বিশ্বনবী (সাঃ)’র আদর্শের পুনরুজ্জীবক
বিশ্বনবী (সাঃ)’র আদর্শের পুনরুজ্জীবক
ধর্ম বা সঠিক পথে চলার নির্দেশনা মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। মহান আল্লাহ বিভিন্ন ধর্ম বিধান দেয়ার পর পবিত্র ইসলাম ধর্মকে মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ ও একমাত্র ধর্ম হিসেবে মনোনীত করেছেন। রাসুল (সাঃ)'র ওফাতের পর ইসলাম ধর্মের সঠিক বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য গত ১৪০০ বছরে আবির্ভূত হয়েছেন অনেক যোগ্য ইমাম, জগত বিখ্যাত আলেম, মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক এবং চিন্তাবিদ। মহানবী (সাঃ)'র যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তাঁরা ইসলামকে রা করেছেন অসত্যের ঘূর্ণাবর্ত এবং বিভ্রান্তির ধুম্রজাল থেকে। সত্য তথা ইসলামের আলোকে বস্তুবাদ বা জড়বাদের ঘোর অমানিশা থেকে সূর্যের মতো স্পষ্ট করা ও আধুনিক যুগে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার অসাধ্য সাধন যিনি করেছেন তিনি হলেন হাজার বছরের মহা বিস্ময় মহান ইমাম খোমেনী (রঃ)। হ্যাঁ আমরা এ মহা বিপ্লবীর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য তাঁর অনন্য অবদানগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
বিশ্ব যখন একদিকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্যবাদ এবং অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ধর্মহীন সমাজতন্ত্রের দাপটে তটস্থ তখনই পূর্ব দিগন্তে ইসলামের ঝান্ডা তুলে ধরলেন আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেনী (রঃ)। অবাক বিস্ময়ে বিশ্ববাসী দেখলো এই ইমাম ইসলামকে শুধু মসজিদ মাদ্রাসা, খানকাহ বা ব্যক্তিগত এবাদতের মধ্যে দেখতে চাননা। তিনি বললেন, ইসলাম বিশ্বমানবতার ধর্ম ââএ ধর্ম সব ধরণের অন্যায়, শোষণ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, উপনিবেশবাদী শাসক গোষ্ঠী ও তাদের মনিবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা বলে। এ ধর্ম জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাম্য, ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও মজলুম বা বঞ্চিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে।'' ইমাম খোমেনী (রঃ) বজ্রকন্ঠে জানিয়ে দিলেন, পাশ্চাত্য বা মার্কিন নেতৃত্বাধীন মতবাদ বা বিশ্বব্যবস্থা নয় এবং প্রাচ্য বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন্দ্রীক ব্যবস্থাও নয় বরং ইসলামই শ্রেষ্ঠ পথ বা আদর্শ। এভাবে ইমাম খোমেনী (রঃ) আধুনিক মানুষের হৃদয়-মন্দিরে প্রথিত দুই বড় মূর্তি তথা পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার ডাক দিলেন । অবশ্য তিনি মুসলিম উম্মাহকে এটা বুঝিয়ে দিলেন যে, আমেরিকাই তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।
আজ আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক এবং অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা ইমাম খোমেনীর এই দিক নির্দেশনার বাস্তবতা হাঁড়ে হাঁড়ে উপলদ্ধি করছেন। আসলে মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) সমাজতান্ত্রিক পরাশক্তিটির পতনের ধ্বনি অনেক আগেই শুনতে পেরেছিলেন। ইসলামী বিপ্লবের প্রথম দিকে ইরানের বিপ্লবী ছাত্ররা কূটনীতিকের ছদ্মবেশধারী মার্কিন গুপ্তচরদেরকে তেহরানে প্রায় দেড় বছর ধরে মার্কিন দূতাবাসেই বন্দি করে রেখেছিল । ওই বন্ধীদের মুক্ত করার লক্ষ্যে আমেরিকার পরিচালিত বিমান হামলা আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ ও কূদরতে ঘূর্নিঝড়ের কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ইরানের সাথে আপোস করতে বাধ্য হয়। এ ঘটনা পরাশক্তি হিসেবে অপরাজেয় বলে কথিত আমেরিকার অহমিকা ও দর্প চূর্ণ করেছিল এবং ইসলামের ও ঈমানের শক্তির অপরাজেয় গৌরব তুলে ধরে। ইসলাম ধর্ম রাজনীতি ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা যে অবিচ্ছিনড়ব তা বিংশ শতাব্দীতে ইমাম খোমেনী (রঃ) বাস্তব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে দেখিয়ে গেছেন। ঈমান ও খোদাভীতির শক্তিবলে গড়ে ওঠা ইরানের ইসলামী রাষ্ট্রই তার প্রমাণ।
ইমাম খোমেনী (রঃ) খালি হাতে এবং কোন সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য ছাড়াই আমেরিকার সমর্থিত ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে পরিচিত পাহলাভী রাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটান । ইমাম খোমেনী (রঃ) এর সূচিত ইসলামী বিপ্লব যাতে ইসলামী বিশ্বে বিশেষ করে আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সমাজতান্ত্রিক সাদ্দামের মাধ্যমে ইরানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় । কিন্তু এক্ষেত্রেও বিজয়ী হয়েছে ইমান ও ইসলামের শক্তি । মরহুম ইমাম খোমেনী ( রঃ) সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন । আর এজন্যই তিনি বিশ্বনবী (সাঃ) এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উদযাপনের সময় ঐক্য সপ্তাহ পালনের কর্মসূচি দেন যাতে মুসলমানরা মাজহাবী পার্থক্যের উর্দ্ধে ওঠে বৃহত্তর ইসলামী ঐক্যকে বেশি গুরুত্ব দেয় । মুসলমানদের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তাদের প্রথম কেবলার উপর ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্ব এবং ফিলিস্তিনে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব । ইমাম খোমেনী (রঃ) বলতেন, মুসলমানরা যদি এক বালতি করে পানি ঢালতো তাহলে ইসরাইল নিশ্চিহ্ণ হয়ে যেত ।
মুসলমানদেরকে এ ব্যাপারে সচেতন করার জন্য ইমাম খোমেনী (রঃ) প্রবর্তন করেছেন বিশ্ব কূদস দিবস । প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবারে এ দিবসটি পালিত হয় । ইমাম খোমেনী (রঃ) সূচিত ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে লেবানন ও ফিলিস্তিনে গড়ে উঠছে হিজবুল্লাহ এবং হামাসের মতো ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন । হামাসসহ ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদা আন্দোলনের সাফল্য এবং লেবানন থেকে ইসরাইলের পিছুহটা মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)এর আদর্শিক প্রভাবের অন্যতম দৃষ্টান্ত । মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের ব্যাপারেও ইমাম খোমেনী (রঃ) সজাগ ছিলেন । আর এজন্যই মহানবী (সাঃ ) এর অবমাননাকারী মূরতাদ লেখক সালমান রুশদিকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার ফতুয়া ঘোষণা করতে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) । আজো সে ফতোয়া বহাল রয়েছে । এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ নেতা মিখায়িল গর্বাচভের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে ইমাম খোমেনী (রঃ) ইসলামের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন । মোটকথা ইমাম খোমেনী (রঃ) যুগের চাহিদা অনুযায়ী তার বিভিনড়ব স্মরণীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসলামকে বিশ্বরাজনীতি ও বিশ্বের ঘটনা প্রবাহের মূল ধারায় নিয়ে আসেন । আর এরফলে দেশে দেশে ইসলামী পূণর্জাগরণ আন্দোলন জোরদার হয়েছে এবং বাতিল বা মিথ্যার শক্তিগুলো দিন দিন শক্তিহারা হচ্ছে । ইমাম খোমেনী (রঃ)'র আদর্শ তথা সত্যিকারের ইসলামী চেতনার প্রভাব দিন দিন বাড়ছে বলে ইরানকে এখনও সাম্রাজ্যবাদীদের বিভিন্ন বাধা ও শত্রুতার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর নানা অবরোধ ও দেশটির শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির বিরোধীতাই এর প্রমাণ । ইমাম খোমেনী (রঃ) অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নারী সমাজকে ইসলামের পথে পরিচালনা, দেশ পুনর্গঠন, শিক্ষা ও অর্থ ব্যবস্থার ইসলামীকরণ, যুবসমাজকে জিহাদী চেতনায় উজ্জীবিত করা প্রভৃতি বিষয়েও অসাধারণ সাফল্যের প্রমাণ রেখেছেন। তিনি ইসলামী দর্শন ও আইনের একজন শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক থেকে একজন শ্রেষ্ঠ দরবেশ বা আধ্যাত্মিক সাধক এবং শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনেতা হতে পেরেছিলেন যুগের চাহিদা উপলব্ধির বিস্ময়কর মতা, আত্মসংযম, কঠোর ত্যাগতিতীক্ষা, ধৈর্য খোদাভীরুতা, নির্লোভ সাদাসিদে জীবন যাপন, দুরন্ত নির্ভিকতা, উদারতা , দুরদর্শীতা, নিয়মানুবর্তীতা ও সর্বোপরি মহান আল্লাহর উপর চরম নির্ভরশীলতার মতো বিভিন্ন গুনাবলীর কারণে । ইমাম খোমেনী (রঃ) নিজেকে জনগণের খুবই সাধারণ বা ছোট খাদেম ও ধর্মতত্ত্বের ছাত্র বলতেন । আর এসব কারণেই বিপ্লবের বিজয়লগ্নে তাঁকে যেমন কোটি জনতা সংবর্ধনা জানাতে সমবেত হয়েছিল তেমনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময়ও কোটি কোটি জনতা তাঁর জন্য বুক চাপড়ে ও অশ্রুপাত করে এই মহান মোজাদ্দিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেছিলেন । একই কারণে ইমামর খোমেনী (রঃ) স্মরণ ও তাঁর আদর্শ অমর হয়ে আছে ও অমর হয়ে থাকবে ।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন