পঞ্চগড় জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শণীয় স্থানগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ
পঞ্চগড় জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শণীয় স্থানগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ
ক. ভিতরগড়ঃ
পঞ্চগড় শহর থেকে ১০ মাইল উত্তরে বাংলাদেশ- ভারত সীমান্ত বরাবর পঞ্চগড় সদর উপজেলাধীন অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত এই গড়। প্রাচীন কালে উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যেসব রাজ্যের কথা উল্লেখ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে পঞ্চগড়ের ভিতরগড় উল্লেখযোগ্য। আয়তনের দিক থেকে ভিতরগড় দূর্গানগরী ছিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ। প্রায় ১২ বর্গমাইল স্থান জুড়ে ভিতরগড়ের অবস্থান।
ভিতরগড় দূর্গ নির্মাণের সঠিক কাল নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এই দূর্গ একই সময়ে নির্মিত হয়নি। দূর্গের প্রাথমিক কাঠামোটি পৃথূ রাজা কর্তৃক আনুমানিক ৬ষ্ঠ শতকের দিকেই নির্মিত হয়। অতঃপর পাল বংশীয় রাজাদের দ্বারা এই অঞ্চল অধিকৃত ও শাসিত হওয়ার কালে গড়ের সম্প্রসারণ ঘটেছিল।
খ. মহারাজার দিঘীঃ
পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে পঞ্চগড় সদর উপজেলাধীন অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত একটি বড় পুকুর বর্তমানে যা মহারাজার দিঘী নামে পরিচিতি।
‘মহারাজার দিঘী’ একটি বিশালায়তনের জলাশয়। পাড়সহ এর আয়তন প্রায় ৮০০ Í৪০০ গজ। পানির গভীরতা প্রায় ৪০ ফুট বলে স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস। পানি অতি স্বচ্ছ। দিঘীতে রয়েছে মোট ১০টি ঘাট। ধারনা করা হয় পৃথু রাজা এই দিঘীটি খনন করেন। কথিত আছে পৃথু রাজা পরিবার-পরিজন ও ধনরত্ন সহ ‘কীচক’ নামক এক নিম্ন শ্রেণীর দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে তাদের সংস্পর্শে ধর্ম নাশের ভয়ে উক্ত দিঘীতে আত্মহনন করেন। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষে উক্ত দিঘীর পাড়ে মেলা বসে। উক্ত মেলায় কোন কোন বার ভারতীয় লোকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
এই বিশাল দিঘীর চারপাশে রয়েছে অনেক গাছগাছালির সবুজের কারুকার্য, স্নিগ্ধ সমীরণ, সৌম্য শান্ত পরিবেশ যা এখনো সবার কাছে বিরল মনে হয়।
গ. বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দিরঃ
বদেশ্বরী মন্দিরটি পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের দেঃভিঃ বদেশ্বরী মৌজার প্রায় ২.৭৮ একর জমিতে (মন্দির ও পার্শ্ববর্তী অংশসহ) অবস্থিত। হিন্দু ধর্মের ১৮টি পুরাণের মধ্যে স্কন্দ পুরাণ একটি। সেই স্কন্দ পুরাণে কশি উঃ ৮৮তে বর্ণিত আছে রাজা দক্ষ একটি যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। ভোলানাথ শিব রাজা দক্ষের জামাই ছিলেন। রাজা দক্ষ কখনই শিবকে জামাই হিসেবে মেনে নেননি। কারণ মহানবীর শিব সর্বদাই ছিলেন উদাসীন এবং নেশা ও ধ্যানগ্রস্ত। উক্ত যজ্ঞানুষ্ঠানে মুনি-ঋণিগণ ও অন্যান্য দেবতাগন নিমন্ত্রিত হলেও রাজা দক্ষের জামাই তথা দেবী দূর্গা (পার্বতী/মহামায়া) এঁর স্বামী ভোলানাথ শিব নিমন্ত্রিত ছিলেন না। এ কথা শিবের সহধর্মিনী জানা মাত্রই ক্ষোভে দেহত্যাগ করেন। শিব তাঁর সহধর্মিনীর মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে উন্মাদ হয়ে তাঁর সহধর্মিনীর শব দেহটি কাঁদে নিয়ে পৃথিবীর সর্বস্তরে উন্মাদের ন্যায় ঘরতে থাকেন এবং প্রলয়ের সৃষ্টি করেন। সে মুহুর্তে স্বর্গের রাজা বিষ্ণুদেব তা সহ্য করতে না পেরে স্বর্গ হতে একটি দুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করেন। চক্রের স্পর্শে শবদেহটি ৫২টি ঘন্ডে বিভক্ত হয়। শবের ৫২টি খন্ডের মধ্যে বাংলাদেশে পড়ে ০২টি খন্ড। একটি চট্ট্রগামের সীতাকুন্ডে এবং অপরটি পঞ্চগড় এর বদেশ্বরীতে।
মহামায়ার খন্ডিত অংশ যে স্থানে পড়েছে তাকে পীঠ বলা হয়। বদেশ্বরী মহাপীঠ এরই একটি। উক্ত মন্দিরের নাম অনুযায়ী বোদা উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে নির্মিত বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দিরটি এখন প্রত্নতাত্বিক ঐতিহ্যের নিদর্শন বহন করে।
ঘ. সমতল ভূমিতে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত চা বাগানঃ
পঞ্চগড় জেলার সদর ও তেঁতুলিয়া উপজেলায় সাম্প্রতিকালে সমতল ভূমিতে চা গাছের চাষাবাদ শুরু করা হয়েছে। সাধারণতঃ উচুঁ ভূমিতে চা চাষ হয়ে থাকে। কিন্তু সমতল ভূমিতে এর চাষাবাদ বাংলাশের এ এলাকাতেই প্রথম শুরু হয়। অর্থনৈতিকভাবে এর ভবিষ্য সম্ভাবনা খূবই উজ্জ্বল।
যেসব প্রতিষ্ঠান চা চাষে এগিয়ে এসেছে তার মধ্যে কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট, ডাহুক টি এস্টেট, স্যালিলেন টি এস্টেট, তেঁতুলিয়া টি কোম্পানী প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঙ. মির্জাপুর শাহী মসজিদঃ
মির্জাপুর শাহী মসজিদটি পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে অবস্থিত। ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে (সম্ভাব্য) নির্মিত ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত মসজিদের সাথে মির্জাপুর শাহী মসজিদের নির্মাণ শৈলীর সাদৃশ্য রয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হয় ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে অবস্থিত মসজিদের সমসাময়িক কালে এই মির্জাপুর শাহী মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। দোস্ত মোহম্মদ নামে এক ব্যক্তি এটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন মর্মে জানা যায়। সমজিদের নির্মাণ সম্পর্কে পারস্য ভাষায় লিখিত একটি ফলক রয়েছে মধ্যবর্তী দরজার উপরিভাগে। ফলকের ভাষা ও লিপি অনুযায়ী ধারণা করা হয় মোঘল সম্রা্ট শাহ আলমের রাজত্বকালে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। মসজিদটির দেওয়ালের টেরাকোটা ফুল এবঙ লতাপাতার নক্সা খোদাই করা আছে। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট প্রস্থ ২৫ ফুট এবং এক সারিতে ০৩ (তিন) টি গম্বুজ আছে।
মসজিদের নির্মাণ শৈলীর নিপুনতা ও কারুকার্যের জন্যই দর্শনার্থীদের এখনো আকৃষ্ট করে।
চ. বার আউলিয়ার মাজার
বার আউলিয়া মাজারটি পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বার আউলিয়া মৌজার প্রায় ৪৭.৭৩ একর জমিতে অবস্থিত। উক্ত স্থানে ০১টি মাদরাসা ও ১টি এতিম খানা আছে। ০২টি প্রতিষ্ঠান চলে মাজারের জমি হতে উৎপাদিত ফসলের আয় হতে। জানা যায় মধ্যপ্রাচ্য হতে ১২ জন আউলিয়া ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য উক্ত স্থানে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা ইন্তেকাল করলে উক্ত স্থানে তাঁদের সমাহিত করা হয়। ১২ জন আউলিয়াকে সমাহিত করায় এবং তাঁদের মাজার থাকায় এই স্থানের নাম হয় বার আউলিয়া। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ও পঞ্চগড় জেলা পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বার আউলিয়া মাজারটি পাকা করা হয়।
মাজার প্রাঙ্গণে জেলা পরিষদ কর্তৃক নির্মিত একটি ডাক বাংলো রয়েছে। প্রতি বৈশাখমাসের শেষ বৃহস্পতিবার এখানে ওরস মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান হতে অগনিত ভক্তের পদচারণায় মুখরিত থাকে ওরস মোবারকের দিনটি।
ছ. গোলকধাম মন্দিরঃ
গোলকধাম মন্দিরটি পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাংগা ইউনিয়নের শালডাংগা গ্রামে অবস্থিত। মন্দিরটি ১৮৪৬ সালে নির্মিত হয়। দেবীগঞ্জ উপজেলা সদর হতে প্রায় ১২ কিঃ মিঃ হতে উত্তর পশ্চিমে মন্দিরটি অবস্থিত।
মন্দিরটি অষ্টাদশ শতকের স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শণ। এ স্থাপত্য কৌশল গ্রীক পদ্ধতির অনুরূপ।
জ. তেঁতুলিয়া ডাক-বাংলোঃ
পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে একটি ঐতিহাসিক ডাক বাংলো আছে। এর নির্মাণ কৌশল অনেকটা ভিক্টোরিয়ান ধাচের। জানাযায় কুচবিহারের রাজা এটি নির্মাণ করেছিলেন।
ডাক-বাংলোটি জেলা পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত। এর পাশাপাশি তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ কর্তৃক নির্মিত একটি পিকনিক কর্ণার রয়েছে। উক্ত স্থান দুইটি পাশাপাশি অবস্থিত হওয়ায় সৌন্দর্য বর্ধনের বেশী ভূমিকা পালন করছে। সৌন্দর্য বর্ধনে এ স্থান দুটির সম্পর্ক যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষা ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন (অর্থাৎ নদী পার হলেই ভারত) সুউচ্চ গড়ের উপর সাধারণ ভূমি হতে প্রায় ১৫ হতে ২০ মিটার উচুতে ডাক-বাংলো এবং পিকনিক কর্ণার অবস্থিত।
তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্ণার
উক্ত স্থান হতে হেমন্ত ও শীতকালে কাঞ্চন জংঘার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বর্ষাকালে মহানন্দা নদীতে পানি থাকলে এর দৃশ্য আরও বেশী মনোরম হয়।
শীতকালে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য অনেক দেশী- বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটে।
ঝ. বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর ঃ
হিমালয়ের কোল ঘেঁষে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়া। এই উপজেলার ১নং বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে অবস্থিত বাংলাদেশ মানচিত্রের সর্বউত্তরের স্থান বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর। এই স্থানে মহানন্দা নদীর তীর ও ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় ১০.০০ একর জমিতে ১৯৯৭ সালে নির্মিত হয় বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর, যা আজও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু সম্ভব হয়নি। নেপালের সাথে বাংলাদেশর পণ্য বিনিময়ও সম্পাদিত হয় বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্টে।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর
উক্ত স্থান হতে হেমন্ত ও শীতকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য বেশ উপভোগ করা যায়। বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের স্থান বলেই শীতকালে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশী-বিদেশী অনেক পর্যটকের আগমন ঘটে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে।
ঞ. রকস্ মিউজিয়ামঃ
পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ চত্ত্বরে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক এর প্রচেষ্টায় রকস্ মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
উক্ত মিউজিয়ামে পঞ্চগড় জোর প্রত্নতাত্ত্বিক ও লোকজ সংগ্রহ রয়েছে প্রায় ১,০০০ (একহাজার) সংখ্যক এরও বেশী।
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন