'সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যাকেও বলে মানবতার সেবা!'
'সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যাকেও বলে মানবতার সেবা!'
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিভিন্ন সময়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নানা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অন্যতম স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হল নিজেদের অন্য সবার চেয়ে বড় করে দেখে এইসব শক্তি। তাই তারা কারো সমালোচনাকে গ্রহণ করে না বা গুরুত্ব দেয় না। সাম্রাজ্যবাদী ও দাম্ভিক শক্তিগুলো অন্যদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে অভ্যস্ত এবং অন্যদের যে কোনো ব্যাপারে নির্দেশ ও উপদেশ খয়রাত দিতে ব্যস্ত থাকে। তারা মনে করে যে, আমরা যা বলি তা নির্দ্বিধায় সবাইকে মেনে নিতে হবে। বর্তমান যুগে এইসব চরিত্রের সবচেয়ে বড় ও স্পষ্টতম দৃষ্টান্ত হল, মার্কিন সরকার। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: "সাম্রাজ্যবাদী বা দাম্ভিক শক্তি নিজেকে অন্য সবার চেয়ে ও অন্য সব দেশ বা জাতির চেয়ে বড় মনে করে। এটাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের মূল ভিত্তি ও তার সবচেয়ে বড় সমস্যা। "
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে মার্কিন সরকার নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান কেন্দ্র বলে মনে করে। তাদের এই ভুল ধারণা জন্ম দিয়েছে বিপজ্জনক বিশ্ব-সমীকরণ। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: "মার্কিন সরকারের কর্মকর্তারা এমনভাবে কথা বলেন মনে হয় যেন বিশ্বের সব দেশ তাদেরই রাজ্য মাত্র। … তারা দখলদার ইসরাইল সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলেন যে মনে হয় এ অঞ্চলের জাতিগুলোর জন্য অবৈধভাবে চাপিয়ে দেয়া এই রাষ্ট্রটিকে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মার্কিন সরকারের কর্মকর্তারা স্বাধীন জাতিগুলো ও সরকারগুলোর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেন যে মনে হয় যেন তাদের বেঁচে থাকারই কোনো অধিকার নেই।"
অভিশপ্ত শয়তান বা ইবলিসও নিজেকে সবার চেয়ে বড় মনে করত। সে নিজেকে এত বড় মনে করত যে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতেও তার কোনো দ্বিধা হয়নি। আর এ জন্য তার পতন ঘটে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মনে করেন পবিত্র কুরআনের আলোকে নিজেকে বড় ভাবার কারণেই মানুষ সত্যকে মেনে নেয় না এবং একই কারণে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সত্যের চরম বিরোধী। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: "আমেরিকার কানে সত্যের বাণী পৌঁছানো হচ্ছে, কিন্তু মার্কিন সরকার সত্যকে গ্রহণ করছে না। এটা তার অন্যতম স্বভাব। মার্কিন সরকার জাতিগুলোর অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয় না। জাতিগুলো যে নির্বাচনের অধিকার রাখে, যে ধরনের পরিবর্তন তারা চায়, যে ধরনের অর্থনীতি তারা চায় ও যে ধরনের নীতিমালা তারা গ্রহণ করতে চায়- সেই অধিকারগুলোকে আমেরিকার মেনে নেয় না, বরং এই সরকার জাতিগুলোর ওপর নিজের ইচ্ছে ও সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়।"
ফেরাউন ও তার মত শাসকরা খুব সহজেই মানুষের জীবন ও প্রাণ হরণ করত। আমেরিকার মত উপনিবেশবাদী ও দাম্ভিক শক্তি বা সাম্রাজ্যবাদীরা এখন সেই একই কাজ করছে। জুলুম করাকে তারা বৈধ বলে মনে করে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর দৃষ্টিতে এটা আধুনিক যুগের এক বড় সংকট। মার্কিন সরকার নিজেকে বিশ্বের প্রভু বলে মনে করে। যে দেশ বা জাতি বা জনগোষ্ঠী এই সরকারের দাবিগুলো বা নির্দেশের কাছে নতি স্বীকার করবে না সেই জাতিকে নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত করে হোয়াইট হাউজ। এ প্রসঙ্গে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ও রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর উপনিবেশবাদী মার্কিন ইংরেজদের এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ওপর ইংরেজদের গণহত্যাগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যায়।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় অধিবাসীদেরকে এমনভাবে হত্যা করত যেভাবে হত্যা করা হয় শিকারির হাতে ক্যাঙ্গারুর মত পশুকে আমোদ-ফুর্তির মাধ্যম হিসেবে। মানুষের জীবনের কোনো গুরুত্বই তাদের কাছে ছিল না। আমেরিকানরা জাপানের দু'টি শহরকে পরমাণু বোমা মেরে ধ্বংস করে দিয়েছে, ফলে হতাহত হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ এবং আরো কয়েকগুণ মানুষ সেই থেকে আজ পর্যন্ত পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে পঙ্গুত্বসহ নানা ধরনের রোগের শিকার হয়েছেন। আজো সেইসব সমস্যা রয়ে গেছে। আর এইসব হত্যাযজ্ঞ বা গণহত্যার পেছনে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তিও কখনও দেখাতে পারেনি আমেরিকা।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন: "বিশ্বে এ পর্যন্ত দুই বার পরমাণু বোমা ব্যবহৃত হয়েছে। আর প্রতিবারই তা ব্যবহৃত হয়েছে মার্কিন সরকারের মাধ্যমে। অথচ এই মার্কিন সরকারই নিজেকে বিশ্বের পরমাণু বিষয়ের অভিভাবক বলে মনে করে।"
আর এ ধরনের মনোভাব নিয়েই আমেরিকা তার হাতগুলোকে রঞ্জিত করেছে ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের রক্তে। গুয়ান্তানামো ও আবু গারিব কারাগারেও যেসব ঘৃণ্য নির্যাতন করেছে মার্কিন সেনারা তা বিশ্বের মানুষ কখনও ভুলবে না।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদীদের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল নিরপরাধ মানুষকে দাসে পরিণত করা। তিনি এ প্রসঙ্গে আফ্রিকার কৃষ্ণকায় মানুষের ওপর মার্কিনীদের জুলুমের ইতিহাস তুলে ধরে বলেছেন:
"আফ্রিকান মানুষদেরকে অপহরণ ও বন্দী করা ছিল অশ্রু-উদ্দীপক বা লোমহর্ষক ইতিহাস। মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী সরকাররা চায় না এ ধরনের ইতিহাস তুলে ধরা হোক। মার্কিন সরকার আটলান্টিক মহাসাগর থেকে অনেক জাহাজ বা বড় নৌকা এনে সেগুলোকে পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়া ও এ ধরনের অঞ্চলে ভিড়িয়ে রাখত। এরপর তারা বন্দুকসহ যেসব অস্ত্র এ অঞ্চলের জনগণের হাতে ছিল না সেইসব অস্ত্রের মুখে শত শত ও হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বন্দীকে অত্যন্ত কষ্টকর অবস্থার মধ্য দিয়ে আমেরিকায় নিয়ে যেত। এভাবে তারা স্বাধীন মানুষদেরকে বন্দী করত। আজ আমেরিকায় যারা কৃষ্ণকায় তারা এদেরই বংশধর। আর এখনও আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা বর্ণ-বৈষম্যের শিকার হয়ে আছে।"
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদীদের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল জাতিগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের নিকৃষ্টতম অপরাধ ও অমানবিক আচরণগুলোকে সুন্দর বলে প্রচার করা বা তুলে ধরা। গণমাধ্যম ও অর্থের জোরে তারা এ কাজটি করছে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
মার্কিন সরকার বলে, যদি পরমাণু বোমা ব্যবহার করে জাপানের দুটি শহরের দুই লাখ মানুষকে হত্যা করা না হত তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলতেই থাকত এবং বিশ্বে আরো বিশ লাখ মানুষ নিহত হত। এভাবে পরমাণু বোমা ব্যবহার করে মার্কিন সরকার নাকি মানবতার সেবাই করেছে। এটা হচ্ছে সবচেয়ে প্রতারণাময় ও অদ্ভুত মিথ্যাচার। অথচ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রধান স্তম্ভ হিটলার জাপানে পরমাণু বোমা বর্ষণের কয়েক মাস আগেই আত্মহত্যা করেছিলেন বলে তথ্য ও প্রমাণ রয়েছে। আর জাপানে ওই হামলার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক বড় হোতা ইতালির মুসোলিনিও বন্দী হয়েছিলেন এবং জাপানিরাও দুই মাস আগে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছিল। অর্থাত কোনো যুদ্ধই ছিল না। তবুও আমেরিকা ওই দুটি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। আসলে আমেরিকা তাদের এই নতুন অস্ত্রকে বাস্তব ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করতে চেয়েছিল, ফলে নিহত হয় হিরোশিমা ও নাগাসাকির লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষ। অথচ ইতিহাসের নৃশংসতম এই গণহত্যাকে এখন মানবতার সেবা বলে প্রচার করছে মার্কিন সরকার!!
নবী-রাসূলরা যেমন জালিমদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন তেমনি ইরানের ইসলামী রাষ্ট্রও সাম্রাজ্যাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই অগ্রগতি অর্জন করছে। তাই সাম্রাজ্যবাদীদের ভালভাবে মোকাবেলার জন্য তাদের চরিত্রগুলোকে জানা জরুরি বলে মনে করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। কারণ, একমাত্র শক্তিমত্তা, দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই স্বাধীন জাতিগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের পরাজিত করতে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেন।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন