সূরা মারিয়াম; আয়াত ৭৫-৮০

সূরা মারিয়াম; আয়াত ৭৫-৮০

 

সূরা মারিয়াম; আয়াত ৭৫-৮০


সূরায়ে মারিয়ামের ৭৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ مَنْ كَانَ فِي الضَّلَالَةِ فَلْيَمْدُدْ لَهُ الرَّحْمَنُ مَدًّا حَتَّى إِذَا رَأَوْا مَا يُوعَدُونَ إِمَّا الْعَذَابَ وَإِمَّا السَّاعَةَ فَسَيَعْلَمُونَ مَنْ هُوَ شَرٌّ مَكَانًا وَأَضْعَفُ جُنْدًا (75)
“(হে নবী!) এদেরকে বলুন,যে ব্যক্তি গোমরাহীতে লিপ্ত হয় করুণাময় আল্লাহ তাকে অল্প সময়ের জন্যে অবকাশ বা সুযোগ দিয়ে থাকেন প্রতিশ্রুত শাস্তি নিজের চোখে দেখার আগ পর্যন্ত। সেই শাস্তি হতে পারে পার্থিব এই জগতের আযাব কিংবা কিয়ামতের আযাব। (যখনই হোক) তখনই তারা জানতে পারবে,কার অবস্থান খারাপ এবং কার সেনাদল অক্ষম এবং দুর্বল!” (১৯:৭৫)

আগের আসরে আমরা বলেছিলাম মক্কার অভিজাত এবং সম্পদশালীরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে প্রশ্ন করতোঃ আমাদের অবস্থান ও মর্যাদা উর্ধ্বে নাকি ঐ অধম ফকির মুমিনদের অবস্থান উর্ধ্বে? এই প্রশ্নের জবাবে চলমান আয়াতে বলা হয়েছেঃ এটা আল্লাহর একটা ঐতিহ্যবাহী নীতি যে পৃথিবীতে সবার জন্যেই উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্র দিয়ে দিয়েছেন। ভালো মানুষই হোক কিংবা খারাপ-সবাই সেই সুযোগ পায়। আল্লাহর এই দয়া ও অনুগ্রহ পেয়ে কারো অহংকারী হয়ে ওঠা ঠিক নয়। আর এটাও ভাবা উচিত হবে না যে আল্লাহর এই নিয়ামত সবসময়ের জন্যেই অব্যাহত থাকবে। বরং যে বা যারাই জুলুম করবে, কুফরি করবে তারা এই পৃথিবীতেই হোক কিংবা পরকালেই হোক তার শাস্তি ভোগ করবে। কেবল তখনই প্রমাণিত হবে কাদের অবস্থান উর্ধ্বে-তোমাদের নাকি ফকির মুমিনদের!

আল্লাহ সবাইকেই সুযোগ দেন এমনকি গোমরাহ বা বিপথগামী যারা তাদেরকেও সুযোগ দেন এজন্যে যে, হয়তোবা তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসবে-দয়াময় আল্লাহর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিচ্যুতি আর গোমরাহিতে যারা নিমজ্জিত রয়েছে তারা সাধারণত আল্লাহর দেওয়া এই সুযোগের অপব্যবহার করে থাকে। তারা তাদের অযথার্থ ও অসমীচীন আচরণের মাধ্যমে নিজেদের জন্যে কঠোর শাস্তি ডেকে আনে।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. আল্লাহর নীতি সবার জন্যে সমান। তিনি সকলকেই সমান সুযোগ দেন। যে যার ইচ্ছেমতো নিজের পথ বেছে নেয়। সে অনুযায়ী নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের ফল সবাই ভোগ করবে।
২. ঐশী শাস্তি কেবল আখেরাতের জন্যেই নির্ধারিত নয়। পৃথিবীতেও-যতোটুকু শাস্তি দেওয়ার মতো-ততোটুকু শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে।

সূরা মারিয়ামের ৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَيَزِيدُ اللَّهُ الَّذِينَ اهْتَدَوْا هُدًى وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ مَرَدًّا (76)
“(কিন্তু) যারা সত্য-সঠিক পথ অবলম্বন করেছে আল্লাহ তাদেরকে সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে উন্নতি দান করেন এবং স্থায়িত্বলাভকারী সৎকাজগুলোই তোমার রবের কাছে ঐশী প্রতিদান ও আখেরাতের পরিণামের দিক দিয়ে অধিকতর উত্তম।” (১৯:৭৬)

আগের আয়াত থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, বিপথগামীরা তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আরো বেশি গোমরাহি আর বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত হয়। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের শাস্তির পরিমাণও বেড়ে যায়। এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ যারা আল্লাহর প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয় আল্লাহ তাদের প্রতি অনুগ্রহ দেখান এবং জীবন চলার পথে বিচ্যুতি ও গোমরাহির থেকে সুরক্ষা করেন। অন্যভাবে বলা যায় আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের হেদায়েতের মাত্রা বেড়ে যায়। এটা অনেকটা উপরে ওঠার সিঁড়ির মতো। একটা সিঁড়ি অতিক্রম করার সাথে সাথে পরের সিঁড়িটি এসে যায়, এভাবে একের পর এক সিঁড়ি অতিক্রমের মধ্য দিয়ে উপরের দিকে যেতে থাকে মানুষ।

মানুষের ঈমান বৃদ্ধি করে নেক কাজ বা সৎ কর্ম। ব্যক্তির নিয়্যৎ যতো বেশি একনিষ্ঠ ও আন্তরিক হবে তার পূণ্য কাজগুলো ততো বেশি দৃঢ় ও স্থায়ী হবে। এটা তো সবার কাছেই স্পষ্ট যে পূণ্য কাজই অন্য সব সম্পদ থেকে উত্তম। আসলে সৎ কাজের সাথে অন্য কোনো সম্পদেরই তুলনা হয় না। কেননা দুনিয়ার সম্পদ ক্ষণস্থায়ী এবং ধ্বংসময়। কিন্তু ভালো ও পূণ্য কাজ নিজেই যেমন স্থায়ী তেমনি তার পরকালীন পুরস্কারও।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. আল্লাহর হেদায়াতের শ্রেণী এবং স্তর বিন্যাস রয়েছে। সৎ কর্মই আল্লাহর হেদায়াত লাভের ক্ষেত্র প্রশস্ত করে।
২. পূণ্য ফল লাভ পূণ্য কাজের ওপরই নির্ভরশীল, ধন-সম্পদের প্রাচুর্য কিংবা অন্য কিছুর ওপরে নয়।

সূরা মারিয়ামের ৭৭ থেকে ৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآَيَاتِنَا وَقَالَ لَأُوتَيَنَّ مَالًا وَوَلَدًا (77) أَطَّلَعَ الْغَيْبَ أَمِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا (78) كَلَّا سَنَكْتُبُ مَا يَقُولُ وَنَمُدُّ لَهُ مِنَ الْعَذَابِ مَدًّا (79) وَنَرِثُهُ مَا يَقُولُ وَيَأْتِينَا فَرْدًا (80)
“তারপর তুমি কি দেখেছো সে লোককে যে আমাদের আয়াতসমূহ মেনে নিতে অস্বীকার করে বলেছিলঃ প্রচুর ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আমার ভাগ্যে জুটবেই।” (১৯:৭৭)
“আচ্ছা! সে কি গায়েবের খবর জেনে গেছে নাকি সে রাহমানুর রাহিম আল্লাহর কাছ থেকে থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়ে রেখেছে?” (১৯:৭৮)
“কক্ষনো নয়,শীঘ্রই সে যা কিছু বলছে তা আমি লিখে নেব তার নিজস্ব আমলনামায় এবং তার জন্য আযাবের পসরা আরো বাড়িয়ে দেব৷” (১৯:৭৯)
“সে ধন-সম্পদ আর জনবল সম্পর্কে যেসব কথা বলছে তার সবই আমার কাছে থেকে যাবে এবং সে একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় আমার সামনে হাযির হয়ে যাবে।” (১৯:৮০)

আগের আয়াতে বিপথগামী এবং হেদায়েতপ্রাপ্তদের তুলনামূলক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে পার্থিব পূজারি এবং কাফেরদের কল্পনা প্রসূত চিন্তাধারার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ তারা এমন ভাষায় কথা বলে এবং এমন আচরণ করে মনে হয় যেন তারা এই বিশ্বের মালিক এবং শাসক। তাই তারা যা চাইবে আল্লাহর কাছে-ধন-সম্পদ, শক্তি ক্ষমতা, খ্যাতি ইত্যাদি-আল্লাহ যেন তাদেরকে সব দিতে বাধ্য। মজার ব্যাপার হল- এই মানসিকতা থেকেই তারা মুমিনদের ওপর অহংকার দেখিয়ে বলে-তারাই শ্রেষ্ঠ। কুরআন তাদের এই চিন্তার ব্যাপারে বলেছেঃ তাই এই বিশ্বাস এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে যে মন্তব্য করছে, এটা এক ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো ব্যাপার। তো ভবিষ্যতের অজানা বিষয়ে তারা কী করে জানল! তাদের সাথে কি আল্লাহ কোনো চুক্তিতে বা সন্ধিতে আবদ্ধ হয়েছেন? অথচ তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে এমন কঠিন শাস্তি যা তাদের দুনিয়া এবং আখেরাত দুটোই ধ্বংস করে দেবে। তারা যেসব সম্পদ জমিয়েছে সেগুলো রেখে যাবে এবং সম্পূর্ণ খালি হাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. কাফেরদের দৃষ্টিতে কুফরি হল উন্নতির চাবিকাঠি আর ঈমান হল উন্নতির পথে অন্তরায়। অথচ এ ধরনের কোনো যুক্তি বিশ্বের কোথাও নেই আর আল্লাহ এ ধরনের কোনো সুন্নাতই প্রতিষ্ঠিত করেন নি।
২. আমাদের সকল কথা এবং কাজ রেকর্ড হয়ে যায় এবং একদিন আমাদের সকল কাজের জবাবদিহি করতে হবে।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন