নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৬তম পর্ব
নূরনবী মোস্তফা (সাঃ) ৩৬তম পর্ব
নবী-রাসূলগণের প্রধান দায়িত্ব ছিল মানব সমাজকে সত্য, সৌভাগ্য ও পরিপূর্ণতার দিকে পরিচালিত করা ৷ আর এ জন্যে তাঁদের আচার আচরণ ছিল মূলতঃ দয়া ও ভালোবাসার সর্বোত্তম নিদর্শন৷ বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন এক্ষেত্রে সবার শীর্ষে৷ রাসূল (সাঃ)'র ঘোর বিরোধীরাও তাঁর আন্তরিক দয়া ও ভালবাসার অমিয় ফল্গুধারায় সিক্ত হতো৷ তিনি যতটা সম্ভব শত্রুদের ভুল-ত্রুটি মার্জনা করতেন বা সেগুলো এড়িয়ে যেতেন৷ এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে বিরোধীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সাঃ)'র দয়া ও ভালোবাসার কি কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল? অন্য কথায় সে যুগের সমাজে বিরোধীদের মর্যাদা বা অবস্থান কি ছিল?
ইসলাম জোরজবরদস্তি বা কঠোরতার ধর্ম নয়৷ জনগণের সাথে নমনীয় আচরণ ইসলামের একটি মৌলিক বা জরুরী নীতি৷ মানুষের জন্যে পরিপূর্ণ আদর্শ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, সে-ই সবচেয়ে বুদ্ধিমান যে অন্যদের সাথে বেশী আপোস বা নমনীয় আচরণ করে৷
ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী মানুষের সাথে নমনীয় আচরণ বা নমনীয়তার অর্থ এই নয় যে মুসলমানরা ইসলামী বিধান ও দুনিয়ার বিষয়ে নিস্ক্রিয় থাকবে বা শৈথিল্য প্রদর্শন করবে৷ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সাঃ)কে ক্ষমাশীলতা ও আপোস করার পরামর্শ দিয়েছেন৷ কিন্তু অংশীবাদী ও মূর্তিপূজারীদের ভুল-ত্রুটি বা বিচ্যুতির ব্যাপারে রাসূল (সাঃ)কে বলা হয়েছে, হে নবী! আপনি বলুন, আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর এবাদত বা উপাসনা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে৷ অর্থাৎ ইসলামের মূল নীতিগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে শৈথিল্যের কোনো অবকাশ নেই এবং বাতিল বা ভুল চিন্তাধারার মোকাবেলায়ও নীরব থাকার কোনো সুযোগ নেই৷
অন্য কথায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র সাফল্যের রহস্য হলো, একদিকে নমনীয়তা ও অন্যদিকে দৃঢ়তা৷ রাসূলে পাক (সাঃ) ধর্মীয় গ্রন্থের অনুসারী হবার দাবীদারদের সাথে যতটা সম্ভব আলোচনায় বসতেন, কখনও কখনও তাদের সাথে চুক্তি করেছেন এবং তারাও যেন মুসলমানদের পাশে শান্তিতে বসবাস করতে পারে সে জন্যে চেষ্টা করেছেন৷ এভাবে তিনি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তার সাথে পারস্পরিক পরিচয় এবং এসব চিন্তা বা মতের বিকাশ ও পূর্ণতার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন৷ অমুসলমানরাও এসব চুক্তি ও ঐক্যের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল৷ কারণ শান্তি বা নিরাপত্তার পরিবেশ ছিল সমাজের সবার জন্যেই কল্যাণকর৷ পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ও উত্তেজনামূক্ত থাকায় অমুসলমানরা ইসলামকে সহজে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছিল ৷ আর মূলতঃ এ কারণেই তৎকালীন যুগে আরবের অমুসলমানদের অধিকাংশই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল৷
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বিরোধীদের কাছে ধর্মপ্রচারক কিংবা বিশেষ প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে, বা চিঠি পাঠিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময় এটা বুঝিয়ে দিতেন যে, ইসলাম যুক্তিতে ও সংলাপে বিশ্বাসী৷ জোরজবরদস্তি বা ভয় প্রদর্শন ইসলামের নীতি নয়৷ বারট্রান্ড রাসেল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আধুনিক যুগে সুন্দর আচরণ হিসেবে বিবেচিত কিছু কিছু নির্বাচিত গুণের কথা বলা হয়৷ অতীতে প্রাচ্যে এসব গুণের অধিকাংশেরই চর্চা হত৷ ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের উদারতা ও নমনীয় আচরণ, বিশেষ করে মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের এই উদারতা এবং খৃষ্টানদের সাথে মুসলমানদের আচরণ ছিল অত্যন্ত পৌরুষোচিত৷ ইসলামের নবীর আচরণ বা কর্মপন্থা ছিল উদারতাপূর্ণ বা নমনীয়৷ ইউরোপের মধ্যযুগের কাপুরুষোচিত রীতির বিপরীতে তিনি ভিন্ন মত বা ভিন্ন চিন্তা দমনের জন্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সৃষ্টি করেন নি, কিংবা ঐসব প্রতিষ্ঠানের মতো নির্যাতন ক্যাম্প বা কারাপ্রকোষ্ঠও গড়েন নি৷
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম বা অনুসারীবৃন্দ ১৩ বছর ধরে মক্কার লোকদের জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছেন, কিন্তু তাঁরা কখনও এর প্রতিশোধ নেননি৷ মদীনাসহ বিভিন্ন স্থানে জাহেলী আচরণে অভ্যস্ত আরবের মানুষকে সুশিক্ষার আলো দেয়ার জন্যে রাসূলে পাক (সাঃ)'র মনোনীত ধর্ম প্রচারকরা পবিত্র কোরআনের বাণী প্রচার করতেন৷ আর কোরআনের বাণী মানুষের চরিত্র পরিবর্তনে অসাধারণ ভূমিকা রাখতো৷ বলা হয়ে থাকে যে মদীনা জয় করা হয়েছিল পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে ৷ একবার এক ইহুদি যুবক বিশ্বনবী (সাঃ)'র কঠোর বিরোধীদের উস্কানীতে প্রভাবিত হয়ে আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে এমন ফেতনা সৃষ্টি করে যে তাতে এই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাবার উপক্রম হয়৷ কিন্তু রাসূলে পাক (সাঃ)'র পরামর্শ ও হস্তক্ষেপে ঐ বিরোধের অবসান ঘটে৷ তিনি এই ফেতনা সৃষ্টিতে ঐ ইহুদি যুবকের ভূমিকার কথা জানা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি৷
বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁর অনেক জানী দূষমন বা ইসলামের ঘোরতম শত্রুকেও অনুতপ্ত বা ক্ষমাপ্রার্থী হবার কারণে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন৷ তবে ইসলাম বিরোধীদের তৎপরতা যখন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছতো ও ইসলামী রাষ্ট্র মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হতো তখন তা মোকাবেলা করা ছাড়া রাসূল (সাঃ)'র জন্যে অন্য কোন পথ খোলা থাকতো না৷ ইসলামের মূল ভিত্তি যখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতো তখন তিনি কোনো অবস্থাতেই নমনীয়তা বা শৈথিল্য দেখাতেন না ৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, জুলুমের মোকাবেলা, শির্ক, খোদাদ্রোহীতা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের মোকাবেলায় ছিলেন অসাধারণ মাত্রায় কঠোর৷ তাঁর দৃষ্টিতে আল্লাহর বিধানই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পাবার যোগ্য৷ আর এভাবেই সব মানুষের অধিকার ন্যায়সঙ্গতভাবে রক্ষা করা সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন৷ তিনি কখনও এ নীতির অন্যথা করেন নি৷ যেমন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা বায়তুল মালের আত্মসাৎকারীর ব্যাপারে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন, বা যারা সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্ন করেছিল তাদের সাথেও তিনি কঠোর আচরণ করেছেন ৷
পবিত্র কোরআনের ভাষায় বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন সারা বিশ্বের জন্যে রহমত ও বরকতের উৎস৷ রাসূল (সাঃ)'র ক্ষমা ও দয়ার বহু দৃষ্টান্ত মানবতার ইতিহাসে ত্যাগ ও মহানুভবতার প্রজ্জ্বোল আলোকবর্তিকা হয়ে আছে৷ এবার এমনই এক ঘটনা শোনা যাক৷
মক্কা বিজয়ের পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন৷ তা সত্ত্বেও ইসলামের অন্যতম ঘোর শত্রু আবু জাহেলের পুত্র আকরামা প্রাণভয়ে ইয়েমেনের দিকে পালিয়ে যান৷ আকরামার স্ত্রী উম্মে হাকিম ছিল বেশ বুদ্ধিমতি ও সচেতন৷ মক্কা বিজয়ের প্রথম দিকেই মুসলমান হয়ে উম্মে হাকিম তার স্বামীর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে রাসূল (সাঃ)'র কাছে যায়৷ দয়ার নবীর দয়াদ্র দৃষ্টি ও শান্ত বা মৃদৃ ভাষণ উম্মে হাকিমকে আশান্বিত করে তুললো৷ সে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমার স্বামী আকরামা প্রাণভয়ে ইয়েমেনের দিকে পালিয়ে গেছেন, আমি আপনার কাছে তার নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি যাতে সে মক্কায় ফিরে আসতে পারে এবং তার অতীত কাজের ক্ষতিপূরণ করতে পারে৷
ক্ষমা ও মহানুভবতার প্রতিচছবি রাসূল (সাঃ) এই নিরাশ্রয় মহিলার আবেদন মঞ্জুর করে তাকে নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন ৷ রাসূলে খোদা(সাঃ)র কাছ থেকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পেয়ে উম্মে হাকিম তার স্বামীর কাছে ছুটে গেল৷ আকরামা তখন সাগর পথে ইয়েমেনে পালিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচিছল৷ উম্মে হাকিম তাকে বললো, আকরামা, তুমি তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন কর৷ আমি এমন এক ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছি যিনি সবচেয়ে উত্তম ও আদর্শ মানুষ৷ তুমি তাঁর সম্পর্কে তড়িঘড়ি বিচারবিবেচনা করেছ৷ মুহাম্মাদ (সাঃ) ভদ্রতম ব্যক্তি৷ তিনি অন্য সবার চেয়ে বেশী বিশ্বস্ত৷ আমি তাঁর কাছ থেকে তোমার জন্যে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায় করেছি৷
স্ত্রীর কথা শুনে আকরামার পা যেন নিশ্চল হয়ে পড়লো৷ সে বসে পড়লো৷ তার স্ত্রী আরো বললো, আকরামা, মুহাম্মাদ (সাঃ) যুদ্ধের জন্যে আসেননি, তিনি শান্তি ও প্রীতির বাণীবাহক৷ তিনি ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে থেকেও তাঁর সমস্ত শত্রুকে ক্ষমা করে দিয়েছেন ও তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছেন ৷ তাঁর চেয়েও মহানুভব কেউ কি আছে? মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন যে শুধু এক আল্লাহর এবাদত কর, পরস্পর যুদ্ধ করো না, আমানতগুলো রক্ষা করো এবং একে অপরকে ভালোবাস৷ এসব কথা কি আমাদের মুক্তির রক্ষাকবচ নয়?
স্ত্রী উম্মে হাকিমের এসব কথা শুনে আবু জাহেলের পুত্র আকরামার প্রাণ জুড়িয়ে গেল৷ সে স্ত্রীর সাথে মক্কায় ফিরে এল৷ মক্কায় সে রাসূলে খোদা (সাঃ)'র কাছে হাজির হলো অত্যন্ত অনুতপ্ত অবস্থায়৷ বিশ্বনবী (সাঃ)'র দয়াদ্র ও চিত্তাকর্ষক চেহারা তাকে আকৃষ্ট করলো৷ অমন প্রবল প্রতাপান্বিত ক্ষমতায় থেকেও কেউ যে এতটা দয়াদ্র ও বিনম্র হতে পারে তা আকরামার জানা ছিল না৷ আকরামা রাসূল (সাঃ)কে বললো, আমার স্ত্রী আমাকে জানিয়েছে যে আপনি আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন৷ রাসূল (সাঃ) বললেন, সে সত্যই বলেছে৷ তুমি নিরাপদ৷ এ কথা শুনে মহাবিস্মিত আকরামার স্মৃতিপটে রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের ওপর তার পিতা আবু জাহেলের ভয়ানক অত্যাচারগুলোর দৃশ্য জেগে উঠলো৷ সে মনে মনে ভাবলো, রাসূল (সাঃ) ক্ষমতার এই শীর্ষ পর্যায়ে থেকে ইচেছ করলে তার কাছ থেকেই তারা পিতার অত্যাচারগুলোর বদলা নিতে পারেন৷ কিন্তু রাসূল (সাঃ)'র দয়াদ্র আচরণ দেখে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো এবং রাসূল (সাঃ) তার পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন৷
বিমুগ্ধ আকরামা বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে যে কোনো আদেশ বা উপদেশ দিন, আমি তা পালন করবো৷ দয়ার নবী বললেন, অঙ্গীকার কর যে আল্লাহর পথে সেবা ও জিহাদ করবে৷ আকরামা জবাবে বললো, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! শির্ক ও মূর্তিপূজার পেছনে যতটা ব্যায় করেছি ইসলামের অগ্রগতির জন্যে তার চেয়ে দ্বিগুণ পেশ করবো৷
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন