রেনেসাঁর কবি ইকবাল-২

রেনেসাঁর কবি ইকবাল-২

পাঠক ! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি আপনারা ভালো ও সুস্থ আছেন। গত আসরে আমরা অত্যন্ত সংক্ষেপে আল্লামা ইকবালের জন্ম এবং মৃত্যুর ইতিহাস সম্পর্কে বলেছিলাম। আজকের আসরে আমরা তাঁর ফার্সি ভাষায় লেখা মূল্যবান কিছু সাহিত্যের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। কবি ইকবালের লেখালেখির ওপর আলোচনায় আপনারা সঙ্গ দিতে ভুলবেন না-এ প্রত্যাশায় শুরু করছি রেনেসাঁর কবি ইকবাল শীর্ষক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের আজকের পর্ব।
আল্লামা ইকবাল উর্দুভাষা, ইংরেজি ভাষা এবং ফার্সি ভাষায় প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তবে ফার্সি ভাষায় যা লিখেছেন তার সবই কবিতা। আসরার ই খুদি বা ‘দ্য সিক্রেট্স অব দ্য সেল্ফ',রুমুয ই বি খুদি বা ‘দ্য মিস্টেরিয অব সেল্ফলেস্নেস', পায়ামে মাশরিক বা ‘ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট',যাবুর ই আজাম বা ‘পারসিয়ান সাম্স', পাস চি বয়াদ র্কাদ আয় আকওয়ামে শার্ক বা ‘হোয়াট শুড দেন বি ডানঃও পিপল অব দ্য ঈস্ট' এবং জাভিদ নামা বা ‘টু হিজ সন' ইত্যাদি কবি ইকবালের ফার্সি রচনার অন্তর্ভুক্ত।
উর্দু ভাষাতেও তিনি প্রচুর লিখেছেন। এগুলোর মাঝে কবিতাও আছে , গদ্যও আছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনার নাম করা যাক। কবিতার মধ্যে রয়েছে বাঙ্গে দারা বা ‘কল অব দ্য মার্চিং বেল',বাল-ই-জিব্রিল বা ‘উইংস অব গ্যাব্রিয়েল',যার্ব-ই-কালিম বা ‘দ্য রড অব মোজেজ' ইত্যাদি। এছাড়াও অর্থবিজ্ঞান , ভারতের ইতিহাসসহ আরো বহু প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন।
তাঁর বক্তৃতাও রয়েছে প্রচুর। ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর শ্রেষ্ঠ কিছু লেখা হলো ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পার্সিয়া , দ্য রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম। এটি আসলে আল্লামা ইকবালের ৬টি বক্তৃতার সংকলন। মাদ্রাজ,হায়দ্রাবাদ এবং আলীগড়ে তিনি এই বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলেন। সংকলনটি প্রথমে প্রকাশিত হয় লাহোরে,তারপর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে।
বক্তৃতাগুলোর বিষয়বস্তু হলো নলেজ এন্ড রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স, দ্য কনসেপশন অব গড এন্ড দ্য মিনিং অব প্রেয়ার, দ্য হিউম্যান ইগো, প্রিডেস্টিনেশন এন্ড ফ্রি উইল, দ্য স্পিরিট অব মুসলিম কালচার এবং দ্য প্রিন্সিপাল অব মুভমেন্ট ইন ইসলাম।এছাড়া তিনি কয়েকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধও লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে ‘ইসলামী খিলাফত' এবং ‘ইসলামী সমাজের প্রতি দৃষ্টি' উল্লেখযোগ্য। ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পার্সিয়া ইকবালের গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর একটি। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত সময়কালে ইকবাল লন্ডনে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সে সময় তিনি তাঁর থিসিস বা গবেষণার মূল উপাত্ত অন্বেষনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর শিক্ষক এবং বন্ধু ডক্টর আর.এ.নিকলসন ইকবালকে তখন পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি যেন আব্দুল করিম জিলির লেখা আল-ইনসানুল কামেল ফি মারেফাতুল আওয়াখের ওয়াল আওয়ায়েল গ্রন্থটি পড়েন। তাঁর পরামর্শে ইকবাল বইটি পড়েন। বইটি পড়ার পর ইকবাল আব্দুল করিম জিলির ওপর পূর্ণাঙ্গ একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর ঐ লেখাটিই থিসিস হিসেবে পরিগণিত হয় এবং এই থিসিসটির ওপর ভিত্তি করেই তাঁকে ডক্টরেট দেওয়া হয়। মূল লেখাটি ১৯০৮ সালে লন্ডনে ছাপা হয়। তারপর উর্দু,ফরাশি এবং ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়।
ইকবালের ভাষ্য অনুযায়ী এই গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য ছিল ইরানী দর্শনের ইতিহাসের মৌলিকত্ব তুলে ধরা। এই গ্রন্থে ইকবাল কেবল প্রাচীন ইতিহাসই বর্ণনা করেন নি,বরং তিনি গবেষকদের চিন্তাজগতে নতুন একটি ধারার প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছেন । ডক্টর ফারিদানীর মতে "ইকবাল তাঁর এই বইতে ইরানী মুসলমান চিন্তাবিদদের চিন্তাজগতে প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছেন এবং সেগুলোকে নতুন দশর্শনের ভাষায় বর্ণনা করতে চেয়েছেন। তিনি সুফিবাদ বা মরমীবাদকে নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই বইতে তিনি মরমীবাদকে একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে উল্লেখ করেছেন এবং জীবনের উন্নত লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্যে ব্যক্তি বা সমাজের জাগৃতির উপায়গুলো প্রদর্শন করেছেন।"
আসরারে খুদি বা দ্য সিক্রেটস অব দ্য সেলফ জলো ফার্সি ভাষায় লেখা ইকবালের প্রথম গ্রন্থ। আল্লাহকে চেনা এবং নিজেকে চেনাই এই গ্রন্থের মূল উপজীব্য। ইকবাল অত্যন্ত সাফল্যের সাথে রাজনৈতিক-সামাজিক এবং দার্শনিক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে এবং আল্লাহকে চেনার উপায়গুলো ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। ইকবাল সাহিত্যের সমালোচকগণ মনে করেন তিনি এই গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিগত আকিদা-বিশ্বাসকেই তুলে ধরেছেন। ইকবালের দৃষ্টিতে সৃষ্টির মূলে আছে খুদি বা আমিত্ববোধ। আর এই বোধ সবার মঝেই রয়েছে।
আমার কবিতা বেপরোয়া আঘাতের সুর
আমি কবিকণ্ঠ এক অনাগত আগামীর
আমার সুরধ্বনি অন্য এক পৃথিবীর
এই ধ্বনি ভিন্ন আরেক কাফেলার
ইকবালের মতে এই আমিত্ব চেতনা যখন প্রেমের সাথে মিশ্রিত হয় তখন বিশাল এক শক্তি অর্জিত হয়। এই আমিত্ব একটা সময় আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে যেতে পারে। এই খুদিই ইসলামের আশ্রয় নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) এর বিধানের অনুসরণ করাতে পারে এবং ইসলাম যা করতে নিষেধ করেছে তা থেকে দূরে রাখতে পারে। ইকবালের মতে এরকম অবস্থাতেই মানুষ আল্লাহর খলিফার মর্যাদায় উন্নীত হতে পারে।
‘আসরারে খুদি'র ভূমিকায় কবি ইকবাল উর্দু ভাষায় লিখেছেন, প্রাচ্যবাসীরা তাদের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে,তারা তাদের আমিত্ব কে ভুলে গেছে,যার পরিণতিতে তারা এখন পাশ্চাত্যের অনুসারী হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইসলামের অনুসারী যারা তাদের উচিত তাদের ভেতরকার আমিত্ব শক্তিকে জাগিয়ে তোলা এবং তকদিরের ওপর সবকিছু ছেড়ে না দিয়ে কর্মতৎপর হওয়া। ইকবালের আসরারে খুদি কাব্য গ্রন্থটি ডক্টর নিকলসন ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর অনূদিত গ্রন্থটি লন্ডনে প্রকাশিত হয়। তারপর আরবি ভাষা, মালয় ভাষা, সিন্ধি ভাষা এবং উর্দু ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়।
আসরারে খুদি প্রকাশিত হবার পর ইকবাল ‘রমুযে বিখুদি' বা ‘দ্য মিস্টেরিয অব সেল্ফলেস্নেস' নামে আরেকটি বই লিখে তাঁর খুদি চিন্তাকে পরিপূর্ণতা দেন। এই গ্রন্থে তিনি ব্যক্তির সাথে সমষ্টির সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলেন এবং সমাজ ও জাতির মাঝে ব্যক্তির বিলীন হওয়া,মুসলিম সম্প্রদায়কে উম্মাতে মুহাম্মাদির সাথে একাত্ম হওয়ার উপায়গুলো বর্ণনা করেন।
‘পায়ামে মাশরেক' বা ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট গ্রন্তটিও ফার্সি ভাষায় লেখা। এই গ্রন্থটি তিনি জার্মানির বিখ্যাত কবি গ্যাটের দিভান অক্সিডেন্টালের জবাবে লিখেছেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে উর্দু ভাষায় লেখা ভূমিকাসহ এটি প্রকাশিত হয়। ১৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ ভূমিকায় তিনি গ্যাটের কাব্য সমালোচনা করেন এবং গ্যাটের ওপর ইরানী কবি হাফিজের প্রভাবের কথা বলেন। জার্মান কবিদের ওপর ইরানী কবিদের প্রভাব সম্পর্কে বলেন-‘ফার্সি সাহিত্য থেকে ব্যবহার করা জার্মানীর সাহিত্যিকদের একটা প্রাচীন প্রবণতা। আর জার্মান ভাষায় ইরানী সাহিত্যের অনুবাদ বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে।'
যাই হোক,ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট বা পায়ামে মাশরেক গ্রন্থটি আরবি, তুর্কি এবং উর্দুতেও অনূদিত হয়েছে। এছাড়া প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য ভাষাতেও ইকবালের এই গ্রন্থটির ওপর কমবেশি লেখালেখি হয়েছে এবং অনুবাদও হয়েছে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এ.জে.আরবেরিও এই গ্রন্থের ললে তুর নামক অধ্যায়টি সিনাই অব টিউলিপ নামে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। জার্মানীর প্রাচ্যবিদ হ্যান্সি ম্যাঙ্গিও ইকবালের জীবদ্দশাতেই এই গ্রন্থটির অংশবিশেষ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন