সূরা আম্বিয়া; আয়াত ১-৬
সূরা আম্বিয়া; আয়াত ১-৬
সূরা আম্বিয়া পবিত্র কুরআনের ২১তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। ‘আম্বিয়া’ শব্দের অর্থ ‘নবীগণ’। এ সূরায় ১৬ জন নবীর জীবনের কিছু ঘটনা স্থান পেয়েছে। সূরা আম্বিয়ার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে-
اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مُعْرِضُونَ (1)
“মানুষের জন্য তাদের হিসাব-নিকাশের সময় আগত প্রায়, অথচ তারা চূড়ান্ত উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়েই রয়েছে।” (২১:১)
সূরা আম্বিয়ায় উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় হল: কাফিরদের অবস্থা, কুরআনের সত্যতা, পূর্ববর্তীদের বিবরণ, ফেরেশতাদের প্রশংসা, একত্ববাদের প্রমাণ, আল্লাহর কোন সন্তান নেই এবং তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, প্রত্যেক জীব পানির মাধ্যমে জীবিত আছে, মানুষ তাড়াহুড়া-প্রিয়, কিয়ামতে মানুষের কর্ম মাপা হবে, প্রকৃত তাওরাতের প্রশংসা, হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর বৃত্তান্ত, হযরত লুত ও নূহ (আ.)-এর বর্ণনা, হযরত দাউদ ও সোলায়মান (আ.)-এর ঘটনা, হযরত ইউনুস, যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আ.)-এর ঘটনা, কিয়ামতের বর্ণনা, জাহান্নামী ও জান্নাতিদের অবস্থার বর্ণনাসহ নানা সতর্কবাণী ও উপদেশ।
মানুষকে সতর্ক করার জন্যই মহান আল্লাহ মানুষের মধ্যে নিয়োগ করেছেন নবী ও রাসূলবৃন্দ। এ সূরার প্রথমেই মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, তাদের সামনে পরকাল বা বিচার-দিবস আসন্ন ও অনিবার্য। মৃত্যুর পর পুনরুত্থান দিবসে সব কাজের হিসেবে নেয়া হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ পার্থিব জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তারা পুনরুত্থানের ব্যাপারে উদাসীন। কেউ তাদেরকে পরকাল ও বিচার দিবস সম্পর্কে সতর্ক করতে চাইলেও তারা তা উপেক্ষা করে বা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তারা এ সম্পর্কে কথা শুনতেও প্রস্তুত নয়। এমনকি তারা অনেক সময় অর্থনৈতিক হিসেব-নিকেশ তুলে ধরে বলেন, জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান মানুষ বাকির আশায় নগদ ছাড়তে প্রস্তুত নয়!
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :
১-মানুষের কৃতকর্মের হিসেব পরকালে নেয়া হবে। কিন্তু তা এত দূরে নয় যে এ ব্যাপারে উদাসীন হওয়া যায় ও যা খুশি তা করা যায়।
২-মানুষ যতই বেপরোয়া হোক না কেন পুনরুত্থান ও বিচার দিবসকে তারা এড়াতে পারবে না। তাদের বিচারের দিন অত্যাসন্ন ও অনিবার্য।
সূরা আম্বিয়ার দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
مَا يَأْتِيهِمْ مِنْ ذِكْرٍ مِنْ رَبِّهِمْ مُحْدَثٍ إِلَّا اسْتَمَعُوهُ وَهُمْ يَلْعَبُونَ (2) لَاهِيَةً قُلُوبُهُمْ وَأَسَرُّوا النَّجْوَى الَّذِينَ ظَلَمُوا هَلْ هَذَا إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ أَفَتَأْتُونَ السِّحْرَ وَأَنْتُمْ تُبْصِرُونَ (3)
“তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তাদের কাছে যখনই যে কোন নতুন স্মারক-বাণী বা উপদেশ আসে তখন তারা খেলার ছলে তা শোনে।” (২১:২)
“তাদের হৃদয় (সত্যের ব্যাপারে উদাসীন ও পার্থিব বিষয়ে) আমোদ-প্রমোদে বিভোর এবং যারা নিজের অবিচার করেছে (ও কুফরি করছে) তারা নিভৃতে শলা-পরামর্শ করে, (এবং বলে) এ কি তোমাদের মতই একজন মানুষ নয়? তবুও কি তোমরা দেখে-শুনে জাদুর জালে জড়িয়ে যাবে?” (২১:৩)
দ্বিতীয় আয়াতে খোদায়ী সতর্কবাণীর প্রতি খোদাবিমুখ মানুষের উদাসীনতা ও বেপরোয়া মনোভাব সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। আল্লাহ বলছেন, যখনই পবিত্র কুরআনের কোনো নতুন আয়াত নাজেল হত এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তা তাদেরকে পড়ে শোনাতেন তখন কাফের-মুশরিকরা শুনেও না শোনার মত অবস্থায় থাকত বা এমনভাবে শুনত যেন আসলে এ ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহই নেই। অন্য কথায় তারা আল্লাহর বাণীকে ঠাট্টা ও উপহাস হিসেবেই গ্রহণ করত।
তৃতীয় আয়াতে আল্লাহর বাণীর প্রতি খোদাবিমুখ লোকদের এ ধরনের আচরণের কারণ তুলে ধরে বলা হচ্ছে, আসলে তাদের হৃদয়গুলো কেবল দুনিয়া নিয়েই মশগুল এবং দুনিয়াবি নানা বিষয়ের ভিড়ে আল্লাহর স্মরণ সেখানে স্থান পায় না। এ ধরনের মানুষ নিজেরা তো সত্যকে মানেই না, বরং গোপনে অন্যদেরকেও সত্য তথা বিশ্বনবী (সা.)’র দাওয়াত গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। তারা মহানবী (সা.)-কে জাদুকর বলে প্রচার করে ও বলে বেড়ায় যে তিনি তার কথার জাদু দিয়ে তথা কুরআনের আয়াত শুনিয়ে মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করছেন!
সূরা আম্বিয়ার দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াত আমাদের এ শিক্ষা দেয় যে,
প্রথমতঃ পবিত্র কুরআন হচ্ছে মানুষের জন্য সদা-সতর্ককারী। বার বার সতর্ক করে এবং নানা বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ মহাগ্রন্থ মানুষকে উদাসীনতার আবর্ত ও ফাঁদগুলো থেকে রক্ষার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয়তঃ নবী-রাসূলদের জীবন যাপনের অবস্থা ছিল সাধারণ মানুষের মতই অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে। আর তাঁদের বিরোধীরা এই সাদাসিধে অবস্থাকেই অজুহাত দেখিয়ে বলত, আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রচারক ব্যক্তি এত হত-দরিদ্র ও সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত হন কি করে? অন্য সাধারণ মানুষ ও তাদের মধ্যে কী কোনো পার্থক্য আছে? এটা ঠিক যে, নবী-রাসূলরা অন্যদের মতই মানুষ ছিলেন, তবে পার্থক্য হল, তাঁদের কাছে আল্লাহর বাণী নাজেল হত।
তৃতীয়তঃ কাফেররা সত্যকে ও বাস্তবতাগুলোকে ঢেকে রেখে নিজেদের এবং অন্যদের ওপর জুলুম করত।
সূরা আম্বিয়ার চতুর্থ ও পঞ্চম আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَ رَبِّي يَعْلَمُ الْقَوْلَ فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (4) بَلْ قَالُوا أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ بَلِ افْتَرَاهُ بَلْ هُوَ شَاعِرٌ فَلْيَأْتِنَا بِآَيَةٍ كَمَا أُرْسِلَ الْأَوَّلُونَ (5)
“পয়গম্বর বললেনঃ নভোমন্ডল ও ভূমণ্ডলের সব কথাই আমার পালনকর্তা জানেন। তিনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন।” (২১:৪)
“বরং মুশরিকরা বলে, ‘এ (কুরআন) তো (উদ্বেগ-উৎসারিত) এলোমেলো স্বপ্নের সমষ্টি; (ওহি নয়) বরং সে (কুরআনকে আল্লাহর বাণী বলে দাবি করে আল্লাহর ওপর) মিথ্যারোপ করেছে; বরং সে একজন কবি; সুতরাং (সে যদি সত্য বলে থাকে) তার উচিত আমাদের জন্য এমন নিদর্শন বা মোজেজা আনা যেমনভাবে পূর্ববর্তীগণ (নবীগণ) প্রেরিত হয়েছিল।” (২১:৫)
যারা গোপনে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল এ আয়াতে রাসূল (সা.)'র পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়েছে, “তোমরা ভেব না যে তোমাদের কথা ও কাজগুলো আল্লাহর কাছে গোপন রয়েছে। বরং তিনি আকাশ ও জমিনগুলোতে তথা বিশ্ব চরাচরে যা ঘটছে তা জানেন ও দেখছেন। তাই এসব ষড়যন্ত্র বন্ধ কর।” কিন্তু ইসলাম বিরোধীরা উপদেশ গ্রহণের পরিবর্তে মহানবী (সা.)'র বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা ছড়িয়ে দেয়। তারা বিশ্বনবী (সা.)-কে অন্য অনেক কবির মতই একজন কবি বলে প্রচার করতে থাকে যিনি তার কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কথা বলেন এবং আল্লাহ সম্পর্কে নানা মিথ্যে কথা বলছেন। কিন্তু তাঁর উচিত এসবের পরিবর্তে অন্য নবী-রাসূলদের মতই অলৌকিক নিদর্শন দেখানো।
মহান আল্লাহ পরের আয়াতে ইসলাম বিরোধীদের এইসব বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন।
এ দুই আয়াতের দুটি শিক্ষা হল:
১- ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, অপবাদ ও প্রোপাগান্ডা ইসলামের শত্রুদের অন্যতম পন্থা।
২-শত্রুদের অপবাদগুলো ভিত্তিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ। যেমন, তারা মহানবী (সা.)-কে কবি বলে। অথচ কুরআনের সঙ্গে কবিতার কোনো মিলই নেই।
সূরা আম্বিয়ার ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
مَا آَمَنَتْ قَبْلَهُمْ مِنْ قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا أَفَهُمْ يُؤْمِنُونَ (6)
“তাদের আগে আমরা যেসব জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, সেইসব জনপদের অধিবাসীরা (মোজেজা দেখার পরও) বিশ্বাস স্থাপন করেনি; এখন এরা কি বিশ্বাস করবে?” (২১:৬)
মহান আল্লাহর একটি রীতি হল, অলৌকিক নিদর্শন দেখার পরও যারা ঈমান আনে না, তারা আল্লাহর গজব ও ক্রোধের শিকার হয়। যুগে যুগে এ ধরনের বহু জাতি ও গোত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ। আল্লাহ বলছেন মক্কার মুশরিকদের অবস্থাও একই রকম। অর্থাত কুরআনের মত এত বড় মুজিজা দেখার পরও তারা ঈমান আনছে না। বরং গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন রয়েছে এবং ইসলামের বিরোধিতা করছে।
এ আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:
১. অজুহাতকামীতা ও গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন হওয়া কাফির ও মুশরিকদের চিরাচরিত রীতি। কুফরির চেতনা বা প্রবণতা ও স্বার্থপরতা মানুষকে সত্য গ্রহণে বাধা দেয়।
২. কাফিরদের ওয়াদাগুলো মিথ্যা। তাদের দাবিগুলো মানা হলেও তারা ঈমান আনবে না।
সূত্রঃ তেহরান রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন