ইসলামী ঐতিহ্য ধ্বংসে সৌদি-ইসরাঈলি তাণ্ডব

ইসলামী ঐতিহ্য ধ্বংসে সৌদি-ইসরাঈলি তাণ্ডব


সরকার গুড়িয়ে দিয়েছে মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারামের অবশিষ্ট ঐতিহাসিক নিদর্শন। মসজিদুল হারামেই রয়েছে পবিত্র কাবা ঘর। এই কাবা ঘর মুসলমানদের কিবলা বা এই ঘরের দিকে মুখ করেই মুসলমানরা নামাজ আদায় করেন।

ব্রিটেনের দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানিয়েছে, ওয়াহাবি মতবাদে বিশ্বাসী সৌদি কর্তৃপক্ষ সেই স্তম্ভটি গুড়িয়ে দিয়েছে যেখান থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পবিত্র মে’রাজ বা ঊর্ধ্বাকাশ সফরের প্রাক্কালে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বা আলকুদস অভিমুখে রওনা হয়েছিলেন। সৌদি ওয়াহাবি পুলিশ এই ধ্বংসযজ্ঞকে উতসব (!) হিসেবে পালন করেছে বলে দৈনিকটি খবর দিয়েছে।

ওদিকে বিশ্বনবী (সা.)'র মে’রাজের সঙ্গে সম্পর্কিত বা মুসলমানদের প্রথম কিবলার নিদর্শন তথা আল-আকসা মসজিদও ইসরাইলি দখলদারদের মাধ্যমে হুমকির মুখে রয়েছে।

আলকুদস বা জেরুজালেমের ওয়াকফ কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল আজিম সালহাব এই ঐতিহাসিক মসজিদের পাশে মাটি খননের ইসরাইলি ততপরতার বিরুদ্ধে চলতি বছরের প্রথম দিকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন যে, বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও ইসরাইলি খনন কাজ অব্যাহত থাকায় মসজিদটির ভিত্তি হুমকির মুখে রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র মে’রাজের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি ঐতিহাসিক নিদর্শনই ভেঙ্গে ফেলার জন্য ইসরাইল ও সৌদি সরকার কেন একইসঙ্গে কাজ করছে?

ইহুদিবাদী ইসরাইল কেন এমন কাজ করছে তার উত্তর স্পষ্ট। ইসরাইল ফিলিস্তিন দখলদার হিসেবে ১৩০০ বছরের পুরনো এই ইসলামী ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনি জাতির ও ইসলামের সব ঐতিহাসিক নিদর্শন মুছে ফেলতে চায় যাতে এ অঞ্চলে বর্ণবাদী তথা বহিরাগত ইহুদিবাদীদের উপনিবেশ গড়ে তোলা সহজ হয়। এই লক্ষ্য নিয়েই ইহুদিবাদীরা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল এবং জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল মুসলিম, খ্রিস্টান ও এমনকি ফিলিস্তিনি ইহুদিদেরকেও।

মে’রাজ সফরে বিশ্বনবী (সা.) হযরত মুসা (আ.) ও ঈসা (আ.)সহ অনেক নবীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন। আর এ থেকে বোঝা যায়, ইসলাম পূর্ববর্তী নবীদের শ্রদ্ধা করে এবং তাঁদের অনুসারীদের অধিকার রক্ষাকেও গুরুত্ব দেয়।

একত্ববাদীদের এই একতা, মিল ও সহিষ্ণুতার প্রতীকী বিষয়টি ওয়াহাবি ও ইহুদিবাদীরা সহ্য করতে পারছে না।

উল্লেখ্য ইহুদিবাদীরা আল্লাহ বা প্রভুতে বিশ্বাসী বলে দাবি করলেও তাদের অনেকেই নাস্তিক এবং অন্যরা মনে করে প্রভু বা স্রস্টা কেবল ইহুদিদেরই নিজস্ব প্রভু, বিশ্বের সব মানুষের প্রভু নন! তিনি কেবল ইহুদিদের জন্যই দয়ালু, (তিনি ইহুদিদের সাত খুন মাফ করবেন) অন্যদের জন্য দয়ালু বা ন্যায়বিচারক নন!(তারা তিন হাজার বছর আগের কথিত ধর্মরাজ্যের সম্পদ পুনর্দখলের অজুহাতে ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব কায়েম করেছে)।এই ইহুদিবাদীদের কাছে ইসলামের বিশ্বজনীনতা, সার্বজনীনতা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি ঘৃণ্য বিষয়। তাই ইহুদিবাদীরা মসজিদুল আকসা এবং এর মাধ্যমে ফুটে ওঠা সব মহত বিষয়কে ঘৃণা করবে-এটাই স্বাভাবিক।

অন্যদিকে সৌদি ওয়াহাবিরাও সহিষ্ণুতা, বিশ্বজনীনতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও আধ্যাত্মিকতার মত বিষয়গুলোকে ঘৃণা করে। উগ্র ওয়াহাবিরা তাদের সমমনা ছাড়া অন্য সব মুসলমানকে ‘কাফির’ মনে করে এবং তাদের হত্যা করাকে বৈধ মনে করে। কিন্তু বাস্তবে সবচেয়ে ভয়ানক অমুসলিমদেরকে তারা সর্বোচ্চ সম্মান দিচ্ছে এবং এমনকি তাদের বিপুল তেল সম্পদের চাবিও তুলে দিয়েছে ওই অমুসলিমদের (তথা ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রুর) হাতে।

১৯৭০ সাল থেকে সৌদি তেলের অর্থে স্ফীত হয়েছে পশ্চিমাদের সুদ ভিত্তিক ব্যাংকিং প্রথা। আর এই ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্বশীল হল রথচাইল্ড পরিবার, এরা হল ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭০ সালে হেনরি কিসিঞ্জার সোনার মানদণ্ড-ভিত্তিক ডলারের রথচাইল্ড ফেডারেল রিজার্ভকে সৌদি পেট্রোডলার-ভিত্তিক রিজার্ভে রূপান্তরিত করেন।

রুক্ষ ও সংকীর্ণমনা ওয়াহাবিরা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির নিদর্শনগুলোকে মুছে ফেলতে চায় এবং তারা নির্মূল করতে চায় তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে একমত নয় এমন সব জনগোষ্ঠীকে।
ইসলামের বিরুদ্ধে সৌদি ওয়াহাবিদের এই যুদ্ধের পেছনে কি তাহলে ইহুদিবাদীরাই সক্রিয়?

কেউ কেউ বলে থাকেন যে সৌদি রাজ-পরিবার আসলে “দোমনেহ” নামের বিভ্রান্ত ইহুদিবাদী গোষ্ঠীর বংশধর। এই গোষ্ঠী ভণ্ড ইহুদিবাদী নবী ‘শাব্বিটি জিভি’র অনুসারী। তারা প্রকাশ্যে ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করত। কিন্তু তারা বাস্তবে মদ্যপ ও নির্বিচার যৌনাচার বা যৌন অনাচারসহ নানা ঘৃণ্য কাজে অভ্যস্ত ছিল।

এই তথ্য যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তার মধ্যে সৌদি প্রিন্স বা রাজপুত্রদের জুয়া খেলার মত বিপুল অর্থ অপচয়ের বিলাসিতার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। অথচ এইসব অর্থের মূল মালিক হল জনগণ। এ ছাড়াও এর মধ্যেই ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে যে, কেন সৌদি রাজবংশ রথচাইল্ড-ভিত্তিক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থাকে মদদ যোগাচ্ছে। এটাও বোঝা সহজ হবে কেন সৌদিরা ফিলিস্তিনের ওপর ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্বকে সহায়তা দিয়েছে। একইসঙ্গে এটাও বোঝা যাবে যে কেন ইহুদিবাদীদের মতই সৌদি ওয়াহাবিরাও ইসলামের সার্বজনীন আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক নিদর্শন বা প্রতীকগুলোকে বুলডজার দিয়ে গুড়িয়ে দিচ্ছে।

ইহুদিবাদীরা কেবল মুসলমানদেরই নয়, অন্যদেরও ঐতিহ্যগুলোকে ধ্বংস করতে চায়। রথচাইল্ডের ইহুদিবাদী লবি আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী পরিচিতি ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে মিডিয়ার যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। তারা আমেরিকার মুদ্রা ও অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারা থেকে বিচ্যুত করেছে এবং আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপরও যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। ওরা নানা পদক্ষেপ নিয়ে মার্কিন সংবিধানকে দলিত-মথিত করেছে। তাদের ওইসব পদক্ষেপ বা ততপরতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল ২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থান বা ক্যুদেতার মাধ্যমে।

অনেকেই মনে করেন কথিত বিশ্ব-ব্যবস্থার পথে সবচেয়ে বড় দুই বাধা হল মুসলিম উম্মাহ ও আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কারণ, মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধগুলোকে খুব শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে ভালবাসে। তারা ইহুদিবাদের বিরোধী ও সুদ প্রথাকে ঘৃণা করেন। অন্যদিকে আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণী এমন এক সুসংগঠিত গ্রুপ যারা বেশ শিক্ষিত ও অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী এবং তারা বিশ্ব মোড়লীপনাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য মুক্ত-স্বাধীন থাকার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করেন।

তাই কথিত নতুন বিশ্বব্যবস্থার কর্তৃত্ব রুখে দেয়ার জন্য ইহুদিবাদী ও তাদের সৌদি অনুচরদের মোকাবেলায় মার্কিন জনগণ ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য খুবই জরুরি। এ ঐক্যের পথে মার্কিন জনগণের ‘ইসলাম-আতঙ্ক’ সবচেয়ে বড় বাধা। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার মাধ্যমে খুব সুপরিকল্পিতভাবে যে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তারই ফসল হল এই ইসলাম-আতঙ্ক। তাই কথিত নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থাকে মোকাবেলার সবচেয়ে ভাল পথ হল ২০০১ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বরের সত্যিকারের রহস্যগুলো তুলে ধরার জন্য কাজ করা।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন