সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৬২-৬৭
সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৬২-৬৭
সূরা আম্বিয়ার ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالُوا أَأَنْتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآَلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيمُ (62) قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُونَ (63)
“তারা বলল: হে ইব্রাহীম তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার করেছ?” (২১:৬২)
“তিনি বললেন: বরং তাদের এই প্রধানই তো একাজ করেছে। অতএব তাদেরকে জিজ্ঞেস কর,যদি তারা কথা বলতে পারে।” (২১:৬৩)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, মূর্তিপূজারীরা উতসব পালনের জন্য শহরের বাইরে চলে যাওয়ার পর হযরত ইব্রাহীম (আ.) পূজামণ্ডপে যান এবং একটি ছাড়া অন্য সব মূর্তি ভেঙে ফেলেন। এরপর তিনি কুড়ালটি বড় মূর্তির গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে চলে আসেন।
শহরের বাইরে উতসব পালনের পর মূর্তিপূজারীরা যখন নিজেদের শহরে ফিরে এসে পূজামণ্ডপের মূর্তিগুলোর ধ্বংসাবশেষ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলেন তখন তারা হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে আটক ও শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ পর্বে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও মূর্তিপূজারীদের মধ্যে এ সংক্রান্ত কথোপকথন নিয়ে আলোচনা করো হলো।
মূর্তিপূজারীরা যাতে তাদের বিশ্বাসের অসারতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হয়, সে লক্ষ্যে হযরত ইব্রাহিম (আ.) কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি মূর্তিপূজারীদের প্রশ্ন করেন- তোমরা কেন অন্য অপরাধীর সন্ধান করছ? এ কাজতো নিশ্চয়ই ওই বড় মূর্তিটি করেছে, যাতে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর অস্তিত্ব না থাকে এবং সবাই যাতে কেবল তারই পূজা করে। যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয়, তাহলে এ চূর্ণ-বিচূর্ণ মূর্তিগুলোর সঙ্গে কথা বলে দেখ, তারা কী বলে?
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো:
১. আল্লাহর নবী-রাসূলগণ শুধুমাত্র কথার মাধ্যমেই জনগণকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেননি বরং এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতেন।
২. নাটক-থিয়েটার তথা অভিনয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়গুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরা পছন্দনীয় কাজ। হযরত ইব্রাহীম (আ.) মূর্তিগুলোকে ভাঙার জন্য সর্ববৃহত মূর্তিকে দোষারোপের মাধ্যমে মিথ্যাচার করেননি বরং তিনি ভ্রান্তির ঘুম থেকে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
সূরা আম্বিয়ার ৬৪ ও ৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَرَجَعُوا إِلَى أَنْفُسِهِمْ فَقَالُوا إِنَّكُمْ أَنْتُمُ الظَّالِمُونَ (64) ثُمَّ نُكِسُوا عَلَى رُءُوسِهِمْ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلَاءِ يَنْطِقُونَ (65)
“একথা শুনে তারা নিজেদের বিবেকের দিকে ফিরল এবং পরস্পরকে বলতে লাগলো, সত্যিই তোমরা নিজেরাই জালেম।” (২১:৬৪)
“অতঃপর তারা মস্তক নত করে বলল, তুমি তো জান যে,এরা কথা বলে না।” (২১:৬৫)
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-র পরিকল্পনা সফল হয়। মানুষের বিবেক জেগে ওঠে। তারা বুঝতে পারল- হযরত ইব্রাহীম (আ.) মূর্তি ধ্বংস করে তাদের ওপর জুলুম করেনি। বরং তারা প্রাণহীন মূর্তিকে উপাসনা করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছে। অবশ্য এ অবস্থা মানুষের মধ্যে বেশি সময় বজায় ছিল না, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের আকিদা-বিশ্বাসের পক্ষ নিয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সাথে তর্ক করতে লাগল ও বলল- অপরাধীকে চিহ্নিত করার জন্য তুমি কেন বাক শক্তিহীন মূর্তিগুলোর সাক্ষ্য নিতে বলছো? তুমি কি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছ? তুমি জান না-তারা কথা বলতে পারে না?
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো:
১. নবী-রাসূলগণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সুপ্ত বিবেককে জাগ্রত করা।
২. নবী-রাসূলরা মানুষকে সত পথে ফিরিয়ে আনতে পরোক্ষ কৌশল অবলম্বন করতেন। মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করাও ছিল নবী-রাসূলদের প্রশিক্ষণের একটি পদ্ধতি।
৩. অনেক মানুষ সত্যকে উপলব্ধির করার পরও গোঁড়ামি গোয়ার্তুমির কারণে তা প্রত্যাখ্যান করে।
সূরা আম্বিয়ার ৬৬ ও ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ أَفَتَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَلَا يَضُرُّكُمْ (66) أُفٍّ لَكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (67)
“তিনি বললেন: তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর এবাদত কর,যা তোমাদের কোন উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না?” (২১:৬৬)
“ধিক তোমাদেরকে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব উপাস্যের তোমরা পূজা করছো তাদেরকে। তোমাদের কেন চিন্তা করো না?” (২১:৬৭)
হযরত ইব্রাহীম (আ.) বুঝতে পারলেন মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করার পরও তাদের নিজেদের ও পূর্বপুরুষদের ভুল আকিদা-বিশ্বাস ও কাজের পক্ষে কথা বলছে। এ অবস্থায় তিনি প্রথমে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, যা তোমাদের কোনো উপকারে আসে না এবং তোমাদের ক্ষতি করতে পারে না, কেন তার উপাসনা কর? এরপর তিনি চরম ঘৃণা প্রকাশ করে স্পষ্ট ভাষায় মূর্তি ও মূর্তিপূজারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করেন। তিনি সবাইকে এটা বুঝিয়ে দেন যে, তিনি কখনোই মূর্তি ও মূর্তিপূজারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথ থেকে ফিরে আসবেন না। হযরত ইব্রাহীম (আ.) মূর্তি ধ্বংস করে অনুতপ্ত হননি বরং নিজের কাজের যৌক্তিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি সবাইকে বললেন- কেন তোমরা অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে বিবেক-বুদ্ধির পথে চল না? কেন তোমরা পূর্বপুরুষদের অনুসরণের পরিবর্তে বিবেক-বুদ্ধিকে গুরুত্ব দাও না?
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো:
১. সাধারণত উপাসনার উদ্দেশ্য হলো- স্বার্থ ও কল্যাণ লাভ এবং বিপদ-আপদমুক্ত থাকা, যা শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিশ্চিত করতে পারেন।
২. ঘৃণিত ও অপছন্দনীয় কাজের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। অন্যায়ের রিবুদ্ধে প্রয়োজনে ক্ষুব্ধ আচরণও করতে হবে।
৩. যারা সত্যকে উপলব্ধির পরও গোঁড়ামির কারণে সত্যকে ত্যাগ করে, তারা অবশ্যই শাস্তি পাবে।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন