রেনেসাঁর কবি ইকবাল-১৫

রেনেসাঁর কবি ইকবাল-১৫


আধুনিক যুগে মুসলিম জাগরণের অন্যতম নকীব ও স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা ইকবাল লাহোরীর চিন্তার জগত এবং দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব তিনি শুধু নিজ জাতি তথা মুসলমানের কল্যাণ নিয়েই ভাবেন নি। গোটা মানব জাতির মুক্তি ছিল তার অন্তরের আকুতি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র আদর্শ তথা ইসলাম যে গোটা মানব জাতির জন্য মুক্তির একমাত্র পথ সেটা তুলে ধরতে গিয়েই তিনি ইসলামী আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছেন । একজন প্রকৃত কবি হলেন সত্যের বাগিচার বুলবুল এবং সত্য তুলে ধরাই তার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর ইসলামই যে মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় সত্য তা ফুটিয়ে তোলাই ছিল আল্লামা ইকবালের সমস্ত লেখনী ও চিন্তাধারার মূল উদ্দেশ্য । আর এদিক থেকে আমরা বিশিষ্ট দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালকে বিশ্ব মানবতার কবি বলেও উল্লেখ করতে পারি।
যা কিছু সত্য, সুন্দর, কল্যাণকর ও মঙ্গলময় ইসলামের সাথে তার কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নেই, বরং ইসলাম থেকেই সমস্ত সত্য, সুন্দর ও কল্যাণকর বিষয় উৎসারিত হয়েছে। ইসলামের অন্য অনেক মহান ব্যক্তিত্ব বা মনীষীর মতো মহাকবি ইকবালও তার লেখনীতে এ বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছেন। ইউরোপে গীর্যার শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হবার পর ইকবাল এই বিপ্লবের ইতিবাচক দিককে স্বাগতঃ জানিয়ে লিখেছিলেন:
বস্তুবাদী রুশ পরে ঐশীবাণী হয়েছে নাজেল
লাৎ ও মানাৎ যত গীর্যার আজ ভেঙ্গে ফেল
গীর্যার রাষ্ট্রীয় শোষণের যুগ শেষ হবার পর পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তুলে ধর্মকে পুরোপুরি নির্বাসন করায় ইকবাল এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার প্রতিবাদ জানিয়ে ইকবাল বলেছেন, রাজনীতি থেকে ধর্মকে বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে শুধু চেঙ্গিস খানের হৃদয়। রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করার নীতিতে বিশ্বাসী পাশ্চাত্য দু-দটি বিশ্ব যুদ্ধ ছাড়াও দেশে দেশে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা ও গণহত্যা চালিয়ে ইকবালের ঐ মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ কোরেছে।
অন্যদিকে অর্থ ও বিত্তকে পুঁজি কোরে প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদের ভিত্তিতে পাশ্চাত্যে যে গণতন্ত্র প্রচলিত ইকবাল সে গণতন্ত্র পরিহার করতেও বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি পাশ্চাত্যের কথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে খোলা বা নাঙ্গা তলোয়ার বলে অভিহিত করেছেন। ইউরোপীয় দর্শন ও মতবাদগুলোর সাথে ভালোভাবে পরিচিত আল্লামা ইকবাল পাশ্চাত্যের স্ববিরোধী চিন্তাগুলোর সমাধান হিসেবে ইসলামকেই মানব জাতির কাছে পেশ করে গেছেন। তার দৃষ্টিতে পাশ্চাত্য মানবিকতার সাথে জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তিত্ববাদের সাথে সমাজতন্ত্র এবং মনোবিজ্ঞানের সাথে জড়বিজ্ঞানকে জড়িয়ে সর্বগ্রাসী এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি কোরেছে। পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লব ও জ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির মুখে মুসলমানদের অনেকেই যখন হতাশায় ভুগছিল তখন ইকবাল মুসলমানদের নব-উত্থান বা অভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ কবি প্রথমেই মুসলমানকে তার আন্তর্জাতিক ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। মুসলমানরা যে কোনো দেশের গন্ডীতে আবদ্ধ নয় তা তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। জাতীয়তাবাদ যে মানবিকতার বৃহত্তর দায়িত্ব পালনে অক্ষম এবং মানবতার জন্য মারাত্মক সে কথা তুলে ধরে তিনি বললেন,
সব দেবতার সেরা সে-দেবতা যাহারে কহিছ স্বদেশ ফের,
বসন তারি বনেছে কাফন আবরি' বদন ইসলামের।
মুসলামানদেরকে জাতীয়তাবাদের মূর্তি ভাঙ্গার আহ্বান জানিয়ে ইকবাল আরও বলেছেন,
পুরাতন সেই দৃশ্য আবার নতুন যুগেরে দেখিয়ে দাও,
মুসলিম যদি হতে চাও তুমি তবে এ নতুন মূর্তিরে গুড়িয়ে দাও
ইসলামের আন্তর্জাতিক ও বিশ্বজনীন গুণে গুনান্বিত হবার জন্য স্থান ও কালের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ইকবাল বলেন,
অগ্রসর হও তুমি গিরি বিদারিয়া
স্থান ও কালের গুঢ় রহস্য ভেদিয়া।
 দার্শনিক কবি ইকবালের মতে ইসলাম মানব জাতিকে যেসব গাইড লাইন দিয়েছিল চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ আজো তা নিজের মধ্যে রূপায়িত করতে পারে নি। কিন্তু ইউরোপ বিজ্ঞানের উন্নতি ও বিচিত্র চিন্তার উপকরণ দিয়ে ইসলামের নব অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র বা জমিন তৈরি করে দিয়েছে। কারণ, পাশ্চাত্যের ল্যাবরেটরীগুলোতে উদ্ভাবিত বিভিন্ন মতবাদ মানব জাতির সমস্যাগুলোর সমাধান করতে না পারায় বিশ্বমানবতা যে ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়বে ইকবাল তা বুঝতে পেরেছিলেন। আধুনিক সভ্যতার সংকট এবং মুক্তির জন্য মানব জাতির আকুলতা তুলে ধরতে গিয়ে ইকবাল লিখেছেন,
বুদ্ধি আজো বল্গাবিহীন/ প্রেম ওযে খোঁজে প্রকাশ তার,
অনন্ত তব সৃষ্টি হে প্রভু, আজো মুখ চেয়ে পূর্ণতার।
তুচ্ছ প্রকৃতি-ভ্রুকুটি তলে/ আজো জড়সড় মানুষ হায়,
তোমার জগতে তেমনি সন্ধ্যা/ তেমনি প্রভাত কাঁদিয়া যায়।
তোমার ধনীরা ধনেতে মত্ত/ ফকির বিভোর আপনা মাঝে,
দাস আজো রয় জীর্ণ কুটিরে/ উচ্চ প্রাসাদে সুখীরা রাজে
বুদ্ধি, ধর্ম, জ্ঞান ও শিল্প/ আজো কামনার অধম দাস,
যেই প্রেম খুলে হৃদয়-বাধন/ কাঁদে জনগণ তাহারি আশ
ইসলামী রেনেসাঁ বা পুণর্জাগরণের কবি ইকবাল তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা পুণরুজ্জীবনের চেষ্টা কোরছেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষা বা চিন্তা পুণরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে ইসলামের মূল নীতিমালাকে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষপাতি ছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নিবেদিত এই মহৎ-প্রাণ কবি আধুনিক যুগের সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজতেন ইসলাম ও পবিত্র কোরআনের বাণী থেকে। আল্লামা ইকবালের দৃষ্টিতে ইসলামের বাণী ছিল সূর্যের মতো প্রদীপ্ত, যে ইসলাম এক সুষ্ঠ সামাজিক ব্যবস্থা, যা কর্ম, সুবিচার, সাম্য, ভাতৃত্ববোধ ও মানবিকতার প্রকাশস্থল। যে মুসলমান গুণে নয় শুধু নামে মুসলমান সে মুসলমানকে তিনি ঘৃণা করেছেন, দিয়েছেন অভিসম্পাত। তিনি বলেছেন, মুসলমান কতগুলো মহান গুণের ধারক, সেসব গুণ যার মধ্যে দেখা দেবে, সে-ই বিশ্বপ্রভুর সাহায্য লাভে ধন্য হবে। তার দৃষ্টিতে মুসলমানের নামের অধিকার আসলে এক অসার আত্মপ্রচার। তাই তিনি লিখেছেন,
কি বললে তুমি? মুসলিমের তরেই শুধু হুরের অঙ্গীকার?
অভিযোগ তব মিথ্যার বেসাতি, কান্ডজ্ঞানের ধারো না ধার?
সুবিচার সে যে প্রকৃতির রীতি, প্রকৃতি খেলাপ করে নি তার,
কাফের লভিল হুর গিলমান মুসলিম নীতি করিয়া সার।
স্বর্গপূরীর সুন্দরী হুর তোমরাই কেউ চাও না আজ
তূরের দীপ্তি তেমনি উজল, মূসা তো পরে না প্রেমিক সাজ।
মহাকবি ইকবাল মনে করতেন মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা ও আধ্যাত্মিক অগ্রগতির জন্য বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরী। আর এ জন্য প্রয়োজন মারেফাত বা গভীর জ্ঞান অর্জন। তার মতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানও পরিপূর্ণতা পায়। ইকবাল অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও প্রকৃতিকে জ্ঞানের তিনটি মূল ভিত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী অনুভূতি, বিবেক ও আত্মিক উপলব্ধি গভীর জ্ঞান বা মারেফাত অর্জনের মাধ্যম। আর মানুষের গভীর জ্ঞানের কেবল একটি অংশ বাহ্যিক জ্ঞান থেকে আসে, কিন্তু এর বেশীর ভাগই আত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে অর্জিত হয়।
ইকবাল মনে করতেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পরিপূর্ণতা অর্জনের পরই একজন আরেফ মহাপ্রভুর সান্নিধ্য পান। কিন্তু শুধু বাহ্যিক বা জাগতিক জ্ঞানের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সেই সান্নিধ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। তবে এ দুই ধরনের জ্ঞানকে তিনি পরস্পরের পরিপূরক বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষ করে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পাশাপাশি দর্শন ও বিজ্ঞানকেও গভীর জ্ঞান বা মারেফাত অর্জনের পন্থা বলে মনে করতেন । অন্য কথায় তিনি এই দুই ধরনের জ্ঞানকে সাংঘর্ষিক বলে মনে করতেন না। অবশ্য ইকবাল আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ইসলামী দর্শনকে সাধারণ বিজ্ঞান ও আক্বলের চেয়ে উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।
আল্লামা ইকবাল মনে করতেন ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বা খালি চোখে যে জ্ঞান অর্জিত হয় মনের চোখ ও আত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে তা গভীরতর করা যায়। কারণ, অজ্ঞাত ও রহস্যময় বিষয়গুলোকে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখে দূরদর্শিতা অর্জন করা সম্ভব। ইকবালের দৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের আধুনিক জ্ঞানের একটি সমস্যা হলো এই জ্ঞান মানুষকে মানুষের মতো জীবন যাপনের শিক্ষা দেয় না। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বিভিন্ন বৈষয়িক সংকীর্ণ স্বার্থে অপব্যবহার করার প্রবণতায় তিনি গভীর উদ্বিগ্ন ছিলেন। আর এ জন্যেই তিনি প্রাচ্যের প্রেম-সন্ধানী মন নিয়ে সত্যকে জানার এবং পশ্চিমা তত্ব বা মতবাদগুলোকে মন থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য ব্যবহারিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি ছাড়া মুসলমানদের জাগতিক উন্নতিও যে সম্ভব নয় ইকবাল তাও উল্লেখ করতে ভুলেন নি। তার মতে পবিত্র কোরঅান মানুষকে ব্যবহারিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত কোরেছে। অথচ মুসলমানরা এ দিকেও অচেতন হয়ে রয়েছে। অন্য কথায় ইকবাল জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সমন্বয় তথা এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেই মুসলিম উম্মাহকে জেগে উঠতে বলেছেন। এক্ষেত্রে যে কোনো একটির দিকে বেশী ঝুঁকে পড়া তার কাম্য ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে এ ভারসাম্য আনার জন্যেই সুফীর উদ্দেশ্যে শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখেছেন,
নয়ন তোমার দেখিছে স্বপন অতি-প্রাকৃতের দুনিয়া মাঝে
মোর চোখে এই বস্তুপুঞ্জ ঘটনাধারার বিশ্ব রাজে!
মনে মোর কোনো সন্দেহ নেই, বিশ্ব তোমার চির উজল,
আমি বলি শুধু, জীবন-মৃত্যু-ঢেউ-তোলা ধরা নহেকো ছল।
তোমার দৃষ্টি রচিবে হেথায় অভূতপূর্ব রূপান্তর,
যদি তার আলো পড়ে আসি আহা, দুনিয়ার এই বস্তু'পর।
অন্যদিকে শুধু নীরস যুক্তির চর্চা করে আল্লাহকে পাওয়া বা পরম সৌভাগ্য অর্জন করা যে সম্ভব নয় তাও দৃঢ়তার সাথে জানিয়ে গেছেন ইসলামী রেনেসাঁর কবি ইকবাল। তার মতে হাজারও যুক্তির পথ দিয়ে বা বাহ্যিক জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আল্লাহকে যতটা উপলব্ধি করা যায়, এক মুহুর্তের খোদা-প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসার আরো গভীর স্তরে পৌঁছানো যায়।
মোটকথা ইসলামী জাগরণ ও বিশ্বমানবতার কবি ইকবাল মানব জাতির মুক্তির জন্য মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে চিন্তাভাবনার বুদ্ধিদৃপ্ত পথে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে তিনি মুসলমানদেরকে সত্যিকারের মুসলমান হবার জন্য পথ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। খোদাপ্রেম থেকে উদ্ভুত গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান, ন্যায়বিচার, ঈমান, ঐক্য ও মানব-প্রেমই যে মুসলমানের বড় পরিচয় সে কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলেন নি যুগ-সংস্কারক এই মহান মুসলিম কবি।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন