সূরা মারিয়াম; আয়াত ৬১-৬৫

সূরা মারিয়াম; আয়াত ৬১-৬৫


সূরা মারিয়ামের ৬১ থেকে ৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدَ الرَّحْمَنُ عِبَادَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّهُ كَانَ وَعْدُهُ مَأْتِيًّا (61) لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا إِلَّا سَلَامًا وَلَهُمْ رِزْقُهُمْ فِيهَا بُكْرَةً وَعَشِيًّا (62) تِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي نُورِثُ مِنْ عِبَادِنَا مَنْ كَانَ تَقِيًّا (63)
“তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার প্রতিশ্রুতি করুণাময় (আল্লাহ) নিজের বান্দাদের কাছে অদৃশ্য পন্থায় দিয়ে রেখেছেন। আর অবশ্যই এ প্রতিশ্রুতি পালিত হবেই।” (১৯:৬১)
“তারা সেখানে শন্তির সম্ভাষণ ছাড়া অন্য কোন বাজে কথা শুনবে না। সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় তাদের জন্য থাকবে জীবনোপকরণ।” (১৯:৬২)
“এ হচ্ছে সেই জান্নাত, যার উত্তরাধিকারী করব আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মুত্তাকীদেরকে।” (১৯:৬৩)

এ তিন আয়াতে বেহেশত সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বেহেশেতের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। জান্নাত বা বেহেশতের একটি বৈশিষ্ট্য হল, এটি হচ্ছে চিরস্থায়ী ও সর্বকালীন। সেখানে যে একবার প্রবেশ করবে, সে কখনোই সেখান থেকে বের হবে না। অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনার পুরস্কার হিসেবে বেহেশত দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহ দিয়েছিলেন, পরকালে মানুষ তা প্রত্যক্ষ করবে এবং উপলব্ধি করবে। পৃথিবীতে মুমিন ব্যক্তিরা নানাভাবে নির্যাতন ও দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হন। কাফিররা নানা অযৌক্তিক ও বাজে কথার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তিদেরকে কষ্ট দেয়। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, বেহেশতে শান্তি, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ বক্তব্য ছাড়া বাজে কথার স্থান নেই। সেখানে মুমিনদের জন্য জীবনোপকরণও প্রস্তুত থাকবে।

আলোচ্য তিন আয়াতের শেষ আয়াতে দু’টি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর একটি হল, তাকওয়ার গুরুত্ব। তাকওয়া হচ্ছে বেহেশতের চাবি। পাপ-পংকিলতা থেকে দূরে না থাকলে মানুষ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত: পরকালে সতকর্মশীলদেরকে যে পুরস্কার দেবেন, তা তাদের প্রাপ্যের চেয়েও অনেক বেশি। আল্লাহর ওই পুরস্কারের সঙ্গে বাবা-মার কাছ থেকে সন্তানের পাওয়া উত্তরাধিকার সম্পত্তির তুলনা করা যেতে পারে। যেমনিভাবে সন্তান কোনো কষ্ট ছাড়াই ওই সম্পত্তি অর্জন করে থাকে। সতকর্মশীলরা পরকালে যে পুরস্কার পাবেন, দুনিয়ার কষ্টের তুলনায় তা অনেক বেশি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. বেহেশত আমাদের কাছে অদৃশ্য। কিন্তু তা সতকর্মশীলদের জন্য আল্লাহর দেয়া এক প্রতিশ্রুতি। আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে আমরা কিয়ামতে অনুগ্রহ লাভ করতে সক্ষম হবো।
২. বেহেশতবাসী হতে চাইলে অন্যায় কথা ও কাজ পরিহার করতে হবে। যেখানে অন্যায় কথা ও কাজের চর্চা হয়,সেখানে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. বেহেশত হচ্ছে পরহেজগার ও সতকর্মশীলদের উত্তরাধিকার। পৃথিবীর বৈষয়িক উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও আল্লাহর প্রতিশ্রুত বেহেশত থেকে বঞ্চিত হবে না সতকর্মশীলরা।

সূরা মারিয়ামের ৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَا نَتَنَزَّلُ إِلَّا بِأَمْرِ رَبِّكَ لَهُ مَا بَيْنَ أَيْدِينَا وَمَا خَلْفَنَا وَمَا بَيْنَ ذَلِكَ وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا (64)
“(ফেরেশতারা বলবে) আপনার প্রভুর আদেশ ছাড়া আমরা অবতরণ করি না। আমাদের সম্মুখে যা আছে, পশ্চাতে যা আছে এবং দুইয়ের মধ্যবর্তী যা আছে সবই আল্লাহ্‌র অধিকারে এবং আপনার প্রভু কখনও ভুলে যান না।” (১৯:৬৪)

তাফসিরকারকদের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল (সা.)-র কাছে কিছু সময়ের জন্য ওহি নাজিল বন্ধ ছিল। এ কারণে রাসূল কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। পাশাপাশি রাসূলের বিরোধীরা নানা কটুকথা বলতে শুরু করেছিল। এরপরই এ আয়াত নাজিল হয় এবং আল্লাহ রাসূলকে এ নিশ্চয়তা দেন যে, তিনি তাকে ভুলে যাননি। আল্লাহ কখনোই কিছু ভুলে যান না। আল্লাহ তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে ওহি নাজিল করেন। অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব কিছু তার নিয়ন্ত্রণে। কোনো কিছুই তার কর্তৃত্বের বাইরে নয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১.পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো ক্রমান্বয়ে আল্লাহর নির্দেশনায় বিভিন্ন নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে নাজিল করা হয়েছে। নবী,রাসূল ও ফেরেশতাদের এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নেই।
২. ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কিছুই করেন না। আল্লাহ নির্দেশ দিলেই কেবল তা বাস্তবায়ন করেন।
৩. আল্লাহতায়ালা কোনো কিছুই ভুলে যান না। সর্বশক্তিমান আল্লাহ কোনো কিছু ভুলে যেতে পারেন, এমন বক্তব্য একেবারেই অযৌক্তিক।

সূরা মারিয়ামের ৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا فَاعْبُدْهُ وَاصْطَبِرْ لِعِبَادَتِهِ هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا (65)
“তিনি আসমান ও জমিনের এবং এ দূয়ের মাঝখানের সব কিছুর রব। কাজেই আপনি তার এবাদত করুন এবং তার এবাদতের ওপর অবিচল থাকুন। আপনার জানা মতে তাঁর সমকক্ষ কোন সত্তা আছে কি? (১৯:৬৫)

এ আয়াতে বিশ্ব পরিচালনায় একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্বের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। এ আয়াতে বলা হয়েছে, একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন আকাশ ও পৃথিবীর পরিচালনাকারী। তিনি যেমন একাই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন তেমনি তা নিয়ন্ত্রণও করছেন এককভাবে। আল্লাহর সমকক্ষ কেউ নেই। কাজেই কেবল তারই এবাদত করতে হবে এবং অন্য কারো এবাদত করা যাবে না। এটা স্বাভাবিক যে, আল্লাহর পথে চললে অনেক বাধা-বিপত্তি আসবে। কাজেই সৎ পথে চলার ক্ষেত্রে ধৈর্যশীল ও দৃঢ় থাকতে হবে। পথচ্যুত হলে চলবে না। এ আয়াতে এবাদতের উদ্দেশ্য কেবল নামায ও আল্লাহর স্মরণ নয়। কারণ এ ধরনের এবাদত তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। এখানে এবাদতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে তথা সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর সামনে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করা। মনে-প্রাণে একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং এ বিশ্বাসের ব্যাপারে সুদৃঢ় থাকতে হবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. আল্লাহ যে এক ও অদ্বিতীয়, তা সব ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে। কাজে-কর্মে ও এবাদতের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুরই এবাদত করা যাবে না।
২. ইবাদত-বন্দেগি হচ্ছে দুনিয়াপ্রীতি, অশুভ কামনা-বাসনা ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। কাজেই এ ক্ষেত্রে ধৈর্য্য ও সহনশীলতা জরুরি।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন