেন।
মুহাম্মাদ বিন রাবী শাইবানী বলেন : ইমামের সাথে সাক্ষাতের জন্য আহমাদ বিন খুদ্বাইব ফটকে বসেছিলাম, তিনি উক্ত স্থান হতে অতিক্রম করার সময় তাঁকে দেখেছিলাম।
হালাবী হতে আলী বিন জাফার বর্ণনা করেছেন : ইমামের দারুল খেলাফাহ যাওয়ার জন্য নির্ধারিত দিনের কোন একটিতে আমরা আসকারে তার সাথে সাক্ষাতের আশায় অপেক্ষায় রইলাম, এমন সময় তাঁর পক্ষ হতে একটি চিঠি আমাদের নিকট এসে পৌঁছায়, তাতে লেখা ছিল :
ألّا یسلّمنّ علىّ أحد و لا یشیر إلىّ بیده و لا یؤمى فإنّكم لا تؤمنون على أنفسكم.
অনুবাদ : ‘তোমাদের মধ্যে হতে কেউ যেন আমাকে সালাম না করে, এমনকি আমার প্রতি ইশারাও করবে না, কেননা তোমরা (খলিফার অত্যাচার হতে) নিজেরাই নিরাপদ নও’।
এ রেওয়ায়েত হতে স্পষ্ট হয় যে, তত্কালীন শাসক কিভাবে ইমামের সাথে তাঁর অনুসারীদের যোগাযোগের বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করতো। অবশ্য ইমাম (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা বিভিন্ন সময় পরস্পরের সাথে সাক্ষাত ও যোগাযোগ করতেন এবং এ সকল সাক্ষাত ও যোগযোগ যাতে ফাঁশ না হয় সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হত। ইমামের সাথে শিয়াদের যোগাযোগে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথ ছিল চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে যোগাযোগ করা; বিভিন্ন গ্রন্থে এ সকল চিঠির কথা উল্লিখিত হয়েছে।
সামেররাতে ইমামের অবস্থান
যদিও ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ছিলেন অল্পবয়সী যুবক, তা সত্ত্বেও ইমামের ইলমি ও নৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশেষতঃ শিয়াদের নেতৃত্ব দান এবং ইমামের প্রতি তাদের বিশ্বাস ও তাঁর প্রতি জনগণের সম্মানের কারণে তিনি ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। যেহেতু তিনি সাধারণ জনগণ ও বিশেষ ব্যক্তিত্বদের সম্মানের পাত্র ছিলেন তাই আব্বাসী খলিফাও কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর সাথে সম্মানজনক ব্যবহার করেছে।
যে দীর্ঘ রেওয়ায়েত প্রায় সকল গ্রন্থেই তাঁর অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লিখিত হয়েছে, তা হতে সামেররাতে ইমামের মহত্ব ও গুরুত্ব দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐ রেওয়ায়েতের কিছু অংশ পাঠকদের জন্য উল্লেখ করা হল :
বিশিষ্ট শিয়া আলেম সায়াদ বিন আব্দুল্লাহ আশআরী –সম্ভবত তিন ইমাম (আ.) এর সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য তিনি অর্জন করেছেন- বলেন : ২২৮ হিজরী শাবান মাসের কোন একদিনে আমরা আহমাদ বিন উবাইদুল্লাহ বিন খাকানের –তখন সে কোমের রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বে ছিল এবং আহলে বাইত (আ.) এর সদস্য ও কোমের জনগণের সাথে সে ব্যাপক শত্রুতা পোষণ করত- সভায় বসেছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে সামেররাতে বসবাসকারী ‘তালিবিয়্যূন’দের [আবু তালিবের বংশধর] মাযহাব এবং শাসকের নিকট তাদের অবস্থানের কথা উঠলো। আহমাদ বললো : আমি আলাভিদের মধ্যে হাসান বিন আলী বিন আসকারী [আ.] এর ন্যায় কাউকে দেখেনি এবং শুনিনি, তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন সম্মানিত ও মার্জিত, সত, বিচক্ষণ, মহানুভব আর কেউ থাকতে পারে বলে আমার জানা নেই এবং তিনি শাসক ও বনি হাশিম উভয়েরই সম্মানের পাত্র। তাকে গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এমনকি আমির ও উজিরদের উপরও প্রাধান্য দেওয়া হত। একদা আমি আমার পিতার নিকট দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঐ দিন আমার পিতা জনগণের সাথে সাক্ষাতের জন্য বসেছিলেন। হাজ্বীদের একজন প্রবেশ করে বললেন : ইবনুর রেজা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পিতা উচুস্বরে বললেন তাকে প্রবেশের অনুমতি দাও এবং তিনি প্রবেশ করলেন... আমার পিতা তাকে দেখে কয়েক কদম এগিয়ে এসে এমন আচরণ করলেন যা আমি আগে কখনও তাকে করতে দেখিনি, এমনকি কোন আমির বা শাসকের সাথেও না, আমার পিতা তার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে তার চেহারা এবং কপালে চুম্বন করলেন। অতঃপর তার হাত ধরে নিজের আসনে বসালেন। অতঃপর আমার পিতা তাঁর সম্মুখে বসে তাঁর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। কথা বলার সময় তাঁকে তাঁর কুনিয়াহ ধরে সম্বোধন করছিলেন –কাউকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য এভাবে সম্বোধন করা হয়- এবং বারংবার বলছিলেন : আমার পিতা-মাতা আপনার উপর উত্সর্গ হোক।
রাতে আমি বাবার কাছে গেলাম... আজ আপনি যাকে এত সম্মান দেখালেন তিনি কে ছিলেন যে, আপনি নিজের পিতা-মাতাকেও তার উপর উত্সর্গ করলেন? তিনি বললেন : তিনি ছিলেন ইবনুর রেজা; রাফেজীদের ইমাম। অতঃপর তিনি নিরব হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে বললেন : যদি কখনও বনি আব্বাস হতে খেলাফত সরে বনি হাশিমের হাতে যায় তবে বনি হাশিমের মধ্যে এ কাজের জন্য তারচেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই। তিনি বদান্যতা, নফসের পবিত্রতা, দুনিয়াবিমূখতা, ইবাদত এবং উত্তম শিষ্টাচারের কারণে খেলাফতের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব রাখে। যদি তার পিতাকে দেখতে, সেও ছিল মহান, বিচক্ষণ, সতকর্মকারী এবং সুশিক্ষিত। এ কথা শোনার পর আমার সমস্ত অস্তিত্বে ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে চেনার কৌতুহল আমার মাঝে জেগে ওঠে। বনি হাশিমের যার কাছেই, গন্যমান্য ব্যক্তিত্বদের নিকট, বিচারকগণ, ফকীহগণ, এমনকি সাধারণ মানুষদের মধ্যে যার কাছেই জিজ্ঞেস করতাম তাঁকে তাদের নিকট মহানবুভব এবং আহলে বাইতের অপর সদস্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হিসেবে পেয়েছি। সকলেই বলতো : তিনি রাফেজীদের ইমাম। এরপর হতে আমি তাঁকে অধিক গুরুত্ব দিতাম। কেননা শত্রু ও বন্ধু নির্বিশেষে সকলেই তাঁর প্রশংসা করতো।
যেহেতু এ রেওয়ায়েতটির বর্ণনাকারী স্বয়ং আহলে বাইত (আ.) এর কঠোর শত্রু ছিল, তাই এমন ব্যক্তি হতে বর্ণিত রেওয়ায়েত হতে তত্কালীন যুগে সমাজের সাধারণ ও বিশেষ লোকের মাঝে ইমাম (আ.) এর নৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব।
ইমাম আসকারী (আ.) এর খাদেম বলেন : যেদিনগুলোতে ইমাম (আ.) খলিফার দরবারে (তার উপস্থিতির কথা জানান দিতে) যেতেন সে দিনগুলোত রাস্তাগুলোতে লোকারণ্যে ভরে যেত। ইমাম যখন আসতেন তখন হঠাত সকল চিত্কার-চেচামেচি, হৈহুল্লোড় থেমে যেত এবং তিনি (আ.) জনগণের মাঝ হতে খলিফার দরবারের প্রবেশ করতেন।
বিভিন্ন সওয়ারীতে আরোহন করে দাঁড়িয়ে থাকা এ সকল লোকরা হলেন ইমামের অনুসারী (শিয়া), তারা কাছ ও দূরের বিভিন্ন অঞ্চল হতে ইমামকে দেখার জন্য সামেররাতে আসতেন। অবশ্য আল্লাহর রাসূল (স.) এর সন্তানের প্রতি অন্যান্য মুসলমানদের অনুরাগের কারণে তারাও ইমাম (আ.) এর যাওয়ার পথে উপস্থিত হত এবং এতে ভীড় আরো বেড়ে যেত।
ইমাম (আ.) এর বন্দী থাকার দিনগুলি
যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল কর্তৃক ইমাম হাদী (আ.) ও ইমাম আসকারী (আ.) কে সামররাতে নিয়ে আসার অর্থ হচ্ছে তাদের উপর এবং তাদের অনুসারীদের সাথে তাদের যোগাযোগের উপর পরিপূর্ণ দৃষ্টি রাখা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিতা ও পুত্রের উপর যতদূর সম্ভব কঠোর আচরণ করা হত এবং যে সকল ঘটনায় শাসকগোষ্ঠি হুমকির সম্মুখীন হত সেসব ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপে ইমাম হাদী (আ.) এবং তাঁর পুত্র আসকারী (আ.) কে তাঁদের কিছু কিছু ঘনিষ্ট জনদের সাথীদের সাথে কারারুদ্ধ করা হত।
ইমাম আসকারী (আ.) কে কারাবন্দী করার বিষয়ে বহু রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে।
একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, মো’তায (২৫৫ হিজরীতে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত শাসক) কুফা সফরে যাওয়ার সময় ইমাম আসকারী (আ.) কে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয় এবং নির্দেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাঈদ বিন হাজেবের উপর। আবুল হাইসাম এ বিষয়ে নিজের উদ্বিগ্নতার কথা উল্লেখ করে ইমামকে লিখলে ইমাম তার জবাবে লেখেন : তিনদিন পর সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে; মো’তায নিহত হবে।
এটা নিশ্চিত যে, ইমাম আসকারী (আ.) মুহতাদী’র যুগে (২৫৫-২৫৬ হিজরী) কিছুদিনের জন্য কারাগারে ছিলেন, এরপূর্বে তাঁর কিছু অনুসারীকে কারারুদ্ধ করা হয়।
দাউদ বিন কাসেম ওরফে আবু হাশিম জাফারী –শিয়াদের মাঝে অন্যতম খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব- ২৫২ সালে কারাগারে ছিলেন। খতিব বাগদাদী, ইবনে আরাফা’র ভাষায় তার কারাবন্দী হওয়ার কারণ এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তার হতে এমন কিছু কথা শোনা গিয়েছিল যার কারণে তাকে আটক করা হয়। শেইখ তুসী হতে বর্ণিত রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আব্বাসীকে হত্যার দায়ে আবু হাশিমের সাথে বনি হাশেম কয়েকজনসহ অন্য কিছু লোককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কিছু কিছু রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ী এ কারাগারের রক্ষী ছিল সালেহ বিন ওয়াসীফ। সে ২৫৬ হিজরীতে মুসা বিন বাগা কর্তৃক নিহত হয়। এ কারণে এ সম্ভবণা রয়েছে যে, ২৫৫ হিজরীতে মোহতাদী’র যুগে ইমামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ইতিহাসে উল্লিখিত একটি বর্ণনায় আবু হাশিম জাফারী বলেছেন : মুহতাদী’র যুগে যখন কারাগারে ছিলাম তখন ইমাম আসকারী (আ.) কে কারাগারে আনা হয়। ২৫৬ হিজরীতে মুহতাদীর নিহত হওয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন। কেননা খলিফা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।
ইমাম (আ.) কে যেস্থানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেস্থানের নাম ছিল জুসাক। পরবর্তী ঐ স্থানে স্বয়ং মুহতাদী ও সালেহ বিন ওয়াসীফের মত লোকদেরকে বন্দী এবং হত্যা করা হয়। সম্ভবত জুসাক ছিল একটি দূর্গের নাম। যে দূর্গকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা হত।
এ কারাগারের অভ্যন্তর সম্পর্কে যা কিছু আমরা জানি তা হল :
(ক) ইমাম (আ.) কারাগারে প্রবেশ করে একজন অনারব লোকের দিকে ইশারা করে বলেন : যদি এ লোক না থাকতো তবে তোমাদেরকে বলে দিতাম যে কতদিন পর তোমরা মুক্তি পাবে। কেননা সে তোমাদেরকে চোখেচোখে রেখেছে এবং তোমাদের আচরণ ও কথাবার্তাকে খলিফার নিকট পৌঁছে দেয়। আবু হাশিম বলেন: একদিন আমরা ঐ লোকের অজ্ঞাতে তার পোশাকের মধ্য হতে আমাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে খলিফাকে দেওয়ার জন্য যে মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরী করেছিল সে কাগজ বের করলাম।
(খ) কারাগারে ইমামের আচরণ বিশেষতঃ কারারক্ষীদের সাথে তাঁর আচরণ এমন ছিল যে, অনেক সময় তাঁরা নিজেরাই লজ্জায় পড়ে যেত। এ ধরণের আচরণের দৃষ্টান্ত ইমাম কাযিম (আ.) এর ক্ষেত্রেও বর্ণিত হয়েছে। সালেহ বিন ওয়াসিফ –কারাগারে ইমামের উপর দৃষ্টি রাখার দায়িত্ব যার উপর ছিল- ছিল আব্বাসীয়দের একজন এবং ইমামের সাথে কঠোর আচরণ ও কষ্ট দেওয়ার জন্য বনি আব্বাসের গন্যমান্য ব্যক্তিত্বদের পক্ষ হতে তাকে উত্সাহিত করা হত, সে তাদের উত্তরে বলেছিল :
قد وكّلت به رجلین شرّ من قدرت علیه فقد صارا من العبادة و الصّلاه إلى أمر عظیم.
‘এমন দু’জন লোককে তার জন্য নিয়োগ দিয়েছি যারা জনগণের মধ্যে আমার জানা মতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি। কিন্তু তারা এমনভাবে আসকারী’র প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে যে, উভয়েই ইবাদত ও নামাযের বিষয়ে উঁচু স্তরে পৌঁছে গেছে’।
বিভিন্ন সনদের ভিত্তিতে ইমাম (আ.) কারাগারে প্রত্যহ রোজা রাখতেন।
মু’তামিদ আব্বাসী’র যুগে (শাসনকাল ২৫৬ হতে ২৭৯) দ্বিতীয়বারের মত ইমাম (আ.) কে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। অপর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি (আ.) ২৫৯ হিজরীতে মু’তামিদ আব্বাসী’র কারাগারে ছিলেন এবং আলী বিন জাররীন ঐ কারাগারের রক্ষী ছিল। ইমামের বিষয়ে মু’তামিদ তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করলে সে উত্তরে বলেছিল : তিনি সর্বদা দিনের বেলা রোজা রাখেন এবং রাতের বেলা নামায আদায় করেন।
একইভাবে সামিরী তার ‘আল-আওসিয়া’ গ্রন্থে মাহমুদী হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন : মু’তামিদের কারাগার থেকে আবু মুহাম্মাদ বিন আসকারী’র মুক্ত হওয়ার সময় আমি নিজেই তার হাতের লেখা পড়েছি, তিনি এ আয়াতটি লিখেছিলেন :
«یریدون لیطفئوا نور الله بأفواههم و الله متمّ نوره و لو كره الكافرون»
অনুবাদ : ‘তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ [সূরা আছ-ছফ : ৮]
শেইখ মুফিদ (রহ.) মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আলাউই হতে বর্ণনা করেছেন : ইমাম আসকারী (আ.) আলী বিন তামাশ (অথবা বারমাশ)-এর নিকট বন্দী ছিলেন। লোকটি ছিলো আবু তালিবের সন্তানদের কঠোর শত্রুদের একজন। তাকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন ইমামের বিষয়ে যথাসাধ্য কঠোর আচরণ করে। কিন্তু সে ইমাম (আ.) কে দেখার পর... যখন তার হতে পৃথক হলো তখন অন্যদের তুলনায় সে ইমামের অধিক প্রশংসা করতে লাগলো।
প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় ইমামের এ কারাগারা যাওয়ার ঘটনাটি ২৫৯ সালে ঘটেছিল এবং এ দাবীর পেছনে যে সাক্ষ্য রয়েছে সে সমৃদ্ধ রেওয়ায়েতটি হচ্ছে এরূপ:
কাশশি স্বীয় রেজাল গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন : মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম সামারকান্দী বলেছেন : হজ্বের পথে ছিলাম, এ সময় সিদ্ধান্ত নিলাম আমার বুদাক বুশানজানীর (হেরাতের অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রামের নাম বুশানজান) সাথে সাক্ষাত করবো। সত্যবাদীতা, শুভাকাঙ্খিতা, সত্কর্ম ইত্যাদি উত্কৃষ্ট গুণে সে ছিল বিখ্যাত। আমরা তার কাছেই ছিলাম এমন সময় ফাদ্বল বিন শাযানের কথা উঠলো, বুদাক বললে : সে পেটের –গ্যাসের- ব্যাথায় অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে... বুদাক আরো বললো : এক সফরে আমি হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কায় যাওয়ার সময় আমি মুহাম্মাদ বিন ঈসা আল-উবাইদীর নিকট –যে ছিল একজন নিষ্ঠাবান লোক- গেলাম। তার বাড়ীতে শোকাহত ও বিষন্ন একদল লোককে বসে থাকতে দেখলাম। আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো : আবু মুহাম্মাদ (আ.) কে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। আমি সফর অব্যাহত রাখলাম এবং ফেরার পথে পূনরায় মুহাম্মাদ বিন ঈসার সাথে সাক্ষাত করতে গেলাম। তাকে অত্যন্ত আনন্দিত দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তরে বললো : ইমাম (আ.) মুক্তি পেয়েছেন। আমি সামেররাতে গেলাম, এ সময় আমার কাছে ‘ইয়াওম ওয়া লাইলাহ’ (দিন ও রাত) বইটি ছিল এবং সেখানে আমি আবু মুহাম্মাদ (আ.) এর সমীপে উপস্থিত হলাম। ঐ বইটি তাঁকে দেখিয়ে বললাম : আপনার উপর উত্সর্গ হই, এ বইটি দেখুন। ইমাম বইটির পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলেন আর বলছিলেন ঠিক আছে। (সকলের) এর উপর আমল করা উচিত। আমি বললাম : ফাদ্বল অত্যন্ত অসুস্থ। আমি শুনেছি আপনার বদদোয়াতে সে এই অসুস্থতায় পড়েছে। কেননা তার সম্পর্কে আপনাকে বলা হয়েছে যে, সে ইব্রাহিমকে আল্লাহর রাসূল (স.) এর ওয়াসি’র উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আসলে সত্য বিষয়টি তা নয় এবং তার উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা হয়েছে। ইমাম (আ.) বললেন : হ্যাঁ ফাদ্বলের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। বুদাক বলেন : আমি ফিরে এসে বুঝতে পারলাম যে দিনগুলোতে ইমাম (আ.) বলতেন ‘ফাজলের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক’ সে দিনগুলিতে ফজল দুনিয়া হতে বিদায় নিয়েছিল।
যদি এটা মেনে নেই যে, ফাজল বিন শাযান ২৬০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেছিলেন, তখন স্বভাবতঃ এটা মেনে নিতে হবে যে, ইমাম (আ.) ২৫৯ হিজরী’র জিলহজ্ব মাসের পূর্বে কারারুদ্ধ ছিলেন।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন