সূরা মারিয়াম; আয়াত ২৯-৩৪

সূরা মারিয়াম; আয়াত ২৯-৩৪


সূরা মারিয়ামের ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَأَشَارَتْ إِلَيْهِ قَالُوا كَيْفَ نُكَلِّمُ مَنْ كَانَ فِي الْمَهْدِ صَبِيًّا (29) قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آَتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا (30)
“মারিয়াম শিশুর প্রতি ইঙ্গিত করল। লোকেরা বলল, কিভাবে আমরা দোলনাতে শায়িত শিশুর সাথে কথা বলব?” (১৯:২৯)
“শিশু বলে উঠল, আমি আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন ও নবী করেছেন।” (১৯:৩০)

আগের পর্বে বলা হয়েছে, হযরত মারিয়াম (সা.আ.) যখন সন্তানসহ তার সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছে ফিরে গেলেন, তখন তারা তাকে নানা তির্যক প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে থাকে। তারা বলতে থাকে, হে মারিয়াম তোমারতো কোনো স্বামী ছিল না, তোমার সন্তান হল কিভাবে? পুত-পবিত্র পরিবারের সদস্য হওয়ার পরও তুমি অপবিত্র হলে কিভাবে? মারিয়াম (সা.আ.) নিজে তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার সন্তানের প্রতি ইশারা করেন, যাতে তারা তাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো ওই শিশুর কাছ থেকে জেনে নেয়। লোকজন যখন দেখল যে, মারিয়াম নিজে কথা না বলে দোলনায় শুয়ে থাকা শিশুর দিকে ইঙ্গিত করছে, তখন তারা আরো বেশি ক্ষুব্ধ হল। কারণ তারা ভাবতেও পারেনি যে, কোলের শিশুটি কথা বলতে পারবে এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় কোলের শিশুটিই কথা বলে উঠে এবং নিজের পরিচয় তুলে ধরে।

সেই শিশুটিই হচ্ছেন হযরত ঈসা (আ.)। তিনি সমবেত লোকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আমি আল্লাহর বান্দা। আল্লাহ আমাকে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন। ঈসা (আ.) নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে ঘোষণা করলেও তার অনুসারীরা বিষয়টিকে বিকৃত করেছে। তারা ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র হিসেবে প্রচার চালিয়েছে। এই ভ্রান্ত বিশ্বাস সব ঐশী ধর্মের অনুসারীদের জন্যই বিপদ হিসেবে গণ্য হয়।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. আল্লাহ নিষ্পাপ মানুষদেরকে অপবাদ ও অপমান থেকে রক্ষা করেন। প্রয়োজনে কোলের শিশুও অপবাদ ও গুজবের জবাব দেয় এবং পবিত্রতার পক্ষে অবস্থান নেয়।
২. নব্যুয়ত ও রেসালাত হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ঐকান্তিক দাসত্বের ফল এবং তা ঐশী অনুগ্রহ।

সূরা মারিয়ামের ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
) وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ‎وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا (31) وَبَرًّا بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّارًا شَقِيًّا (32)
“এবং আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে তাঁর আশীর্বাদ ধন্য করেছেন। আর যতদিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন নামায ও যাকাত আদায়ের হুকুম দিয়েছেন।” (১৯:৩১)
“আর নিজের মায়ের হক আদায়কারী করেছেন এবং তিনি আমাকে অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর করেননি।” (১৯:৩২)

হযরত ঈসা (আ.) দোলনায় থাকা অবস্থায় তার মায়ের বিরুদ্ধে দেয়া অপবাদেরই কেবল জবাব দেননি, তিনি মানুষের ভুল ধরিয়ে দেয়ার পর নিজেকে নবী হিসেবেও ঘোষণা করেছেন। অর্থাত তিনিও নামায ও যাকাতের মতো আল্লাহর নির্দেশগুলোর পালনকারী এবং তিনি নিজের পরিবার তথা জনগণের কল্যাণ সাধনকে নিজের দায়িত্ব বলে মনে করতেন। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ ধরনের ব্যক্তির অস্তিত্ব জুড়ে রয়েছে রহমত ও বরকত।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. সব ঐশী ধর্মের অনুসারীদের জন্য নামায ও যাকাতের বিধান ছিল। এটা শুধু ইসলাম ধর্মের বিধান নয়।
২. মা-বাবা বিশেষকরে মায়ের সেবা করা,নবী-রাসূলদের বৈশিষ্ট্যের অংশ।

সূরা মারিয়ামের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا (33) ذَلِكَ عيسَى ابْنُ مَرْيَمَ قَوْلَ الْحَقِّ الَّذِي فِيهِ يَمْتَرُونَ (34)
“শান্তি আমার প্রতি যখন আমি জন্ম নিয়েছি ও যখন আমি মরব এবং যখন আমাকে জীবিত করে উঠানো হবে।” (১৯:৩৩)
“এ হচ্ছে মারিয়ামের পুত্র ঈসা এবং এ হচ্ছে তার সম্পর্কে সত্য কথা, যে বিষয়ে লোকেরা সন্দেহ করছে।” (১৯:৩৪)

হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর ইচ্ছায় তার অলৌকিক জন্ম এবং জীবদ্দশায় তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়েই কথা বলেননি বরং তার মৃত্যু ও কিয়ামতের দিন পুনরায় জীবিত হওয়ার বিষয়েও কথা বলেছেন। মৃত্যু ও পুণরুত্থান সম্পর্কে কথা বলে তিনি এটা বুঝাতে চেয়েছেন যে, তিনিও অন্যদের মতো মানুষ এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। সব ধরনের বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে দূরে থাকাটা নবী-রাসূলদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে আল্লাহতায়ালা নবী-রাসূলদেরকে সব ধরনের বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করেছেন, যাতে মানুষ নিশ্চিন্তে তাদের অনুসরণ করতে পারে এবং নবী-রাসূলদের সম্পর্কে কোনো ধরনের দ্বিধা-সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে একদল লোক অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে এমনকি কখনো কখনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে নবী-রাসূলদের বিষয়ে সন্দেহ করে। আবার কেউ কেউ নবী-রাসূলদেরকে মানুষের পর্যায় থেকে ওপরে এবং আল্লাহর মর্যাদার কাছাকাছি বলে মনে কর। অপর এক দল নবী-রাসূলদেরকে সাধারণ মানুষের চেয়েও কম জ্ঞানসম্পন্ন হিসেবে প্রচার চালায়। কিন্তু বাস্তবতা হল, নবী-রাসূলরাও অন্যান্য মানুষের মতোই। তবে তাদের ওপর ওহি নাজিল হয়েছে এবং তারা ঐশী বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। নবী-রাসূলরা সমাজে আল্লাহর শিক্ষা বাস্তবায়ন করেছেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. নবী-রাসূলরাসহ সবারই জন্ম-মৃত্যু রয়েছে এবং কেউই এর ব্যতিক্রম নয়।
২. নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারার বিষয়ে নবী-রাসূলরাও উদ্বিগ্ন থাকতেন এবং দোয়া করতেন।
৩. ইসলাম ধর্মের আগে যেসব ঐশী ধর্ম এসেছে, সেসবের অনুসারীদের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরা হয়েছে পবিত্র কুরআনে, যাতে আমরা সবাই সেগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারি।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন