সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৪৩-৪৮ (পর্ব-৭)
সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৪৩-৪৮ (পর্ব-৭)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৪৩ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى (43) فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى (44)
“তোমরা দু’জনে ফেরাউনের কাছে যাও, সে সীমালঙ্ঘন করেছে।”(২০:৪৩)
“তোমরা তার সঙ্গে নম্র কথা বলবে হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে (এবং অত্যাচার থেকে বিরত থাকবে)।” (২০:৪৪)
নবুওয়াত পাওয়ার পর হযরত মুসা (আ.) ও তার ভাই হারুনকে আল্লাহ সবার আগে যে দায়িত্ব দিলেন তা হলে প্রতাপশালী রাজা ফেরাউনের কাছে তাঁর একত্ববাদের বার্তা নিয়ে যেতে হবে এবং তাকে জুলুম ও অত্যাচার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতে হবে। যে দেশে ফেরাউনের মতো অত্যাচারী শাসক শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সেই দেশে সংস্কারের কাজ শুরু করতে হবে রাজাকে দিয়েই। কারণ, সব সংকট ও অনাচারের হোতা হচ্ছে রাজা। তার অনুমতি ছাড়া নিচের দিকে কোনো সংস্কার আনতে গেলে সে বাধা দেবে। আর বাধা না দিলেও নিচের দিকে শুরু করা সংস্কার তেমন কোনো কাজে আসবে না।
স্বাভাবিকভাবেই দাওয়াতের কাজ করতে হবে নম্র ভাষায় ও ভদ্র ব্যবহারের মাধ্যমে। কারণ এতে করে দ্রুত ফল পাওয়া যায়। যাকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, সে হয় যুক্তিসঙ্গত কথা মেনে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে অথবা অন্তত জুলুম ও অত্যাচার থেকে বিরত থাকবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. নবী-রাসূলরা সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে কখনই দূরে ছিলেন না। সমাজ ও রাষ্ট্রকে অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্ত করার জন্যই তারা পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
২. দাওয়াতি কাজ করতে হবে নম্র ও ভদ্রভাবে। আমাদের কথা সত্যের পক্ষে হলেও আচরণ ভালো না হলে তা কেউ গ্রহণ করবে না।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৪৫ ও ৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالَا رَبَّنَا إِنَّنَا نَخَافُ أَنْ يَفْرُطَ عَلَيْنَا أَوْ أَنْ يَطْغَى (45) قَالَ لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى (46)
“তারা বলল- হে আমার প্রতিপালক! আমরা আশঙ্কা করি, সে আমাদের যাওয়া মাত্র শাস্তি দেবে অথবা অন্যায় আচরণে সীমালঙ্ঘন করবে।”(২০:৪৫)
“আল্লাহ বললেন- তোমরা ভয় কর না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি (তোমাদের সব কাজ ও কথা) শুনি ও দেখি।” (২০:৪৬)
স্বাভাবিকভাবেই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হয়ে দাঁড়ানোর সাহস সে যুগে কেউ করত না। তার ওপর যদি তাকে অত্যাচার বন্ধ করে সত্পথে ফিরে আসার আহ্বান জানানোর জন্য সেই দরবারের যাওয়ার নির্দেশ আসে- তাহলে তা পালন করতে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহর দুই নবীকে কথা শুরু করতে দেয়ার আগেই গ্রেফতার করে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হতে পারে অথবা দরবারেই তাদেরকে হত্যা করা হতে পারে। সেইসঙ্গে এর ফল হিতে-বিপরীত হতে পারে এবং বনী-ইসরাইল জাতির ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। কাজেই হযরত মুসা ও তার ভাই হারুন যুক্তিসঙ্গতভাবেই আল্লাহর কাছে তাদের এ আশঙ্কার কথা জানালেন। আল্লাহও তাদেরকে এই নিশ্চয়তা দেন যে, আমি নিজে তোমাদের সঙ্গে আছি এবং তোমাদেরকে সহযোগিতা করব। ফেরাউন তোমাদেরকে যা বলবে ও তোমাদের সঙ্গে যে আচরণ করবে তা আমি দেখবো ও শুনবো। কাজেই এ ব্যাপারে ভয় পেয়ো না।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১. যে কোনো কাজে নামার আগে এর ভবিষ্যত ফলাফল সম্পর্কে ধারণা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে হবে।
২. সমস্যা সঙ্কুল কাজে এবং কঠিন মুহূর্তগুলোতে ‘আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন’- এই অনুভূতি মু’মিন বান্দাকে শক্তি ও সাহস যোগায়।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৪৭ ও ৪৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
فَأْتِيَاهُ فَقُولَا إِنَّا رَسُولَا رَبِّكَ فَأَرْسِلْ مَعَنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَا تُعَذِّبْهُمْ قَدْ جِئْنَاكَ بِآَيَةٍ مِنْ رَبِّكَ وَالسَّلَامُ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى (47) إِنَّا قَدْ أُوحِيَ إِلَيْنَا أَنَّ الْعَذَابَ عَلَى مَنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّى (48)
“কাজেই তোমরা তার কাছে যাও এবং বল- আমরা তোমার প্রতিপালকের রাসূল, কাজেই আমাদের সঙ্গে বনী-ইসরাইলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিও না। আমরা তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে নিদর্শন এনেছি এবং যারা সত্পথ অনুসরণ করে তাদের প্রতি রয়েছে শান্তি।” (২০:৪৭)
“আমাদের প্রতি ওহি পাঠানো হয়েছে, যে ব্যক্তি মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয় তার জন্য রয়েছে শাস্তি।” (২০:৪৮)
এ দুই আয়াতে আল্লাহ আবারো তাঁর দুই নবীকে ফেরাউনের দরবারে যাওয়ার আদেশ দেন এবং ফেরাউনকে কী কী কথা বলতে হবে তা শিখিয়ে দেন। সবার আগে ফেরাউনের খপ্পর থেকে বনি-ইসরাইল জাতিকে মুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর আদেশ ও অলৌকিক ক্ষমতাগুলো দেখিয়ে ফেরাউনকে সত্য গ্রহণের জন্য উত্সাহিত করার পাশাপাশি শাস্তির ভয় দেখাতে হবে। আল্লাহর আদেশ মেনে নিলে শান্তি পাওয়া যাবে এবং তা প্রত্যাখ্যান করে মুখ ফিরিয়ে নিলে থাকবে আল্লাহর ক্রোধ ও কঠোর শাস্তি।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, হযরত মুসা (আ.)কে ফেরাউনের দরবারে গিয়ে প্রথমেই নির্যাতিত ও অসহায় মানুষের পক্ষে কথা বলতে হবে এবং তাদেরকে উদ্ধারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। অথচ আমরা যতটুকু ভাবতে পারি তা হচ্ছে, আল্লাহর দুই নবী ফেরাউনকে আল্লাহর একত্ববাদ মেনে নিতে এবং শিরক ও কুফরি থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানাবেন। কিন্তু আল্লাহর এ আদেশ থেকে বোঝা যায়, মুসলিম সমাজের নেতাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব জনগণের সেবা করা। হযরত মুসাকে বলা হয়েছে, ফেরাউন ঈমান না আনলেও অন্তত জনগণের ওপর চালানো অত্যাচার হয়তো বন্ধ করবে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. ইসলাম প্রচারের কাজে সবার আগে সমাজের অধিপতিদের কাছে যেতে হবে। কারণ, সমাজপতিরা সত্পথে ফিরে আসলে সাধারণ মানুষকে একত্ববাদের দিকে আহ্বান করা সহজ হয়ে যায়।
২. অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করা ছিল নবী-রাসূলদের প্রধান কাজ।
৩. ব্যক্তি ও সমাজের সুস্থতা ও নিরাপত্তা আল্লাহর নির্দেশ পালনের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। আল্লাহর নির্দেশের বিরোধিতা করলে এ পৃথিবীতে নানা বিপদ-আপদের পাশাপাশি পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন