সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৩৭-৪২(পর্ব-৬)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ৩৭-৪২(পর্ব-৬)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৩৭ থেকে ৩৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَقَدْ مَنَنَّا عَلَيْكَ مَرَّةً أُخْرَى (37) إِذْ أَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّكَ مَا يُوحَى (38) أَنِ اقْذِفِيهِ فِي التَّابُوتِ فَاقْذِفِيهِ فِي الْيَمِّ فَلْيُلْقِهِ الْيَمُّ بِالسَّاحِلِ يَأْخُذْهُ عَدُوٌّ لِي وَعَدُوٌّ لَهُ وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِنِّي وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِي (39)
“(হে মুসা!) আমি আরেকবার তোমাকে করুণা করেছি।”(২০:৩৭)
“যখন আমি তোমার মায়ের প্রতি ইঙ্গিতের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ করেছিলাম।”(২০:৩৮)
“এই মর্মে যে, তোমার শিশু মুসাকে সিন্দুকে ঢুকিয়ে নীল নদে ভাসিয়ে দাও। বাক্সটি নদীর তীরে পৌঁছালে আমার ও তোমার শত্রু তাকে তুলে নেবে এবং আমি আমার পক্ষ থেকে তোমার ব্যাপারে (ফেরাউনের মনে) ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিলাম যাতে আমার নজরদারিতে তুমি প্রতিপালিত ও বড় হও।” (২০:৩৯)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, মুসা (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরাউনকে সতপথে ফিরিয়ে আনার দাওয়াতি কাজের দায়িত্ব পাওয়ার পর মহান আল্লাহ তার ভাই হারুনকে তার সঙ্গী নির্ধারণ করেন এবং তার সবগুলো আবেদন কবুল করেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, এর আগেও আমরা তোমাকে ফেরাউনের প্রাসাদে পৌঁছে যেতে সাহায্য করেছি। সে সময়ে তুমি ছিলে নবজাতক এবং ফেরাউন তার দেশের সব নবজাতককে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। আমি তোমার মায়ের অন্তরে এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছি যে, তাকে একটি সিন্দুকে ঢুকিয়ে নীল নদে ভাসিয়ে দাও। এরপর নীল নদকে নির্দেশ দিয়েছি সে যেন সিন্দুকটিকে ফেরাউনের প্রাসাদের ঘাটে পৌঁছে দেয়। ঠিক সে সময় ফেরাউন ও তার স্ত্রীকে নদীর ঘাটে নিয়ে এসেছি যাতে তারা তোমাকে দেখতে পায়। ফেরাউন তোমাকে দেখে কোলে তুলে নেয় এবং নিজের পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে। এভাবেই ফেরাউনের মাধ্যমে তার শত্রুর প্রতিপালন করাই। এ সব কাজই হয়েছে আমার প্রত্যক্ষ নজরদারিতে। আমি আমার বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহে তোমার জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছি।
এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. আল্লাহর পক্ষে সব কাজ করা সম্ভব। যে ফেরাউন মুসাকে ভূমিষ্ঠ হতে দিতে চায়নি, সেই ফেরাউন আল্লাহর ইচ্ছায় নিজে কাঁধে পিঠে করে মুসা (আ.)কে বড় করে তুলেছে।
২. মহান আল্লাহর একটি রীতি হলো, তিনি ওলি-আউলিয়াদের ব্যাপারে মানুষের অন্তরে ভালোবাসা তৈরি করে দেন।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِذْ تَمْشِي أُخْتُكَ فَتَقُولُ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَنْ يَكْفُلُهُ فَرَجَعْنَاكَ إِلَى أُمِّكَ كَيْ تَقَرَّ عَيْنُهَا وَلَا تَحْزَنَ وَقَتَلْتَ نَفْسًا فَنَجَّيْنَاكَ مِنَ الْغَمِّ وَفَتَنَّاكَ فُتُونًا فَلَبِثْتَ سِنِينَ فِي أَهْلِ مَدْيَنَ ثُمَّ جِئْتَ عَلَى قَدَرٍ يَا مُوسَى (40)
“যখন তোমার বোন (ফেরাউনের প্রাসাদে) যেত ও বলত, এমন একজন নারীর কথা আপনাদের জানাব কি যে এই নবজাতককে প্রতিপালন করতে পারবে? এভাবে আমি তোমাকে তোমার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিলাম যাতে তার চোখ জুড়িয়ে যায় এবং দুঃখ না পায়। এবং তুমি (ফেরাউনদের) একজনকে হত্যা করেছিলে, এরপর আমি তোমাকে মনকষ্ট থেকে মুক্তি দেই। আমি তোমাকে বহু পরীক্ষা করেছি। এরপর তুমি কয়েক বছর মাদায়েনবাসীর মধ্যে ছিলে, হে মুসা! এরপর তুমি নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলে।” (২০:৪০)
হযরত মুসা (আ.) এর জীবনে কয়েকজন নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের একজন হলেন তার মা যিনি আল্লাহর অদৃশ্য ইশারায় নিজ সন্তানকে সিন্দুকে ঢুকিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। আরেকজন হলেন তার বোন যিনি ফেরাউনের দরবারে গিয়ে নিজের মাকে মুসার দাই মা হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেন। হযরত মুসার স্ত্রীও জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোতে তাকে সঙ্গ দিয়েছেন। অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া হযরত মুসার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি নবজাতক মুসাকে হত্যা করতে নিষেধ করে তার জীবন বাঁচান এবং পরবর্তীতে তার প্রতি ঈমান আনেন।
অবশ্য আল্লাহ-তায়ালা হযরত মুসা (আ.)কে বনী ইসরাইল জাতির নেতা নিযুক্ত করবেন বলে তাঁকে নানা ধরনের কষ্ট ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে বড় করে তোলেন। এর ফলে এ মহান দায়িত্ব পালন করতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি। এরপর তিনি হযরত মুসাকে মিশরে ফিরিয়ে আনেন। যুব বয়সে হযরত মুসার জীবনে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। একদিন পথিমধ্যে তিনি দু’ব্যক্তিকে ঝগড়া করতে দেখেন। এদের একজন ছিল বনী ইসরাইল গোত্রের এবং অন্যজন ছিল ফেরাউনের অনুসারী। বনী ইসরাইল গোত্রের লোকটি ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং সে হেরে যাচ্ছিল। হযরত মুসা এ অবস্থা দেখে ফেরাউনের অনুসারী লোকটিকে লক্ষ্য করে প্রচণ্ড ঘুষি মেরে দেন এবং এর ফলে তাতক্ষণিকভাবে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর হত্যার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে তিনি মিশর থেকে পালিয়ে মাদায়েন চলে যান এবং সেখানে আল্লাহর আরেক নবী হযরত শোয়াইব (আ.) এর মেয়েকে বিয়ে করেন। হযরত মুসার এ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি সূরা কাসাসে এসেছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হল:
১. আল্লাহর কাছে মায়ের মর্যাদা অপরিসীম। এ কারণে তিনি হযরত মুসাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন যাতে তার মা মনে প্রশান্তি পান।
২. আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে মহান দায়িত্ব অর্পণের আগে কঠিন কিছু পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন আল্লাহ।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَاصْطَنَعْتُكَ لِنَفْسِي (41) اذْهَبْ أَنْتَ وَأَخُوكَ بِآَيَاتِي وَلَا تَنِيَا فِي ذِكْرِي (42)
“আমি তোমাকে আমার নিজের জন্য তৈরি করেছি এবং বড় করে তুলেছি।”(২০:৪১)
“এখন তুমি ও তোমার ভাই আমার আয়াত ও মুজিযাসহ (ফেরাউনের কাছে) যাও এবং রিসালাতের দায়িত্ব পালনে অবহেলা কর না।” (২০:৪২)
আল্লাহ-তায়ালা এ দুই আয়াতে তাঁর রাসূল হযরত মুসার প্রতি নিজের চরম দয়া ও ভালোবাসার কথা উল্লেখ করে বলছেন, এতদিন যত কষ্ট করেছো তার উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে আমার ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত করা। এখন সে মহান দায়িত্ব পালনের সব উপকরণ ও ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এবার তুমি তোমার ভাইকে নিয়ে ফেরাউনের কাছে গিয়ে আমার একত্ববাদের বাণী পৌঁছে দাও এবং তাকে অলৌকিক ক্ষমতাগুলো দেখাও। কিন্তু এ কাজে অবহেলা কর না। আমি পুরো সময় ধরে তোমার সঙ্গেই রয়েছি।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হল:
১. নবী-রাসূলরা সাধারণ মানুষ ছিলেন না যে তাদের প্রতি আল্লাহ মহান দায়িত্ব অর্পন করবেন, বরং তারা জন্ম থেকেই রিসালাতের দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থায় প্রতিপালিত ও বড় হয়েছেন।
২. আল্লাহর আদেশ নিষেধের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখা ও তা মেনে চলা ছিল তাঁর প্রেরিত পুরুষদের সাফল্যের চাবিকাঠি। এ কারণে তারা যে কোনো নির্দেশ বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যান এবং কোনো কিছুকেই ভয় করেন না।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন