সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৩৪-৩৭

সূরা আম্বিয়া; আয়াত ৩৪-৩৭


সূরা আম্বিয়ার ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ أَفَإِنْ مِتَّ فَهُمُ الْخَالِدُونَ (34) كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ (35)
“আপনার আগেও কোনো মানুষকে আমি অনন্ত জীবন দান করি নি। সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরঞ্জীব হবে?” (২১:৩৪)
“প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (২১:৩৫)

বিগত কয়েকটি পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সূরার আয়াতগুলো আল্লাহ এবং নবী-রাসূলদের সম্পর্কে মুশরিকদের অবান্তর এবং ভ্রান্ত ধারণাগুলোর জবাব স্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছে। মুশরিকদের ভ্রান্ত ধারণার একটি হলো তারা মনে মনে ভাবতো রাসূল (সা.) শীঘ্রই মারা যাবেন। ফলে তাদের তৈরি মূর্তিগুলোকে কোনো কিছু বলার মতো আর কেউ থাকবে না। সুতরাং তারা রাসূলের হাত থেকে রেহাই পাবে। এই অমূলক ধারণা লালন করে তারা মনে মনে ভীষণ আনন্দিত ছিল। তাদের সেই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে এই আয়াতগুলোতে বলা হয়েছেঃ ভেব না রাসূল চলে যাবে আর তোমরা বেঁচে থাকবে। নবী-রাসূলসহ সকল মানুষই মারা যাবে। এই দুনিয়াতে অনন্ত জীবনের অধিকারী কেউ নয়। আর এটাও ভেব না রাসূল চলে গেলে তাঁর দ্বীনও শেষ হয়ে যাবে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) হাজার হাজার বছর আগে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, কিন্তু হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা এবং আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার প্রচলন এখনো অক্ষুন্ন রয়েছে। এমনকি তোমরা মুশরিকরাও হজ্ব পালন করে যাচ্ছো, যদিও তোমাদের আনুষ্ঠানিকতায় বিভিন্নরকম কুসংস্কারের মিশ্রণ রয়েছে।

অতএব দুনিয়ার জীবন সবার জন্য ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে সে-ই প্রকৃতপক্ষে সফল যে আল্লাহর পক্ষ থেকে জীবনের সুখ দুঃখ চড়াই-উৎরাইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। কেননা সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। আর সেখানে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মফল প্রত্যক্ষ করবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো:
১. ঐশী নিয়মেই মানুষের জীবনের পরিসর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সীমিত।
২. দুঃখ, কষ্ট, দৈন্য সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষার মাধ্যম। একইভাবে সুখ শান্তি আর অর্থ-সম্পদ, ধনী-গরিব, দুর্বল সবল সবই তাই।
৩. মৃত্যু মানেই মানব জীবনের পরিসমাপ্তি নয়, বরং মৃত্যু হলো অন্য এক পৃথিবীতে প্রবেশ করার একটি পর্যায়। আর আল্লাহ সেখানে প্রত্যেকের বিচার করবেন।

সূরা আম্বিয়ার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذَا رَآَكَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَتَّخِذُونَكَ إِلَّا هُزُوًا أَهَذَا الَّذِي يَذْكُرُ آَلِهَتَكُمْ وَهُمْ بِذِكْرِ الرَّحْمَنِ هُمْ كَافِرُونَ (36)
“কাফেররা আপনাকে দেখলেই ঠাট্টা করে বলেঃ আচ্ছা! একি সেই ব্যক্তি,যে তোমাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করে? অথচ তারা নিজেরাই করুণমায় খোদাকে স্মরণ করতে অস্বীকার করে।” (২১:৩৬)

এ আয়াতে রাসূল (সা.) এর সাথে কাফেরদের দ্বান্দ্বিক আচরণের কথা বলা হয়েছে, রাসূল এবং তাঁর কথাবার্তা নিয়ে ঠাট্টা করা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই, কেননা শিরক করা বা মূর্তিপূজার পক্ষে তাদের কাছে যৌক্তিক কোন দলিল-প্রমাণ নেই। রাসূল (সা.) বলতেন এইসব মূর্তির কোনো বোধশক্তি নেই, এগুলো একেবারেই নিরর্থক কিছু বস্তুমাত্র। এইসব বলে রাসূলে খোদা (সা.) মানুষের চিন্তা-চেতনাকে জাগিয়ে তোলার কারণে মুশরিকরা রাসূল (সা.)এর উপর ক্ষিপ্ত ছিল। যদিও তারা আল্লাহর অফুরন্ত রহমত ও দয়ার নিদর্শনস্বরূপ তাঁর সকল নেয়ামতই ভোগ করে, সেগুলোকে কাজে লাগায়, তারপরও তারা আল্লাহকে স্মরণ করতে কিংবা তাঁর ইবাদাত করতে রাজি নয়।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলো:
১. নবী-রাসূলদের বিরোধী যারা, তাদের যুক্তিই হলো ঠাট্টা-মস্করা করা। তাছাড়া তারা যেসব দাবি করে সেগুলোর যৌক্তিক কোন ভিত্তি নেই।
২. বিশ্ব জাহানের মালিককে অস্বীকার করার ঘটনাকে কাফেররা দোষণীয় মনে করে না, কিন্তু তাদের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলোকে অসম্মান করা সঙ্গত নয় বলে মনে করে।

সূরা আম্বিয়ার ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
خُلِقَ الْإِنْسَانُ مِنْ عَجَلٍ سَأُرِيكُمْ آَيَاتِي فَلَا تَسْتَعْجِلُونِ (37)
“মানুষ দ্রুততাপ্রবণ সৃষ্টি। আমি দ্রুতই তোমাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখিয়ে দিচ্ছি, আমাকে তাড়াহুড়া করতে বল না।” (২১:৩৭)

এ আয়াতে মানুষের স্বাভাবিক একটি প্রবণতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তা হল মানুষ স্বভাবতই কাজে তড়িঘড়ি প্রবণ। ‘কানাল ইনসানু আজুলা’ আয়াতেও একই বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই দ্রুততাপ্রবণ বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ মানুষ এমন তড়িঘড়ি করে, মনে হয় তড়িঘড়ি করেই দুনিয়াতে এসেছে আর এ গুণাবলি দিয়েই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
নিঃসন্দেহে ভাল কাজে তড়িঘড়ি করা মঙ্গলজনক। কিন্তু মন্দ কাজের বেলায় তড়িঘড়ি করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
যখন কাফেরদেরকে বলা হতো: গোনাহ করা থেকে দূরে থাকো যাতে আল্লাহর আযাব তোমাদের নাগাল না পায়, তারা তখন বলতো: কেন এ আযাব তাড়াতাড়ি আসে না? আল্লাহ বলেন: আযাব নাযিলের ব্যাপারে তারা তাড়াতাড়ি করলেও আমাদের দ্রুততার কিছু নেই। তারা আমাদের হাত থেকে পালাতে পারবে না, অবশেষে আযাব তাদেরকে ঘিরে ধরবেই।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. শরীয়তসম্মত বা বুদ্ধিবৃত্তিক কারণ ছাড়া কোনো কাজে তড়িঘড়ি করা পছন্দনীয় কাজ নয়।
২. তড়িঘড়ি করা মানুষের সহজাত একটি প্রবণতা। তবে মানুষের অন্যান্য স্বভাবের মত এ স্বভাবকেও নিয়ন্ত্রণ বা সংযত করা সম্ভব। এ কারণেই আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, অকারণে কাজের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো কর না।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন