সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৮১-৮৪ (পর্ব-১৪)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৮১-৮৪ (পর্ব-১৪)
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৮১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেছেন:
كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَلَا تَطْغَوْا فِيهِ فَيَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبِي وَمَنْ يَحْلِلْ عَلَيْهِ غَضَبِي فَقَدْ هَوَى (81)
“তোমাদের যে উত্‌কৃষ্ট জীবিকা দান করলাম, তা হতে খাও এবং এ বিষয়ে (আল্লাহর নির্ধারিত) সীমালঙ্ঘন কর না, করলে তোমাদের ওপর আমার ক্রোধ পতিত হবে এবং যার ওপরে আমার ক্রোধ পতিত হয়, সে তো ধ্বংস হয়ে যায়।” (২০:৮১)
আগের আসরে আমরা বলেছি, মহান আল্লাহ বিভিন্নভাবে হযরত মুসা (আ.) এর অনুসারীদের সহায়তা করেন। তিনি বনী ইসরাইল জাতিকে অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেন। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তা থেকে খাও এবং পান কর। পাক-পবিত্র ও হালাল খাবার খাও কিন্তু কখনো আল্লাহর অবাধ্য হয়ে তার কঠোর নিষেধ লঙ্ঘনের চেষ্টা কর না। আল্লাহর নেয়ামত ভোগে সীমালঙ্ঘনের অর্থ হলো, আল্লাহর দান নিজের উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে কাজ লাগানোর পরিবর্তে আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। সীমা লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে দেয় এবং তাঁর পক্ষ থেকে সে ব্যক্তির উপর কঠিন শাস্তি নেমে আসে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টির ওপর গভীরভাবে দৃষ্টি দিয়েছে। সেইসঙ্গে হালাল-হারাম মেনে চলতে বলেছে।
২. আল্লাহর দেয়া নেয়ামত পাপকাজ ও তাঁর অবাধ্যতার কাজে ব্যয় করলে সৃষ্টিকর্তার ক্রোধের শিকার হতে হয়। আর তাঁর ক্রোধের শিকার হওয়ার অর্থ ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِمَنْ تَابَ وَآَمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَى (82)
“নিশ্চয়ই আমি তাকে ক্ষমা করব যে তওবা করে, বিশ্বাস স্থাপন করে, সত্‌কাজ করে ও সত্‌পথে অবিচলিত থাকে।” (২০:৮২)
আগের আয়াতে গোনাহগার ও পাপী বান্দার শাস্তির কথা উল্লেখের পর এই আয়াতে এই পাপী বান্দাদেরই জন্য নিজের রহমতের দরজা খুলে দেয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন মহান আল্লাহ। তিনি বলছেন, আল্লাহর আজাব নেমে আসার আগে তওবা করার সুযোগ রয়েছে। কেউ যদি নিজের পাপকাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, সত্‌কাজ করে, আল্লাহর নির্দেশিত হালাল-হারাম মেনে চলে এবং ঈমানের পথে অটল থাকে তাহলে আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন এবং তার প্রতি রহমত নাজিল করেন।
এখানে মনে রাখতে হবে, নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে তওবা'র প্রথম শর্ত। তবে এটিই একমাত্র শর্ত নয়। মানুষের চিন্তা ও কাজেকর্মে এই অনুশোচনার প্রভাব থাকতে হবে এবং দেখাতে হবে যে, সে সঠিক পথে হেদায়েত লাভ করেছে এবং এই পথে সে অটল রয়েছে।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে :
১. আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থায় হুমকির পাশাপাশি পুরস্কারের সুসংবাদ এবং পাপকাজের শাস্তি দেয়ার ঘোষণার পাশাপাশি মহাসাফল্যের আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
২. ইসলামে আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নিরাশ হওয়া কবিরাহ গোনাহ বা মস্তবড় পাপ। মনে রাখতে হবে, যে কোনো অবস্থায় অনুতপ্ত হয়ে কেউ যদি আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসে, তাহলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন।
সূরা ত্বোয়া-হা'র ৮৩ ও ৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا أَعْجَلَكَ عَنْ قَوْمِكَ يَا مُوسَى (83) قَالَ هُمْ أُولَاءِ عَلَى أَثَرِي وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَى (84)
“হে মুসা! তোমার সম্প্রদায়কে পেছনে ফেলে তোমাকে তাড়াহুড়া করতে বাধ্য করল কিসে?” (২০:৮৩)
“সে বলল- এই তো ওরা আমার পেছনেই রয়েছে। হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাড়াহুড়া করে ছুটে এসেছি।” (২০:৮৪)
এ আয়াতে হযরত মুসা (আ.) ও বনী ইসরাইল জাতির ঘটনাপ্রবাহের আরেকটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য স্থানে এসেছে, কথা ছিল হযরত মুসা (আ.) তাওরাত গ্রন্থ গ্রহণের জন্য তুর পাহাড়ে যাবেন এবং এ সময় বনী ইসরাইল গোত্রের নেতৃস্থানীয় কিছু লোকও তাঁর সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করার জন্য হযরত মুসা এত বেশি অধীর হয়ে পড়েন যে, তিনি পথিমধ্যে খাওয়া ও ঘুমের কথা ভুলে যান এবং সঙ্গীসাথীদের ত্যাগ করে সবার আগে তুর পাহাড়ে পৌঁছে যান। তার সঙ্গী বনী ইসরাইলের লোকজনের অত তাড়া না থাকায় তারা স্বাভাবিক গতিতে খাওয়া দাওয়া ও প্রয়োজনীয় বিশ্রাম করতে করতে আসছিলেন।
যাই হোক, হযরত মুসা তুর পাহাড়ে পৌঁছে গেলেন। যদিও কথা ছিল, তুর পাহাড়ে এক মাস অবস্থান করার পর তাঁকে তাওরাত গ্রন্থ দেয়া হবে কিন্তু পরবর্তীতে এ সময়সীমা ১০ দিন বাড়ানো হয়। এ কারণে মোট ৪০ দিন তিনি বনী ইসরাইল জাতির কাছ থেকে দূরে অবস্থান করেছিলেন। এই আয়াতে তুর পাহাড়ে মহান আল্লাহর সঙ্গে হযরত মুসার ঘনিষ্ঠ কথোপকথনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। হযরত মুসা তার তাড়াহুড়ার কারণ হিসেবে আল্লাহর প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে অধীর আগ্রহের কথা তুলে ধরেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ এ ধরনের ভালোবাসা অনুভব করেনি বলে তাদের মধ্যে সে ধরনের আকাঙ্ক্ষাও জেগে ওঠেনি।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. দুনিয়াবি কাজকর্মে অনেক সময় তাড়াহুড়া করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু এই আয়াতে দেখা যাচ্ছে সত্‌কাজ- বিশেষ করে আল্লাহকে খুশি করার কাজে তাড়াহুড়া করা ইতিবাচক হিসেবে কবুল করেন মহান আল্লাহ।
২. সমাজের নেতাকে সত্‌কাজে অগ্রগামী হতে হয় যাতে সাধারণ মানুষও সত্কাজে উদ্বুদ্ধ হয়।
৩. আল্লাহর কাছে মুনাজাত করা ও তার সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করার মধ্যে বিশেষ আনন্দ-অনুভূতি রয়েছে। কেবলমাত্র নবী-রাসূলরাই সে আনন্দ উপভোগ করেন।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন