রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৪

রেনেসাঁর কবি ইকবাল -৪


পাঠক ! গত আসরে আমরা কবি ইকবালের ওপর অপরাপর কবিদের সাহিত্য ও শৈলীগত প্রভাবের কথা বলেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় আজো আমরা ত্রয়োদশ শতাব্দীর ফার্সি ভাষার বিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবাল লাহোরীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আপনারা যথারীতি আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না-এই প্রত্যাশা রইলো।
ইকবালের মাতৃভাষা ছিলো পাঞ্জাবী। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ছিল উর্দু। ফলে দুই ভাষাতেই ছিল তাঁর মাতৃভাষা সুলভ দক্ষতা। অথচ তিনি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় পড়ালেখা করেছেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনা,তাঁর বক্তব্য,তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষাকে বেছে নিয়েছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ইকবাল কখনো ইরানে আসেন নি কিংবা কখনো ফার্সি ভাষায় কথা বলেন নি। তবে ফার্সি ভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহ বা আকর্ষণ থাকার কারণেই এ ভাষায় তিনি লেখালেখি করেছেন। তাঁর সমকালে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফার্সি ভাষা ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের কথাবার্তা এবং সাহিত্যের অভিন্ন ভাষা। তিনি তাই এ ভাষাতেই তাঁর দার্শনিক,রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার কারণ উর্দু ভাষা এই চিন্তা প্রকাশের জন্যে উপযুক্ত ছিল না।
প্রথম প্রথম অবশ্য ইকবালের জন্যে ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখাটা একটু কষ্টকরই ছিল। কিন্তু পরে অন্যান্য কবি বন্ধুর উৎসাহে এবং ফার্সি ভাষার প্রতি তাঁর অপরিসীম আগ্রহ ও অনুরক্তির ফলে তিনি সার্থকতা লাভ করেন। তাঁর সমকালে গোলাম কাদের বুলগেরামি জালান্দারীর মতো আরো অনেক পাঞ্জাবী এবং ভারতীয় কবি ফার্সি ভাষায় কবিতা চর্চা করতেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর হয়ে যান এবং সে সময়ের বড়ো একজন কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন।
ইকবাল যদিও ফেরদৌসী, হাফেজ, সাদি, মৌলাভি, ইরাকী প্রমুখের কবিতার সাথে ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন,তারপরও তাঁর কবিতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তাঁর কবিতার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি পুরোণো কাব্যশৈলীর মধ্যেই নতুন নতুন চিন্তাদর্শনের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কিংবা বলা যায় পুনর্গঠন করেছেন। তিনি তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে ভারতীয় ফার্সি ভাষীদের এবং ইরানীদের বোধগম্য ও পছন্দের শব্দগুলোই প্রয়োগ করেছেন। ফার্সি কবিতার যেসব ধারা চলমান ছিল যেমন গযল,কাসিদা,রুবাইয়াৎ এবং মাসনাবিÑসকল ধারাতেই তবে কিছুটা স্বতন্ত্র স্টাইলে তিনি কবিতা লিখেছেন। শৈলীগত স্বাতন্ত্র্য যেমন ছিল তেমনি বিষয়বস্তুগত পার্থক্যও ছিল।
ইকবাল তাঁর দার্শনিক চিন্তা,আধ্যাত্মিক চিন্তা,ধর্মীয় চিন্তা ইত্যাদি প্রকাশের ক্ষেত্রে সানাঈ,নিজামী,মৌলাভি,শেখ মাহমুদ শাবেস্তারী প্রমুখের মতো প্রবাদ-প্রবচন এবং কিসসা-কাহিনীর স্টাইলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তিনি ছন্দের কাঠামো ভেঙ্গেছেন। কাব্য রচনার যে আলঙ্কারিক পদ্ধতি রয়েছে,তা অনেক সময় বাঁধা হাত-পায়ের মতো মনে হয়। তিনি মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে কাব্যরীতির ঐ আলঙ্কারিক বিধি-বিধানের বন্ধ হাত-পা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এমনকি অনেক সময় তিনি কথার মাঝখানে কাব্যশৈলী পরিবর্তনও করেছেন। জাভিদনামাহ এবং মুসাফির নামক দ্বিপদী কাব্যে ইকবাল প্রয়োজনবোধে দ্বিপদীর স্টাইল পরিবর্তন করে গযলের স্টাইলে লিখেছেন।
কবিতার ক্ষেত্রে ইকবাল যে নতুন চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন,তারফলে ভারতীয় মুসলমানদের চিন্তারাজ্যে এক ধরনের বিপ্লবের সূচনা হয়। ইকবাল বিশ্বাস করতেন কবিতা বা শিল্পের অপরাপর মাধ্যমগুলো হওয়া উচিত গঠনমূলক,অর্থবহ এবং উচ্চতর লক্ষ্যাভিমুখী। তিনি তাঁর বন্ধু সাইয়্যেদ সোলায়মান নদভীকে উর্র্দুতে লেখা একটি চিঠিতে স্পষ্টভাবেই বলেছেন,তাঁর কবিতা লেখার উদ্দেশ্য পাণ্ডিত্য প্রকাশ করা নয়। চিঠির একাংশে তিনি লিখেছেন,কবিতার ক্ষেত্রে শব্দমালা, সাহিত্যশৈলী আর কোমল আবেগ চর্চার প্রতি আমার আকর্ষণ কম, আমার লক্ষ্য হলো কেবল চিন্তারাজ্যে বিপ্লব ঘটানো।' কবিতাকে তিনি অর্থোপার্জন বা খ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে পরিণত করেন নি। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন কবিরা হলেন মানুষ সৃষ্টির কারিগর এবং জাতির অগ্রজ এবং প্রাগ্রসর নাগরিক।
ইকবালের কবিতার বিষয়বস্তু হলো দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত সমকালীন বিশ্বের চিত্র আঁকা এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। সর্বোপরি কালের সকল অসঙ্গতি থেকে মুক্তির উপায় দেখিয়ে দেওয়া। ইকবাল সবসময়ই প্রাচ্যের স্বাধীনতা এবং মুক্তি,মুসলমানদের স্বাধীনতা এবং মুক্তি এবং তাদের ঐক্য কামনা করেছেন। ইকবাল আত্মসচেতনতা এবং জীবনের মূল্যবোধগুলোর অর্থ উপলব্ধি করাকে মুক্তি লাভের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন,পাশ্চাত্যের অনুসরণই হলো জাগরণের পথের অন্তরায় এবং প্রাচ্য সমাজের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন