ইতিহাসে চিরভাস্বর ইমাম খোমেনী (রঃ)
ইতিহাসে চিরভাস্বর ইমাম খোমেনী (রঃ)
এতো কোনো শিশু নয় হাজেরার কোলে যেন নতুন ইসমাইল
যেন বনি ইসরাইলের মধ্যে এলেন মূসা
ইমাম, তুমি তাকালে সামনে জালিমের জিন্দান
ভেঙ্গে খান খান নমরুদ আর ফেরাউন ভূপাতিত
ইমাম তুমি দুহাত বাড়ালে ওমনি ফুটলো গোলাপ
Â
মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) এমন এক বিশাল ব্যক্তিত্ব বা মহীরুহের নাম যার জীবনের বিভিন্ন মহৎ দিক ও সাফলক্ষ্য তাঁকে ইতিহাসে চিরভাস্বর করেছে । আজ আমরা তাঁর জীবনের আরো কিছু মহৎ দিক ও অবদান নিয়ে আলোচনা করবো ।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃহামিদ আলগার বলেছেন ইমাম খোমেনী (রঃ) দর্শন ও অধ্যাত্মবাদকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রয়োগ করে এটা দেখিয়ে গেছেন যে, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা বা নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলীর সাথে রাজনীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে ।
নৈতিক ও আত্মিক সংশোধনকে ইমাম খোমেনী (রঃ) যে কত গুরুত্ব দিতেন তা তাঁরই কিছু অমর বাণী থেকে ফুটে উঠে । ইমাম বলেছিলেন, চারিত্রিক অসততাই তৌহিদবাদী ধর্মগুলোকে ধ্বংস করেছে এবং তাদের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । ইসলামের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে তাদের হাতে যারা সুশিক্ষিত অথচ আত্মিক দিক থেকে সংশোধিত হয়নি । ইমাম খোমেনী নৈতিকতা শিক্ষার ক্লাসে তাঁর ছাত্রদের উপদেশ দিয়ে বলতেন - " আমাদের একজন ওস্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী একজন আলেম হয়ে ওঠা তোমাদের জন্যে খুবই সহজ । কিন্তু খুব বেশী কঠিন হচ্ছে একজন সত্যিকার মানুষ হওয়া, আর আমি বলবো আলেম হওয়া বেশ কঠিন, তবে মানুষ হওয়াটা প্রায় অসম্ভব । "
সুইজারল্যান্ডের খ্যাতনামা সাংবাদিক ও নও মুসলিম আহমেদ হুবার ১৯৯০ সালে এক সম্মেলনে বলেছেন, ইমাম খোমেনী আমাকে এবং বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানকে অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে মানবতার জন্যে আল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গী কি তা উপস্থাপন করেছেন । ইমাম খোমেনী যে জাগরণের উদ্যোগ নিয়েছেন গত ১১ বছরে তা সারা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে । আজ আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থেও লেখা হচ্ছে যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে । এমনকি তা ১৯৭৯ সাল থেকে আমেরিকার ক্ষমতাকে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে । ইমাম খোমেনীর ইসলামী বিপ্লব এবং ইসলামী মুজাহিদদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ১৯৮৩ সালে আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইহুদিবাদী ইসরাইলকে লেবানন থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছে এবং সত্যিকার অর্থে ইসলাম অনুপ্রাণিত ফিলিস্তিনি গণজাগরণ চল্লিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম এত মারাত্মকভাবে ইহুদি দখলদার ও আন্তর্জাতিক ইহুদীবাদী চক্রকে সংকটে ফেলেছে । তাই, ইমাম, তাঁর চিন্তাধারা ও তাঁর সংগ্রামী কার্যক্রম চিরকাল জিন্দা থাকবে । মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে জালেম ও স্বৈরশাসকের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরতে পারতেন এবং সব ধরনের জুলুম ও বঞ্চনার অবসান ঘটানোর জন্যে ইসলামী শাসনের অপরিহার্যতাও জনগণের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন । তিনি ইসলামের শত্রুদের ও বিপ্লব বিরোধীদের সমস্ত প্রচারণার এমন দাঁতভাঙা জবাব দিতেন যে, তারা বল প্রয়োগ করা ছাড়া ইমামের আলোকিত আন্দোলন দমনের আর কোনো পথ খুঁজে পায়নি । কিন্তু ইরানের আপামর জনতাকে তিনি ইসলামের জন্যে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিশেষ করে সর্বোচ্চ ত্যাগ শাহাদতের চেতনায় এমনভাবে উজ্জীবিত করেছিলেন যে তাঁদের সমস্ত নিষ্ঠুরতা ও দমন নীতিও ব্যর্থ হয়ে যায় । ইমাম খোমেনী (রঃ) তাঁদেরকে যেন অভ্যস্ত করেছিলে এ অমোঘ বাণীতে-
Â
জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনি জানি
শহীদী রক্তে হেঁসে ওঠে যবে জিন্দেগানী ।
ঈমানের দ্যুতি যদি বুক জুড়ে, কলেমার
কন্ঠ যদি উদাত্ত উদার
সঙ্গী তবে মহান মহিম প্রভু, বিশ্বাসীর
জন্যে তাঁর করূণা অপার ।
Â
ইমামের পক্ষে জনতার জোয়ার এতোই সর্বপ্লাবী হয়ে উঠেছিল যে স্বৈরাচারী শাহের শেষ অবলম্বন সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যও ইমামের সমর্থকে পরিণত হন । তাঁর আলোকিত বক্তব্য ও যুক্তিপূর্ণ আহবান দাবানলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো এবং নারীসহ সব শ্রেণীর মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে তিনি সমন্বয় বা ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন । ইমাম খোমেনী নারী জাতি সম্পর্কে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতেন বলেই ইরানের নারী সমাজও ইসলামী বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং ইরানের নারী সমাজ হিজাবের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে এখনও সব ধরনের সামাজিক কর্মকান্ডে ভূমিকা রাখছেন । ইমাম খোমেনী (রঃ) যে শুধু নিজ জাতির সব শ্রেণীর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন তা নয় তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন । তিনি চাইতেন সারা বিশ্বের মুসলমানরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোক । এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলেম মাওলানা সালাউদ্দিন বলছেন, "বিশ্বের সমস্ত মুসলমান একে অপরের ভাই । আল মুসলিম আখুল মুসলিম । ইন্নামাল মুমিনুনা ইখওয়া । যাঁরা কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ পড়ে- তারা সবাই উম্মতে মোহাম্মদী তথা মুসলিম । কিন্তু ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদেরকে দ্বিধা-বিভক্ত করার জন্যে একের থেকে অপরকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে । যে কারণে শিয়া-সুন্নী বিভিন্ন ফের্কার তুফান বা ঝড় তুলে তারা ভাই-ভাইয়ের মধ্যে শত্রুতা বাধিয়েছে । যেখানে ভাই ভাইকে ভালোবাসবে, সেখানে শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করে দিয়েছিল । ইমাম খোমেনী (রঃ)'র মনে এটা বড় দুঃখ দিয়েছিল । তাঁর চোখে পানি এসেছিল এ অবস্থা দেখে । এ জন্যে তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদেরকে এক মায়ের সন্তানের মতো এক করার ডাক দিয়েছিলেন এবং এ জন্যে তাঁকে অনেক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে । আমি যখন ইমাম খোমেনী (রঃ)'র চেহারা মোবারক দেখি ও তাঁর জীবনী সম্পর্কে পড়ি ও এসব নিয়ে চিন্তা করি তখন নবী (সঃ)'র কথা আমার মনে পড়ে যে, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) যেভাবে নিজে না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে যে চেষ্টাগুলো করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে ইমাম খোমেনী (রঃ) সারা বিশ্বের মুসলমানদেরকে ইসলামের ঝান্ডার নীচে একতাবদ্ধ করার জন্যে যে চেষ্টা করেছিলেন- সেটা তাঁর অনেক বড় অবদান । তাঁর যে বিপ্লব তা বিশ্বের মুসলমানদেরকে একতাবদ্ধ করার জন্যে যথেষ্ট এবং আমি মনে করি এ ঐক্যের প্রয়োজনও রয়েছে । "
মরহুম ইমাম খোমেনী শুধু একজন যুগস্রষ্টা নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন যোগ্য নেতা, সুযোগ্য ফকিহ বা মুজতাহিদ পর্যায়ের আলেম ও অসাধারণ চিন্তাবিদ বা পন্ডিত গড়ে তোলারও দ কারিগর । ইরানের শীর্ষ স্থানীয় আলেম, অন্যান্য চিন্তাবিদ ও সংগঠক হিসেবে খ্যাত শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মোতাহারী, আয়াতুল্লাহ বেহেশতী , শহীদ প্রেসিডেন্ট রাজাই, শহীদ হুজ্জাতুল ইসলাম ডঃ বহুনার , আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ আলী খামেনী, আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানী, আয়াতুল্লাহ জান্নাতী, আয়াতুল্লাহ তালেকানী, আয়াতুল্লাহ মিশকিনী, শহীদ ডঃ আলী শরিয়তী প্রমুখ বিপ্লবী চিন্তাবিদ ইমাম খোমেনী (রঃ)'র আদর্শের অনুসারী বা তাঁরই হাতে গড়া ছাত্র । তাঁরা ইরানের শিক্ষিত মহলে মার্কসবাদ ও পুঁজিবাদের মত বিষাক্ত মতবাদের অসরতা ও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরে তাদেরকে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ার আন্দোলনে শরীক করতেও সম হয়েছিলেন । শাহের ঘাতক সেনাদের হাতে তাঁদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন এবং শহীদ হয়েছে অসংখ্য ঈমানদার নারী-পুরুষ ও ছাত্র-যুবক । ইসলাম ধর্মের সম্মান রক্ষা ও রাসূল প্রেম ছিল ইমাম খোমেনী (রঃ)'র চিন্তা- চেতনা ও কাজে মজ্জাগত ।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)'র নির্ভিকতা ও রাসূল প্রেমের এক বড় নিদর্শন হলো কূখ্যাত ধর্মত্যাগী সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে তাঁর ঐতিহাসিক ফতোয়া তথা মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ । এ ফতোয়া এখনও কার্যকরী রয়েছে । সালমান রুশীদর বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনীর ফতোয়া জারির পর সারা বিশ্বে রুশদীর ফাঁসীর দাবীতে মুসলমানদের গণ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং এ গণ বিক্ষোভে রুশদীর পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা ও বৃটেনের বিরুদ্ধে গণজাগরণে রুপান্তরিত হওয়ায় আমেরিকা ও বৃটেনের সরকারও বিচলিত হয়ে পড়ে । আমেরিকার ২৫০০ দোকান থেকে রুশদীর বইটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয় । ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রকাশকরা রুশদীর বইটি অনুবাদ করেও তা প্রকাশ করতে সাহস পায়নি । ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের বেপরোয়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের এতো শক্ত জবাব দেয়ার সাহস একমাত্র ইমাম খোমেনীই দেখাতে পেরেছেন । পাশ্চাত্যের গণমাধ্যম যখন ইরানী নেতৃবৃন্দের নামে এ মিথ্যা প্রচার শুরু করে যে রুশদি মা প্রার্থণা করলে তাকে মৃত্যুদন্ডাদেশ থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে । তখন ইমাম খোমেনী দ্বিতীয় ফতোয়ায় বলেনঃ রুশদী যদি তওবা করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আবেদ বা সাধক পুরুষেও পরিণত হয়, তবুও তার মৃত্যুদন্ডাদেশ রহিত করা হবেনা । সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের কাছে ইসলামের দাওয়াত ও সমাজতন্ত্রবাদ ইতিহাসের যাদুঘরে স্থান নেবে বলে তাঁর ভবিষ্যদ্বানী ইমাম খোমেনীকে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করেছে ।
সূত্রঃ ইরান বাংলা রেডিও
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন