সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১-৬ (পর্ব-১)

সূরা ত্বোয়া-হা; আয়াত ১-৬ (পর্ব-১)
ত্বোয়া-হা পবিত্র কুরআনের ২০তম সূরা। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরার আয়াত সংখ্যা ১৩৫। এ সূরার ১ ও ২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
طه (1) مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآَنَ لِتَشْقَى (2)
“ত্বোয়া-হা।” (২০:১)
“তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করিনি।” (২০:২)
এটি কুরআনের সেই ২৯টি সূরার একটি যে সব সূরা ‘মুকাত্তায়া হরফ’ দিয়ে শুরু হয়েছে। যেমনটি সূরা বাকারা শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মিম এবং সূরা আ’রাফ শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মিম, সোয়াদ দিয়ে। ওই দু’টি সূরার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এই অক্ষরগুলো আল্লাহ ও তার রাসূলের মধ্যকার কোনো গোপন রহস্য যা অন্য কারো জানা নেই। এই অক্ষরগুলোর মাধ্যমে কুরআনের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বও ফুটে ওঠে, অর্থাৎ আল্লাহ-তায়ালা যেন কুরআনের অলৌকিতা এসব অক্ষরের মাধ্যমে মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ যখনই ইচ্ছে করবেন তখনই এর অর্থ মানুষ উপলব্ধি করবে। তখন হয়তো আল্লাহ-তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্র কুরআনের ক্ষমতা মানুষের সামনে আরো বেশি স্পষ্ট হবে। অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় এসব মুকাত্তায়া হরফের কিছু রহস্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

যেমন আজ যে সূরাটি আমরা শুরু করেছি সেটি আরবি বর্ণমালার দু’টি হরফ ত্বোয়া ও হা দিয়ে শুরু হয়েছে এবং এ কারণে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে ‘ত্বোয়া-হা’। বর্ণনায় এসেছে, ‘ত্বোয়া-হা’ হচ্ছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.) এর একটি গোপন নাম। এ কারণে এ সূরার দ্বিতীয় আয়াতেই বিশ্বনবীকে উদ্দেশ করে বক্তব্য শুরু করেছেন মহান আল্লাহ। ধরে নেয়া যায়, প্রথম আয়াতে ‘হে মুহাম্মাদ’ না বলে আল্লাহ ‘ত্বোয়া-হা’ সম্মোধন করেছেন। এরপর রাসূলুল্লাহকে বলছেন, এই কুরআন আপনার ওপর নাজিল করেছি যাতে আপনি কষ্ট সহ্য করেন। কষ্ট বলতে এখানে কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি তা প্রচারের কষ্টের কথা বোঝানো হয়েছে।

হাদিসে এসেছে, বিশ্বনবী রাত জেগে এত বেশি নামাজ পড়তেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করতেন যে, তার পা দু’টো ফুলে উঠতো এবং তিনি কষ্ট পেতেন। এ ছাড়া, ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করতে গিয়ে তিনি এত বেশি আন্তরিকতা ও ভালোবাসা নিয়ে মানুষের মাঝে কাজ করতেন যে তাকে ভীষণ শারীরিক পরিশ্রম করতে হতো। এ অবস্থা দেখে মহান আল্লাহ এই আয়াতের পাশাপাশি আরো অনেক আয়াতে বিশ্বনবীকে বলেছেন, “আপনি কেন নিজেকে এত বেশি কষ্টের মধ্যে ফেলছেন?”

এ দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে :
১. আল্লাহ তায়ালা চাননি তার বান্দারা ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কষ্ট করুক।
২. পবিত্র কুরআন মানুষকে কষ্ট দেয়ার জন্য নাজিল হয়নি বরং প্রতিটি মানুষের জন্য তার সক্ষমতা অনুযায়ী দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে, তার বেশি নয়।

সূরা ত্বোয়া-হা’র ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
إِلَّا تَذْكِرَةً لِمَنْ يَخْشَى (3) تَنْزِيلًا مِمَّنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالسَّمَاوَاتِ الْعُلَا (4)
“(আমরা কুরআনকে) তাদের জন্যই নাজিল করেছি যারা ভয় করে।”(২০:৩)
“(এই কুরআন) তার পক্ষ হতে অবতীর্ণ, যিনি সুউচ্চ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন।” (২০:৪)
আগের আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)’কে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, ধর্মের বাণী প্রচার ও কুরআন অধ্যয়ন করতে গিয়ে আপনি নিজেকে বেশি কষ্ট দেবেন না। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, যারা সারাক্ষণ প্রতিটি মুহূর্তে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে চায় তাদের জন্যই আল্লাহর নির্দেশনা এসেছে এবং শুধুমাত্র তারাই আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ বাণী মানুষের অন্তরে প্রোথিত রয়েছে। এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির অংশ। এ কারণে মানুষ যে কোনো কাজ করতে গেলে- আমরা সচরাচর যাকে বিবেক বলি- তার কাছ থেকে সাড়া পায়। কাজটি ভালো হলে সে তা করে আনন্দ পায় এবং খারাপ হলে বিবেক তাকে বারবার নিষেধ করতে থাকে। পবিত্র কুরআন মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির মধ্যে নিহীত সেই দিক-নির্দেশনাগুলো জাগিয়ে দেয়। তবে যেসব মানুষ বারবার বিবেকের আহ্বান সত্ত্বেও খারাপ কাজ করে যায়, একটা পর্যায়ে গিয়ে তার আত্মা মরে যায়। তখন বিবেক বা কুরআনের আয়াত তার অন্তরে কোনো রেখাপাত করে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. মানুষের সামনে সার্বক্ষণিকভাবে সতর্ককারী থাকা প্রয়োজন এবং পবিত্র কুরআন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সতর্ককারী।
২. যারা দায়িত্ব সচেতন ও পাক-পবিত্র জীবনযাপন করতে চায় তারাই পবিত্র কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।

সূরা ত্বোয়া-হা’র ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে
الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى (5) لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرَى (6)
“যে দয়াময় আল্লাহ আরশের ওপর সমাসীন।”(২০:৫)
“আসমান ও জমিন এবং এই দু’য়ের অন্তর্বর্তী স্থানে ও ভূগর্ভে যা কিছু আছে, তার মালিক তিনিই।” (২০:৬)

আগের আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহকে আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ শুধু সৃষ্টিকর্তাই নন, সেইসঙ্গে তিনি শাসনকর্তাও। প্রকাশ্য ও গোপন সব বিষয়ের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

পবিত্র কুরআনে ‘আর্‌শ’ কথাটি বহুবার এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ ‘সিংহাসন’। আগেকার যুগে রাজা-বাদশাহরা শাসনকাজ পরিচালনার সময় সিংহাসন ব্যবহার করতেন বলে মহাবিশ্বের অধিপতি আল্লাহ সৃষ্টিজগতের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা বলতে গিয়ে এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এ দুই আয়াতে এই সৃষ্টিজগতে যা কিছু আছে তার সবকিছুর ওপর এমনকি প্রতিটি বস্তুকণার ওপর আল্লাহর আধিপত্যের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো অধিপতি যদি এতবড় ক্ষমতার অধিকারী হতো তবে সে নিঃসন্দেহে স্বেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী শাসকে পরিণত হতো। কিন্তু আল্লাহ যে কারো ওপর জুলুম করেন না এবং এতবড় অধিপতি হওয়ার পরও তার দয়া যে সবকিছুর ওপর ছাপিয়ে রয়েছে তা বোঝানোর জন্য তিনি এখানে নিজেকে রহমান বা দয়ালু হিসেবে তুলে ধরেছেন।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. আল্লাহ বিশ্বব্যবস্থা পরিচালনা করেন তার রহমতের ছায়াতলে।
২. সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুকণার ওপর আল্লাহর সমান নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং এ সবকিছু আল্লাহর সামনে অসহায়।
সূত্রঃ সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন