সূরা মারিয়াম; আয়াত ৬-১১
সূরা মারিয়াম; আয়াত ৬-১১
সূরা মরিয়মের ৬ ও ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنْ آَلِ يَعْقُوبَ وَاجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا (6) يَا زَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ اسْمُهُ يَحْيَى لَمْ نَجْعَلْ لَهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا (7)
“(হে আমার প্রতিপালক আমাকে এমন একজন স্থলাভিষিক্ত দাও) যে হবে আমার এবং ইয়াকুব বংশের উত্তরাধিকার এবং হে আমার প্রতিপালক! তাকে (তোমার প্রিয় বান্দা হিসেবে) মনোনীত কর।” (১৯:৬)
“(প্রত্যাদেশ এল) হে যাকারিয়া, আমি তোমাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি, তার নাম হবে ইয়াহিয়া; এই নামে আগে আমি কারো নামকরণ করিনি।” (১৯:৭)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, হযরত যাকারিয়া (আ.) এই ভেবে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর তার সম্পদ কোনো অযোগ্য বা অসত লোকের হাতে পড়ে যেতে পারে। এ জন্য তিনি আল্লাহর কাছে যোগ্য উত্তরসূরি দেয়ার আবেদন জানান। এ আয়াতে হযরত ইয়াকুব (আ.) এর বংশের সম্পদের উত্তরাধিকারের প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ, হযরত যাকারিয়ার স্ত্রী ছিলেন হযরত সোলাঈমান (আ.)এর বংশধর এবং একইসঙ্গে তিনি ছিলেন ইয়াকুব (আ.) এর পুত্র ইয়াহুদারও উত্তরসূরি। এসব কারণে হযরত যাকারিয়া প্রচুর সম্পদের অধিকারী ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর এ সম্পদ দেখা শোনার জন্য যোগ্য উত্তরসূরি রেখে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। কারণ তিনি ভালো করেই জানতেন, তাঁর মৃত্যুর পর এসব সম্পদ যদি কোনো অসত, দুর্নীতিবাজ কিংবা অযোগ্য লোকের হাতে পড়ে তাহলে এ সম্পদের মাধ্যমে সমাজে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
এ কারণে হযরত যাকারিয়া আল্লাহর কাছে এমন একজন উত্তরাধিকারীর জন্য আবেদন করেন যিনি যোগ্যতা ও সততায় হবেন অতুলনীয় এবং যার প্রতি মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকবেন। অবশ্য কোনো কোনো মুফাসসিরের মতে, এ আয়াতে উত্তরাধিকার বলতে সম্পদ নয় বরং নবুওয়াতের উত্তরাধিকারের কথা বলা হয়েছে। তবে অনেকের মতে এখানে সম্পদ ও নবুওয়াত দু’টি বিষয়ের ওপরই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অর্থাত হযরত যাকারিয়া আল্লাহর কাছে এমন এক সন্তান কামনা করেছিলেন যিনি সুষ্ঠুভাবে সম্পদ ব্যবহারের পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াত লাভেরও যোগ্য হবেন।
মহান আল্লাহতালা হযরত যাকারিয়া (আ.)এর দোয়া কবুল করে তাঁকে এমন এক সন্তানের সুসংবাদ দেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যার সমকক্ষ কেউ হবে না। আল্লাহ নিজেই সে সন্তানের যার নাম নির্বাচন করেন এবং শৈশবেই তাকে নবুওয়াত দান করেন। এ সন্তানের নাম ছিল ইয়াহিয়া এবং তার আগে এ নাম কেউ রাখেনি। শৈশবকাল থেকেই ইয়াহিয়া ছিলেন উচ্চতর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। তাঁর জীবন-যাত্রা ছিল কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির এবং সফরের মধ্যে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। এ কারণে তিনি কখনও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেননি। একইভাবে পরবর্তী যুগে হযরত ঈসা (আ.)ও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিবাহিত ছিলেন।
এ দুই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১. সন্তান কামনা করা প্রত্যেক মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং আল্লাহর কাছে সন্তান কামনা করা নবী-রাসূলদের জন্য দোষের কিছু নয়।
২. সন্তানের জন্য সতর্কতার সঙ্গে নাম নির্বাচন করা উচিত। কারণ সন্তানের নামের মধ্যে মানুষের সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় ফুটে ওঠে।
সূরা মরিয়মের ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا وَقَدْ بَلَغْتُ مِنَ الْكِبَرِ عِتِيًّا (8) قَالَ كَذَلِكَ قَالَ رَبُّكَ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَقَدْ خَلَقْتُكَ مِنْ قَبْلُ وَلَمْ تَكُ شَيْئًا (9)
“(যাকারিয়া) বলল- হে আমার প্রতিপালক, আমার স্ত্রী যখন বন্ধ্যা ও আমি বার্ধক্যের শেষ সীমায় তখন আমার পুত্র সন্তান হবে কীভাবে?” (১৯:৮)
“(ফেরেশতা) বলল- এভাবেই হবে। তোমার প্রতিপালক বললেন- এ আমার জন্য সহজ সাধ্য। আমি তো আগে তোমাকে সৃষ্টি করেছি যখন তুমি কিছুই ছিলে না।” (১৯:৯)
হযরত যাকারিয়া (আ.) আল্লাহর কাছে সন্তানের আবেদন জানিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু কিভাবে আল্লাহ তার এ আবেদন কবুল করবেন তা তিনি জানতেন না। তার মনে প্রশ্ন ছিল, তিনি ও তার স্ত্রী কি আবারও যুব বয়সে উপনীত হবেন, নাকি বৃদ্ধ বয়সেই পুত্রসন্তান লাভ করবেন? একজন নবীর জন্য এ ধরনের সংশয় অমূলক নয়। কারণ নবী-রাসূলদের জ্ঞানও আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় সীমিত এবং আল্লাহ তাদেরকে যতটুকু জানাতেন তারা ঠিক ততটুকুই জানতে পারতেন। যেহেতু আল্লাহই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন তাই প্রকৃতির নিয়ম বদলে দেয়ার ক্ষমতাও তার রয়েছে। তাই তিনি ইচ্ছা করলে বন্ধ্যা নারীর গর্ভেও সন্তান দান করতে পারেন।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১. বন্ধ্যাত্বের কারণে কোনো নারী বা পুরুষ যেন সন্তান লাভের ব্যাপারে নিরাশ না হয়। কারণ অতীতে বহু বন্ধ্যা নারী ও পুরুষ পরবর্তী জীবনে সন্তানের অধিকারী হয়েছেন।
২. মানুষ নিজের অস্তিত্ব সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে আল্লাহর শক্তি সম্পর্কে তার সন্দেহ দূর হয়ে যায়।
সূরা মরিয়মের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ رَبِّ اجْعَلْ لِي آَيَةً قَالَ آَيَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلَاثَ لَيَالٍ سَوِيًّا (10) فَخَرَجَ عَلَى قَوْمِهِ مِنَ الْمِحْرَابِ فَأَوْحَى إِلَيْهِمْ أَنْ سَبِّحُوا بُكْرَةً وَعَشِيًّا (11)
“যাকারিয়া বলল- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও। তিনি বললেন- তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি সুস্থাবস্থায় কারো সঙ্গে তিনি দিন কথা বলতে পারবে না।” (১৯:১০)
“এরপর সে কক্ষ থেকে বের হয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে এল ও ইঙ্গিতে তাদের সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে বলল।” (১৯:১১)
মুফাসসিরদের মতে, হযরত যাকারিয়া (আ.) যখন সন্তান লাভের সুসংবাদ সম্বলিত প্রত্যাদেশ পান তখন এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে চান যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছি নাকি এটি শয়তানের কোনো ধোঁকাবাজি। তাই তিনি এ ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো নিদর্শন দেখতে চাইলেন। জবাবে আল্লাহ তাঁকে জানান, তিন দিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো কাজে কথা বলতে পারবেন না, এমনকি মানুষকে দাওয়াত দিতে গেলেও তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হবে না। আল্লাহর পক্ষ থেকে এ নিদর্শন পাওয়ার পর হযরত যাকারিয়া (আ.) ইবাদতগৃহ থেকে বের হয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে জনগণকে সকাল ও সন্ধ্যায় নামাযসহ অন্যান্য ইবাদত করতে বলেন।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১. আমাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ ইচ্ছাধীন। তিনি যদি না চান তাহলে আমরা সুস্থ থাকা সত্ত্বেও আমাদের শরীরের অঙ্গ কাজ করবে না।
২. আল্লাহর স্মরণ ও তার এবাদত প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।
সূত্রঃ রেডিও তেহরান
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন