চিরন্তন বাস্তবতার প্রতীক
চিরন্তন বাস্তবতার প্রতীক
এ বিপ্লব অনাগত বহু বিপ্লবের
কেন্দ্রীয় সূতিকাগার
আগামীতে এই ইশতিহার
শৃঙ্খলিত পৃথিবীর বিধ্বস্ত বহু জনপদে
মজলুম মানুষের রক্তাক্ত আত্মার পরতে পরতে
দেশে দেশে চালিয়ে দেয়া রাষ্ট্র-যন্ত্রণায়
ছড়াবেই বিপ্লবের গান
এ বিপ্লব অগণিত নৈশ তাঁবুর
দুঃসহ রাত্রি শেষঃ ঘুমভাঙ্গা ভোরের আযান ।
ইসলামী বিপ্লবের রূপকার হযরত ইমাম খোমেনী (রঃ) সারা জীবন ধরে ইসলামী উম্মাহর ইহপরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের জন্যে সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও ইসলামী বিপ্লবকে রক্ষা, বিস্তার এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মুক্তি ও কল্যাণের জন্যে কথা, লেখনী ও চিন্তার মাধ্যমে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে গেছেন তিনি। এমনকি তাঁর ইন্তিকালের পরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বিশেষ করে ইরানের বিপ্লবী মুসলিম জনগণকে ভবিষ্যত পথনির্দেশনা দেয়ার জন্যে তিনি তাঁর অন্তিম বাণী রেখে গেছেন । এর লক্ষ্য ছিল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একজন মুমিন বান্দার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশান্ত চিত্তে তাঁর সমীপে হাজির হওয়া । ইমাম খোমেনী (রঃ) প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর দিদারের জন্যে যথাযথভাবে প্রস্তুত ছিলেন । তাই ইন্তিকালের সাড়ে ছয় বছর আগেই অর্থাৎ ১৯৮৩ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারী তিনি ইরানের মুসলিম জাতিসহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্যে তাঁর আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক ওসিয়তনামা রচনা করেন এবং তা সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করে যান । এ ওসিয়তনামায় লেখা উপদেশ বা বক্তব্যগুলো ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর হয়ে আছে ।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ইমাম খোমেনী (রঃ) বুঝতে পেরেছিলেন যে শীঘ্রই তাকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে । ইমামের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে ১৯৮৯ সালের মে মাসে ইমাম খোমেনী (রঃ)কে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় । হাসপাতালে যাবার প্রাক্কালে ইমাম খোমেনী বাড়ীর সবার কাছে বলেছিলেন, "আমি চিরদিনের জন্যে তোমাদের কাছ থেকে চলে যাচ্ছি, আর কোনো দিন ফিরবো না । ১৯৮৯ সালের তেসরা জুন, শনিবার স্থানীয় সময় রাত ১০টা ২২ মিনিটে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । ইমামের পুত্র আহমদ খোমেনীর মতে, বিদায়ের আগে ইমাম শুধু বলেছিলেন, আলোটা নিভিয়ে দাও; আমি ঘুমোতে চাই। তারপর তিনি হাত দুটি উঁচিয়ে মোনাজাত করতে করতে নীরব হয়ে গেলেন ।" এতো শান্ত ও সুন্দরভাবে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন তা তাঁর সন্তানরাও ভাবতে পারেননি । শেষ বিদায়ের কিছু আগে ইমাম খোমেনী বার বার বলছিলেন, জীবনের চলার পথ বড়ই কন্টকাকীর্ণ । ইমামের শেষ সময়ের উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল তাঁর নামায । তিনি তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নামায, এমনকি নফল নামাজও বাদ দেননি । ইমামের কন্যার বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি যখন তাঁর ঠোঁট দুটো নাড়াচাড়া করতে পারছিলেন না, তখনও আঙ্গুলের ইশারায় নামায আদায় করেছেন ।"
ইমাম খোমেনীর চিরবিদায়ের সংবাদ পেয়ে লাখো লাখো পাগলপারা মানুষ ঘরবাড়ী ছেড়ে পথে নেমে আসে। শোকাহত জনতা বুক চাপড়ে, মাথা কুটে মাতম করতে করতে ইমামের প্রতি তাদের গভীর ও হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা প্রদর্শন করে । মৃত্যুর তিন দিন পর ছয়ই জুন অনুষ্ঠিত হয় ইতিহাসের সর্ববৃহৎ জানাযা । অন্ততঃ এক কোটি জনতার শোক-তরঙ্গের মাঝে দাফন করা হয় ইসলামী বিপ্লবের মহানায়ক ইমাম খোমেনীকে । জনতা বার বার বুক চাপড়ে বলছিল, "কারবালা, কিভাবে তুমি আশুরার দুঃখ ও ব্যথা সহ্য করেছিলে! যেইনাব, মুখ খোলো -বলো! কিভাবে তোমরা কারবালার মুসিবত সহ্য করেছিলে? মদীনা কথা বলো! মহানবী(সঃ)'র ইন্তিকালের কথা শুনে কিভাবে তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছিলে?" অবশ্য শত রোদন ও আর্তনাদের মাঝেও জনতা তাদের ইমামের জন্যে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে বলেছে, তোমার উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। ইমাম খোমেনীর মৃত্যুতে গোটা মুসলিম উম্মাহ শোকাহত হয় এবং তারা হারায় তাদের একজন নির্ভরযোগ্য অভিভাবক ও সংস্কারক এবং ইরানী জাতি হারায় তাঁদের একান্ত প্রিয় পিতৃতুলক্ষ্য নেতা । ইমামের মৃত্যুতে জাতিসংঘের পতাকা অর্ধনমিত করা হয় এবং বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোসহ অনেক অমুসলিম দেশেও রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয় । ইরানে চল্লিশ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয় । মৃত্যুর সময় ইমাম খোমেনীর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর । রাসূল (সঃ)'র বংশধর ইমাম খোমেনী (রঃ)'র জন্ম হয়েছিল হযরত ফাতেমা জাহরা (সাঃ)'র জন্মদিনে । ফিলিস্তিনী নেতা আহমদ জিব্রীল ইমাম খোমেনীর মৃত্যুতে বলেছেন, খোদার পথের যারা অনুসারী তাদের মৃত্যু মৃত্যু নয়, শাহাদত। লেবাননের প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা আল্লামা শেখ ফাজলুল্লাহ বলেছেন, ইমাম খোমেনীর নেতৃত্ব পরাশক্তির ভারসাম্যকে নষ্ট করে ইরানী জাতিকে তৃতীয় শক্তিতে পরিণত করেছে । প্রফেসর হামিদ আলগার বলেছেন, ইমাম খোমেনী যেন আল্লাহর এক নিদর্শনে পরিণত হয়েছেন । ইমাম খোমেনী (রঃ) এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাকে নিয়ে হাজার হাজার গ্রন্থ লেখা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তাকে নিয়ে গ্রন্থ লেখা হতে থাকবে । কিন্তু ইমামের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি যে একজন আরেফে রাব্বানী ছিলেন সে বিষয়ে এবং তাঁর ইরফানী বৈশিষ্ট্য অনেকের কাছেই অজানা ছিল । এ প্রসঙ্গে ইমামের ঘনিষ্ঠ অনুসারী হুজ্জাতুল ইসলাম আনসারী বলেছেন, তাকওয়া ও পরহেজগারীর কারণে ইমাম খোমেনী তাঁর আধ্যাত্মিক ও ইরফানী বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব পরিচিতি সম্পর্কে কিছু লেখার অনুমতি দেননি । তিনি সবসময়ই বলতেন, আমার পরিচিতি তুলে ধরার কোনো প্রয়োজন নেই ।
জনাব আনসারী আরো বলেছেন, নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত এবং অন্যান্য শরয়ী কাজ সম্পাদনকালে হযরত ইমাম আল্লাহতায়ালার সাথে এতই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে অবস্থান করতেন যে, দুনিয়ার কোনো কিছুই তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতো না । ইতিহাসখ্যাত অনেক আরেফ ও সুফীর ন্যায় তিনি ছিলেন মরমী কবি । ইন্তিকালের চার মাস আগে ইমাম খোমেনী হযরত ফাতেমা জাহরা (সা)'র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ইরানের বিমান বাহিনী প্রধানের অভিনন্দন পত্রের জবাবে তিনি একটি আধ্যাত্মিক কবিতা লিখেছেন। তাঁর ঐ কবিতাটির অংশবিশেষের বাংলা অনুবাদ হলো এরকম:
হে প্রিয়তম সুহৃদ আমার, তোমার ওষ্ঠের তিল চিহ্ন টি
মোহাবিষ্ঠ করেছে আমাকে।
তোমার কাতর দৃَষ্টিতে আমিও কাতর।
আমার আমিত্ব থেকে মুক্ত আমি এবং
বোল তুলেছি âআনাল হক'-এর তবলায়।
মনসুরের মত আমিও আমার জন্য কিনেছি ফাঁসিকাঠ;
প্রিয়ের বিচ্ছেদ আমার অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে
আর আমি আমার আত্মার কাছে ফিরে শুনি
আমাকে নিয়ে বাজারে গুঞ্জন।
ইমাম খোমেনী (রঃ)'র ইন্তিকালের সময় ইসলামের শত্রুরা মনে করেছিল ইরান ইমাম খোমেনী (রঃ)'র আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে । কিন্তু ইরানের নেতৃবৃন্দ ও জনগণ শত্ত্রুদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছে । এ প্রসঙ্গে লন্ডন টাইমস লিখেছে, ইরানী জনগণের কাছ থেকে ইমাম খোমেনীর চিরবিদায় গ্রহণের দৃশ্য এটাই প্রমাণ করে যে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী হলো, আয়াতুল্লাহ খোমেনীর দেহ তাদেরকে ত্যাগ করলেও তাঁর আত্মা ও নির্দেশাবলী অমর হয়ে থাকবে । লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের ভাষ্যে বলা হয়,ইরানের শত্রুদের এ ভয় রয়েছে যে, এতোদিন যেভাবে আয়াতুল্লাহ খোমেনী ইরানের নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্তমানেও তিনি রুহানীভাবে বা আত্মিকভাবে ইরানের নেতৃত্ব নিজ করায়ত্বে রাখতে পারেন । ইমাম খোমেনীর মৃত্যুতে লন্ডনের ইন্ডিপেনডেন্ট লিখেছে , এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ইতিহাসের গতিধারাকে পাল্টে দেয়া একটি বিরল ঘটনা ; আয়াতুল্লাহ খোমেনী সেই বিরল ঘটনারই একজন বিরল ব্যক্তিত্ব । নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ইমাম খোমেনী ইরানের বাইরে এবং বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন মহান শক্তিধর ব্যক্তি ছিলেন । এভাবে দেখা যায়, বিশ্বের যেসব গণমাধ্যম এক সময় ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনীর বিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত ছিল সে গণমাধ্যমগুলোও ইমাম খোমেনীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হয়েছিল । ইমাম খোমেনী নিজেই ইরানের ভবিষ্যত প্রসঙ্গে বলেছেন, ইরানী জাতি তাদের পথ তথা ইসলামকে বেছে নিয়েছে, তাই আমি থাকি বা না থাকি তারা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও স্বাধীনতা এবং মুক্তির এ পথে চলা অব্যাহত রাখবে । অনেকে মনে করতেন সাহসিকতা ও সত্যের পথে আপোসহীনতাই ছিল ইমাম খোমেনীর সবচেয়ে বড় গুণ । কিন্তু ইমাম খোমেনী (রঃ)'র পুত্র আহমদ খোমেনীর দৃষ্টিতে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল পরহেজগারী বা খোদাভীতি। তাই দেখা যায়, তিনি হাজার হাজার নাস্তিক বিদ্রোহীকে কঠোর শাস্তি দিতে প্রস্তুত, অথচ তিনি একটা মৌমাছি মারতেও দ্বিধাবোধ করতেন ।
ইমাম খোমেনীর লেখা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের নাম হলো- ইসলামী আইন বিষয়ক (৫ খন্ডের) বই কিতাবল বাই, তাল-তাহেরা, তাহরির উল ওয়াসিলাহ, আধ্যাত্ম রহস্যবাদ বিষয়ে মিসবাহুল হুদা , ইখতিলাফ ওয়াল বিলায়া, সিররুস সালাহ, আসসাররুস সালাহ বা নামাজের রহস্য, কাশফুল আসরার, মিসবাহুল ওনস । দর্শন শাস্ত্রের ওপর লেখা তাঁর বই হলো- তলব ওয়া ইরাদাহ এবং নীতিশাস্ত্র বিষয়ক বই-" জিহাদ-ই-আকবর " বা শ্রেষ্ঠ জিহাদ । ইসলামী রাষ্ট্র বিষয়ক নীতিমালা সংক্রান্ত তাঁর অমর বইটির নাম হলো বিলায়াত ই ফকিহ বা শ্রেষ্ঠ ইসলামী আইনবিদের কর্তৃত্বভিত্তিক ইসলামী সরকার । ইমাম খোমেনী (রঃ) আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেলেও কালের গর্ভে তিনি চিরঞ্জীব এবং তাঁর জীবনাদর্শও চির অয় চির অব্যয়। আজ ইরানসহ সারা বিশ্বে এ কথাটি একটি প্রবাদতূলক্ষ্য বাক্য যে ইমাম খোমেনী এমনই এক বাস্তবতা যার বিনাশ নেই । মহান আল্লাহ তাঁর রুহের ওপর অশেষ রহমত বর্ষণ করুন ।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন