সূরা মারিয়াম; আয়াত ১২.১৭
সূরা মারিয়াম; আয়াত ১২.১৭
সূরা মারিয়ামের ১২ এবং ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-
يَا يَحْيَى خُذِ الْكِتَابَ بِقُوَّةٍ وَآَتَيْنَاهُ الْحُكْمَ صَبِيًّا (12) وَحَنَانًا مِنْ لَدُنَّا وَزَكَاةً وَكَانَ تَقِيًّا (13)
“হে ইয়াহইয়া! আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর। আমি তাকে শৈশবেই ‘হেকমাত’ দিয়েছি।” (১৯:১২)
“এবং নিজের পক্ষ থেকে মেহেরবানী বা হৃদয়ের কোমলতা ও পবিত্রতা দান করেছি,আর সে ছিল খুবই তাকওয়াবান।” (১৯:১৩)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, আল্লাহ পাক হযরত যাকারিয়া (আ.) এর দোয়া কবুল করেছিলেন। তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর বৃদ্ধ অবস্থায় আল্লাহ তাঁদেরকে সন্তান দান করেছেন। তাঁদের ঐ সন্তানের নাম আল্লাহ নিজেই রেখেছেন ইয়াহিয়া। এ আয়াত দু’টিতে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই মেধাবি সন্তানটিকে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার মতো সচেতনতা বা হেকমত দিয়েছেন। তিনি নিজে ছিলেন পূত পবিত্র একজন ব্যক্তিত্ব। সেইসাথে সবার প্রতি ছিলেন দয়ালু ও মেহেরবান। সবাইকে তিনি ভালোবাসতেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁর সমকালীন ঐশী গ্রন্থ অর্থাৎ তাওরাত শরিফের বিধান বাস্তবায়নে নিজের সকল মেধা ও প্রতিভাকে যেন কাজে লাগান। বিশেষ করে নিষ্ঠার সাথে তিনি যেন তাওরাতের শরিয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। অবশ্য এইসব আদেশ সরাসরি ইয়াহিয়া (আ.) এর উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়নি বরং আল্লাহ পাক অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর নবীদের অনুসারীদেরকে উৎসাহিত করে বলেছেন তাঁরা যেন ঐশী কিতাবগুলোর বাস্তবায়নের ব্যাপারে উদ্যমী হন। আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা যেন কোনোরকম অলসতা না করেন।
এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. নবীগণ এবং তাঁদের অনুসারীগণের একটা দায়িত্ব হল আল্লাহর জমিনে দ্বীনী হুকুম আহকাম প্রতিষ্ঠা করা এবং সমাজে তাকে সুদৃঢ় রাখার ব্যাপারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করা।
২. অন্যদের প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সদয় হওয়া ঐশী গুণাবলির অংশ। এইসব গুণ আল্লাহ তাঁর অলিদেরকেও দান করে থাকেন।
সূরা মারিয়ামের ১৪ এবং ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَبَرًّا بِوَالِدَيْهِ وَلَمْ يَكُنْ جَبَّارًا عَصِيًّا (14) وَسَلَامٌ عَلَيْهِ يَوْمَ وُلِدَ وَيَوْمَ يَمُوتُ وَيَوْمَ يُبْعَثُ حَيًّا (15)
“এবং তিনি ছিলেন নিজের পিতামাতার অধিকার সচেতন এবং জনগণের ব্যাপারে তিনি উদ্ধত কিংবা অবাধ্য ছিলেন না।” (১৯:১৪)
“অতএব যেদিন তিনি জন্ম লাভ করেছেন এবং যেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন আর যেদিন তাঁকে জীবিত করে উঠানো হবে-তাঁর প্রতি যথাযথ শান্তি বর্ষিত হোক।” (১৯:১৫)
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ পাক হযরত ইয়াহিয়া (আ.) এর বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আল্লাহর ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত খোদাভীরু, তাকওয়া সম্পন্ন এবং পরহেজগার। বাবা মায়ের ব্যাপারে ছিলেন অসম্ভব বিনয়ী এবং পূণ্যবান। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, কারো সাথে অহমিকা দেখাতেন না কিংবা বলপ্রয়োগ করতেন না। মানব জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে এ আয়াতগুলোতে আরো বলা হয়েছেঃ আল্লাহ তায়ালা সেই তিনটি পর্যায়েই তাঁকে সুস্থতা এবং নিরাপত্তা দান করেছেন। যেমন জন্মের সময় অর্থাৎ এই পৃথিবীতে প্রবেশ করার সময় এবং এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সময় অর্থাৎ মৃত্যুর সময়, আর কিয়ামতের দিন অর্থাৎ আল্লাহর বিচারালয়ে উপস্থিত হবার দিন যেদিন সবাই পুনরায় জীবিত হয়ে উঠবে এবং প্রকৃত জীবনে উপনীত হবে-তাঁকে এই তিনটি পর্যায়েরই নিরাপত্তা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।
এ সব আয়াতে ‘সালাম’ শব্দের অর্থ কেবল মৌখিক কিংবা শাব্দিক দরুদকেই বোঝায় না বরং এর অর্থ হচ্ছে নিরাপত্তা এবং সুস্থতা। আর এই সুস্থতাই রুচি বিরুদ্ধ বা প্রকৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় আশয় থেকে মানুষকে দূরে রাখে।
এ দুই আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. বাবা-মায়ের সাথে সদাচরণ করা একটি সামগ্রিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করা থেকে কেউই এবং কখনোই মুক্ত নয়। যদিও সমাজে কিংবা আল্লাহর কাছে তাঁর উচ্চ পদমর্যাদাও থেকে থাকে।
২. সুস্থ সাবলীল জীবন এবং নিরাপদ মৃত্যুর বিষয়টি নির্ভর করে পূত পবিত্রতা, বাবা মায়ের প্রতি সদাচার, গুনাহ এবং নাফরমানী থেকে বিরত থাকার ওপর। সকল মানুষই পারে এসব সৎ কাজের মাধ্যমে দুনিয়া এবং আখেরাতে নিজ জীবনের সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
এই সূরার ১৬ এবং ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انْتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَانًا شَرْقِيًّا (16) فَاتَّخَذَتْ مِنْ دُونِهِمْ حِجَابًا فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا (17)
“আর (হে মুহাম্মাদ!) এই কিতাবে মারিয়ামের অবস্থা স্মরণ কর৷ যখন সে নিজের খান্দান থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে (বায়তুল মোকাদ্দাসের) পূর্ব দিকে নির্জনবাসী হয়ে গিয়েছিল।” (১৯:১৬)
এবং পর্দা টেনে তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিল৷এ অবস্থায় আমি তার কাছে নিজের রূহকে অর্থাৎ (ফেরেশতাকে) পাঠালাম এবং সে তার সামনে একজন পরিপূর্ণ মানুষের রূপ নিয়ে হাজির হলো৷ (১৯:১৭)
হযরত ইয়াহিয়া (আ.) এর জীবনের গল্প সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করার পর এ আয়াতগুলোতে হযরত ইসা (আ.) এর জীবনের গল্পের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছেঃ তাঁদের জীবনের গল্পে অনেক মিল রয়েছে। পরবর্তী আয়াতগুলোতে সেই সামঞ্জস্যগুলোর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমে ইসলামে নবীকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছেঃ এই কিতাবে এবং মারিয়াম নামক সূরায় হযরত মারিয়াম (সা.) এবং রুহুল কুদসের ঘটনা বর্ণনা করুন – যিনি নিজের পরিবার পরিজন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন এবং বায়তুল মোকাদ্দাসে এতেকাফ করার মধ্য দিয়ে যাঁর গল্পের সূচনা হয়েছিল। তিনি নিজেই নিজেকে অন্যান্যদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন এবং নিজে নিজেই হিজাব বা পর্দার ব্যবস্থা করে ইবাদাতের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছিলেন।
আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরই খুব কাছের এক ফেরেশতাকে সুন্দর এক মানুষের রূপে মারিয়ামের কাছে পাঠিয়েছিলেন। মারিয়াম ঐ মানবরূপী ফেরেশতাকে দেখে বিস্মিত হল এই ভেবে যে, কীভাবে এই লোক তার নির্জনবাসে আসতে সক্ষম হল!
এ আয়াতগুলো থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ
১. আধ্যাত্মিকতার পর্যায় বা পূর্ণতায় পৌঁছার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে কোনোরকম পার্থক্য নেই। নবুয়্যত এমন একটি দায়িত্ব যে আল্লাহ পাক নারীদের ওপর এই দায়িত্বটি অর্পন করেন নি, এ ছাড়া আল্লাহর ফযীলত অর্জনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে কোনোরকম বৈষম্য বা তারতম্য নেই।
২. জিব্রাইল এবং ফেরেশতাগণ নবী-রাসূল ছাড়াও অন্যদের কাছে যান এবং তাঁদের সাথে কথা বলেন।
৩. একজন নারী আধ্যাত্মিক ফযীলত অর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতার এমন পর্যায়ে উপনীত হতে সক্ষম যার ফলে ফেরেশতারা পর্যন্ত ঐ নারীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন