ওহাবি মতবাদঃ ২৯ তম পর্ব

ওহাবি মতবাদটি এখন যতোটা না মাযহাবী তারচেয়ে বেশি সৌদি আরবের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ওহাবি চিন্তার প্রচার প্রসারের কাজ শুরু হয়েছিল মূলত সৌদি সরকারের সম্পদ ও ক্ষমতার আলোকে, তাই এই হুকুমাত যতোদিন অব্যাহত থাকবে ততোদিন ওহাবি মতবাদের অস্তিত্বও বজায় থ

ওহাবি মতবাদঃ ২৯ তম পর্ব
ওহাবি মতবাদটি এখন যতোটা না মাযহাবী তারচেয়ে বেশি সৌদি আরবের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ওহাবি চিন্তার প্রচার প্রসারের কাজ শুরু হয়েছিল মূলত সৌদি সরকারের সম্পদ ও ক্ষমতার আলোকে, তাই এই হুকুমাত যতোদিন অব্যাহত থাকবে ততোদিন ওহাবি মতবাদের অস্তিত্বও বজায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌদি আরবের শাসনব্যবস্থা হচ্ছে রাজতান্ত্রিক। আলে সৌদের খান্দানের মাঝেই সৌদি আরবের ক্ষমতা ঘুরপাক খায়। রাজবংশেরই এক জনের কাছ থেকে আরেক জনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। সৌদি প্রিন্স বা যুবরাজগণই দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের অর্থাৎ আলে সৌদের মাধ্যমেই সৌদি আরবের কেন্দ্রিয় শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়। দেশটিতে সরকার বিরোধী সর্বপ্রকার রাজনৈতিক কার্যক্রমকে শক্তহাতে দমন করা হয়। ওহাবি মতবাদ সৌদি আরবে এমনভাবে শেকড় গেড়েছে যে তাদের সংস্কৃতি, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগ পর্যন্ত ওহাবি মতাদর্শের আলোকে গঠিত হয়েছে।

ক্ষমতার উচ্চ আসনগুলো ওহাবি মুফতিগণের হাতে চলে গেছে এবং আলে সৌদ সরকারের নীতি নির্ধারণী ব্যবস্থায় তারা উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। দেশের আইন ও বিচার মন্ত্রী, হজ্ব মন্ত্রী, ইসলামী মর্যাদা বিষয়ক মন্ত্রী, আওকাফ এবং ইসলামী দাওয়াত সংস্থার মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো ওহাবি মুফতিদের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। ওহাবিরা হারামাইন শরিফাইনের ওপর কর্তৃত্ব ছাড়াও বড়ো বড়ো অনেক সংস্থা গঠন করেছে। এই সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তারা ওহাবিদের বিকৃত মতবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে থাকে। 'রাবেতায়ে আল আলমে ইসলামী' বড়ো বড়ো আলেমদের সংস্থা বা "কেবারুল উলামা" এবং "আমরু বিল মারুফ ওয়া নিহি আনিল মুনকার" সংস্থা এগুলোর অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,কেবারুল উলামা সংস্থার একুশজন মূল সদস্য রয়েছে যাদের সবাই ওহাবি। তারা ওহাবি মতবাদের প্রচার ছাড়াও সৌদি আরবের রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এভাবে ওহাবিরা সৌদি আরব সরকারের ওপর ব্যাপক কর্তৃত্ব করার পাশাপাশি সেদেশের সম্পদ ও তেল ভাণ্ডারের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণেই সৌদি আরবে সুন্নি কিংবা শিয়াসহ অন্য কোনো মাযহাবের কার্যক্রম চালানোর কোনোরকম সুযোগই নেই।

সৌদি সরকার এখন তাদের সকল অর্থ সম্পদ ব্যয় করে ওহাবি ফের্কা বিস্তারের মূল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তারা তাদের দেশে এই মতবাদ ছাড়া অন্য কোনো মাযহাবের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা ওহাবিদের ছাড়া অন্যদেরকে মুসলমানই মনে করে না,কাফের, মুশরিক এবং বেদায়াতী বলে ভাবে। এ কারণে সৌদি আরবে ওহাবিদের ছাড়া অন্য কোনো মাযহাবের লোকজন ভালো চাকুরি পায় না, তাই আর্থিক দিক থেকে তাদের অবস্থান ওহাবিদের তুলনায় অনেক পেছনে। গোঁড়ামি, সহিংসতা এবং কট্টর চিন্তাভাবনার কারণে ওহাবি ফের্কায় চরম উগ্রবাদের জন্ম হয়েছে। অথচ কোরআনের নূরানি আয়াত আর রাসূলে খোদা (সা) এর মন কেড়ে নেয়া কথাবার্তা অনুসারে জনগণের সাথে আচার আচরণের ভারসমতা,সদয় মিষ্টি ব্যবহার ইত্যাদি হলো একজন প্রকৃত মুসলমানের বৈশিষ্ট্য।

মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য মিষ্টি ব্যবহার ও আচরণের কথা বলছিলাম। অথচ ওহাবিদের ব্যবহার ঠিক তার বিপরীত। এ যুগের একজন বিখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ নাসের মাকারেম শিরাযি ওহাবিদের জাহেলি আচরণের একটি স্মৃতির কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়ঃ "প্রথমবার যখন মদিনায় খোদার ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় গেলাম, অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখতে পেলাম। 'আমেরিন বে মারুফ' নামে লম্বা লম্বা দাড়িঁওয়ালা-গোঁড়া ওহাবিদের-একটি গ্রুপ নবী কারিম (সা) এর রওজা মোবারকের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। তাদের সবার হাতেই চাবুক। যে-ই নবীজীর রওজায় চুমু দিতে এগিয়ে যায় তারই মাথায় ঐ চাবুক দিয়ে আঘাত করছে। তারা যিয়ারতকারীদের বলছেঃ রওজা শরিফের এই বেষ্টনিটা ক'টুকরো লোহা আর কাঠ মাত্র,তোমাদের এই কাজটা শেরেকি।"

আয়াতুল্লা মাকারেম শিরাযি আরো বলেনঃ"গোঁড়া ওহাবিরা এ বিষয়টি বুঝতে পারে নি যে যিয়ারতকারীদের ঐ কাজের উদ্দেশ্য কাঠ আর লোহাকে চুমু দেওয়া নয় বরং ঐ চুম্বন রাসূলে খোদা (সা) এর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও প্রেমের প্রকাশ। ওহাবিরা কিন্তু নিজেরাই কোরআন শরিফের জেল্‌দে চুমু খায়। তারা হাজরে আসওয়াদ নামের কালো পাথরেও চুমু খায় এবং বরকত কামনা করে। তো হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া শেরক না হলে রাসূলে খোদা (সা) এর রওজা মোবারকের পাথরে চুমু দেওয়াকে ওহাবিরা শের্‌ক বলে মনে করে কীভাবে! এটা কি স্ববিরোধিতা নয়? দুঃখজনকভাবে ওহাবি আলেমদের কাছে নিরবতা ছাড়া এই প্রশ্নের আর কোনো জবাব নেই।"
হেজাজ হলো ওহী নাযিলের স্থান, আল্লাহর ঘর, মুসলমানদের ক্বেবলা এবং ঐতিহাসিক স্মৃতিবহুল বহু কীর্তিময় স্থান, যা মুসলমানদের ঐক্যের জন্যে খুবই উপযোগী প্রতীক হিসেবে সর্বজনগ্রাহ্য।তা সত্ত্বেও দুঃখজনকভাবে সৌদি শাসকেরা ঐক্যের বিপরীতে বিচ্ছিন্নতার নীতি অনুসরণ করছে। আলে সৌদের সাথে পশ্চিমা শক্তিগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ সম্পর্কের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সৌদিআরব এখন ইঙ্গোমার্কিনীদের নীতি বাস্তবায়নকারীতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতার বিস্তার এবং ওহাবিদের সহিংস নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঐক্যের ক্ষেত্রগুলোকে যে ধ্বংস করা হয়েছে, তাকে উপনিবেশবাদীদের নীতিরই বাস্তবায়ন বলে মনে করা হচ্ছে। সৌদিআরবে বিদ্যমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কারণে এই বিভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে কেউ বিক্ষোভও করতে পারছে না। বহু কিতাব, ম্যাগাজিন এবং মাসজিদুন্নাবি ও মাসজিদুল হারামসহ বিভিন্ন মসজিদে দেওয়া খুতবা,বিশেষ করে বেদআত, শিরক ও তৌহিদ সংক্রান্ত আলোচনাগুলোর সবই ওহাবিদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত।
হজ্বের সময় যেহেতু সারা বিশ্ব থেকে মুসলমানরা এসে সমবেত হয় সেজন্যে ওহাবিরা এ সময় তাদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচারের জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। মুসলমানদের মাঝে হজ্ব একটি ফরয ইবাদাত হবার কারণে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এর বাইরেও সারা বছর জুড়েই মুসলিম নারী-পুরুষ ওমরা করার জন্যে, নবীজীর রওজা মোবারক যিয়ারত করার জন্যে সৌদি আরবে যায়। এ কারণে সৌদি সরকার একটি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছে যার উদ্দেশ্য হলো ওহাবি মতবিশ্বাসের আলোকে যিয়ারতকারীদের ধর্মীয় বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়া। এই মন্ত্রণালয় ওহাবি মতবাদ অনুযায়ী বহু কিতাব ও ম্যাগাজিন ছাপিয়ে হজ্ব সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বিলি করে।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন