সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১৯-২৪ (পর্ব-৪)
সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১৯-২৪ (পর্ব-৪)
সূরা ত্বোয়া-হা’র ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন:
) قَالَ أَلْقِهَا يَا مُوسَى (19) فَأَلْقَاهَا فَإِذَا هِيَ حَيَّةٌ تَسْعَى (20) قَالَ خُذْهَا وَلَا تَخَفْ سَنُعِيدُهَا سِيرَتَهَا الْأُولَى (21)
“(আল্লাহ বললেন,) হে মুসা! তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর।” (২০:১৯)
“মুসা লাঠি নিক্ষেপ করল, হঠাত (লাঠিটি) সাপে পরিণত হয়ে দৌড়াতে লাগল।” (২০:২০)
“(আল্লাহ) বললেন: ওটাকে ধর এবং ভয় পেয়ো না, আমরা ওটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনছি।” (২০:২১)
গত আসরে আমরা বলেছি, মাদায়েন থেকে মিশরে ফেরার পথে ত্বোয়া নামক উপত্যকার তুর পাহাড়ে হযরত মুসা (আ.) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন এবং মহান আল্লাহ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। আল্লাহ-তায়ালা হযরত মুসাকে রিসালাতের দায়িত্য দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর ক্ষমতাও দিয়ে দেন যাতে এগুলোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তার নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। এই তিন আয়াতে হযরত মুসাকে দেয়া প্রথম মুজিযা বা অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটি হচ্ছে তাঁর হাতের লাঠিটি সাপে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা।
খুব স্বাভাবিকভাবেই হযরত মুসা (আ.) প্রথমবারের মতো লাঠিকে সাপ হতে দেখে ভয় পেয়েছিলেন এবং নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ, আল্লাহ আগে থেকে তাঁকে বলেননি যে, কেন তাঁর হাতের লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করতে বলা হচ্ছে।
অবশ্য নিজের লাঠি থেকে পরিণত হওয়া সাপ দেখে হযরত মুসার এই ভয় পেয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, এ অলৌকিক ক্ষমতাটি আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া। কারণ, জাদুকররাও এ রকম বহু সাপ তৈরি করে কিন্তু তারা নিজেদের তৈরি সাপ দেখে ভয় পায় না। তাদের ভয় না পাওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে এটি তৈরি করেছে এবং এটি কীভাবে সাপ হয়েছে তা তাদের জানা। অন্যদিকে নবী-রাসূলদের হাতে সংঘটিত অলৌকিক ঘটনাগুলোতে তাদের কোনো হাত ছিল না এবং এগুলো ঘটতো সম্পূর্ণ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইচ্ছায়
এ তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
১. জীবন দান ও তা ফিরিয়ে নেয়া আল্লাহর ক্ষমতার অংশ। জীবন্ত সাপকে আবার মৃত লাঠিতে পরিণত করা আল্লাহর জন্য মোটেই কঠিন কাজ নয়।
২. মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দেয়ার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। হযরত মুসা যেহেতু অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের সামনে নিজের লাঠিকে বিশাল অজগরে পরিণত করবেন, তাই এ ধরনের দৃশ্য তার আগে থেকে দেখার অভ্যাস থাকতে হবে।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَاضْمُمْ يَدَكَ إِلَى جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَيْضَاءَ مِنْ غَيْرِ سُوءٍ آَيَةً أُخْرَى (22) لِنُرِيَكَ مِنْ آَيَاتِنَا الْكُبْرَى (23)
“এবং তোমার হাত তোমার বগলে রাখ; এটি অপর এক নিদর্শনস্বরূপ নির্মল উজ্জ্বল হয়ে বের হয়ে আসবে।” (২০:২২)
“এটি এজন্য যে, আমি তোমাকে আমার মহা নিদর্শনগুলির কিছু দেখাব।” (২০:২৩)
মহান আল্লাহ দ্বিতীয় যে মুজিযাটি হযরত মুসাকে সেই প্রথমেই শিখিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে তাঁর ধবধবে সাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা। তিনি যখনই নিজের হাত তার বগলে প্রবেশ করাতেন এবং হাত বের করে আনতেন তখনই আল্লাহর ইচ্ছায় তার শরীর ধবধবে সাদা হয়ে যেত এবং শরীর থেকে আলোর জ্যোতি বের হতো। এটি কোনো রোগ ছিল না। কিন্তু ইহুদিরা বর্তমানে তাওরাত গ্রন্থে এত বেশি বিকৃত এনেছে যে, তাতে লেখা রয়েছে, হযরত মুসা (আ.) এর শ্বেতী রোগ হয়েছিল। অথচ পবিত্র কুরআন বলছে, এটি কোনো রোগ ছিল না বরং এটি ছিল আল্লাহর অলৌকিক নিদর্শন।
এ দু’ট অলৌকিক ঘটনা ছাড়াও হযরত মুসা আরো অনেক মুজিযা জানতেন যা তিনি বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করেছেন। তবে এই দু’টি ছিল আল্লাহর ইচ্ছায় তার সবচেয়ে বড় অলৌকিক ক্ষমতা।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. আল্লাহর ক্ষমতা অসীম, তিনি যখন যা ইচ্ছা করেন তখনই তা হয়ে যায়।
২. মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়ার আগে নবী-রাসূলরা আল্লাহর আয়াতের নিদর্শন দেখে নিতেন যাতে নিশ্চিন্ত মনে দাওয়াতি কাজ করতে পারেন।
সূরা ত্বোয়া-হা’র ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
اذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى (24)
“(হে মুসা!) এবার তুমি ফেরাউনের কাছে যাও। সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে।” (২০:২৪)
নবুওয়াত পাওয়ার পর প্রথম যে দায়িত্বটি হযরত মুসা (আ.) পেয়েছিলেন তা হলো তখনকার পরাক্রমশালী রাজা ফেরাউনের কাছে একত্ববাদের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। সে সময় ফেরাউন নিজেকে জনগণের প্রভু বলে দাবি করত। সেইসঙ্গে জনগণকে নিজের ভৃত্য তৈরি করে নিজেকে তাদের মালিক বলে মনে করত।
সাধারণভাবে নবী-রাসূলরা অতি সাধারণ মানুষের কাছে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে তাদের দাওয়াতি কাজ শুরু করতেন। সে নিয়ম অনুযায়ী হযরত মুসাকে মিশরের সাধারণ মানুষের কাছে পাঠানো উচিত ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ তা না করে তাঁকে সোজা সেই ফেরাউনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন, যে ফেরাউন সব ধরনের নিষেধাজ্ঞার সীমালঙ্ঘন করেছিল।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, যে সমাজের মানুষ বন্দি অবস্থায় ক্রীতদাসের জীবনযাপন করে এবং তাদের নিজেদের করার কোনো ক্ষমতা থাকে না, সে সমাজে নবী-রাসূলরা প্রথমে জনগণের কাছে না গিয়ে তাদের অত্যাচারী শাসকের কাছে আল্লাহর বাণী নিয়ে হাজির হতেন। তারা ওই শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সমাজে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন।
একটি ক্ষয়িষ্ণু সমাজে সংস্কার আনার জন্য এর কাফের ও পাপাচারি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কারণ, সমাজের অধিপতিকে সংস্কার করা না গেলে বা তার হাত থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে না পারলে জনগণকে আল্লাহর রাস্তায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ফেরাউনের অত্যাচারে মিশরের সমাজ সব ধরনের নৈতিক ও মানবিক গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে একটি পাশবিক সমাজে পরিণত হয়েছিল। ফেরাউন মহান আল্লাহর সঙ্গে নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল।
আয়াতুল কুরসিতেও খোদাদ্রোহী শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকে ঈমানের পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় যুগে যুগে নবী-রাসূল এবং ওলি আউলিয়ারা অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তাদের অনেকে এ রাস্তায় নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
১. রাজনীতি থেকে ধর্ম আলাদা নয়। নবী-রাসূলরা মানুষকে হেদায়েত করার জন্য অত্যচারী রাজা-বাদশাহদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
২. খোদাদ্রোহী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা নেতৃত্বে থাকবেন এবং সাধারণ মানুষ তাদেরকে অনুসরণ করবে। কারণ, এটি একটি ধর্মীয় দায়িত্ব, রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ করার বিষয় নয়।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন