ওহাবি মতবাদঃ ২৮ তম পর্ব
ওহাবি মতবাদঃ ২৮ তম পর্ব
পবিত্র কোরআনের সূরা আল-ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ 'আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পর¯পর বিচিছন্ন হয়ো না...'।বিচ্ছিন্ন কোনো সমাজের সাথে রাসূলের সম্পর্ক নেই বলেও কোরআনে বলা হয়েছে। সূরা আনআমের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং অনেক দলে (বিভিন্ন মাযহাবে)বিভক্ত হয়ে গেছে, ( হে মুহাম্মাদ!) তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই।নবী করিম (সা) সবসময়ই মুসলমানদের ঐক্য কামনা করেছেন। একবার এক ইহুদির প্ররোচনায় দুই কবিলার মুসলমানরা পরস্পর সংঘর্ষের মুখোমুখি দাড়িয়েঁ গিয়েছিল।নবীজী অনতিবিলম্বে তাদের কাছে গিয়ে হাজির হয়ে বললেনঃ খোদাকে ভয় করো!খোদাকে ভয় করো!তোমরা আমার চোখের সামনে সেই জাহেলি প্রথাকে নতুন করে নিয়ে আসছো, তাও আবার ইসলামের মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদেরকে হেদায়েত দেওয়ার পর!যেই ইসলাম জাহেলিয়াত থেকে তোমাদের মুক্তি দিয়েছে এবং কুফুরি থেকে রক্ষা করেছে এবং তোমাদেরকে পরস্পরের প্রতি সদয় ও ঘনিষ্ট করেছে?
হযরত আলি (আ) ও সুন্দর ভাষায় সকল মুসলমানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অনৈক্য ও বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বিরত থাকতে। তিনি বলেছেনঃ 'মুসলিম সমাজ থেকে পৃথক বা বিচ্ছিন্ন হয়ো না,আল্লাহর রহমত সমাজ বা ঐক্যের মাঝে,তাই বিচ্ছিন্নতা পরিহার করো,মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি শয়তানের শিকার যেমনটি পাল থেকে বিচ্ছিন্ন ভেড়া নেকড়ের শিকার হয়। যুগে যুগে মুসলিম বড়ো বড়ো মনীষীদের বক্তব্যেও সবসময় ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খ্রিষ্টিয় অষ্টাদশ শতাব্দিতে ওহাবি মতবাদ সৃষ্টি করে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব মুসলমানদের ঐক্যে মারাত্মক বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করে। ওহাবিরা নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অন্যান্য মুসলমানকে মুশরিক বলে ঘোষণা করে এবং তাদের জান-মাল এমনকি নারীদেরকে নিজেদের জন্যে হালাল বলে ঘোষণা করে।
ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে ওহাবিরা বহু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে সালাফিদের নৃশংসতা কতো জঘণ্য। এরা কেবল নিজেদেরকেই তৌহিদের অনুসারী বলে মনে করে বাদবাকি সবাই তাদের দৃষ্টিতে মুশরিক। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আকিদা মুসলমান সমাজকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। অথচ কোরআন মুসলমানদের একের বিরুদ্ধে আরেকজনের অভিযোগ, অপবাদ দেওয়া, নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবা কিংবা বিচ্ছিন্নতা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের একটি ফতোয়া থেকেই এই মতবাদে বিশ্বাসীদের মাঝে সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে। সেইসাথে ইসলাম এবং আল্লাহর শত্রুদের মোকাবেলায় মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতির পথে সৃষ্টি হয়েছে বিচ্ছিন্নতার দেয়াল। কাশফুশ শাবহাত নামক গ্রন্থে তিনি লিখেছেন "যারা ফেরেশতা, পয়গাম্বর কিংবা আল্লাহর অলিদেরকে... শাফায়াতকারী বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম বলে গণ্য করবে তাদের রক্ত হালাল এবং তাদেরকে হত্যা করা বৈধ।" ইতিহাসে লক্ষ্য করা গেছে আলেসৌদ সরকার কারবালা, মদিনা, তায়েফসহ আরো বহু ইসলামী স্থাপনায় হামলা চালিয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে।
উগ্র এই মতবাদের সহিংসতার অসন্তোষজনক পরিণতি এখন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিকৃত চিন্তাধারার অধিকারী ওহাবি মতবাদের ধারক হচ্ছে এযুগের সহিংসতাকামী গোষ্ঠি তালেবান, আলকায়েদা এবং সেপাহে সাহাবাসহ এজাতীয় আরো অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠি। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইরাকসহ আরো অনেক দেশে পাশবিক হামলা চালিয়ে এরা বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামকে ভয়ঙ্কর চেহারায় তুলে ধরছে। ভয়াবহ এই সালাফি গোষ্ঠিগুলো অন্যান্য মুসলমানকে মুশরিক ভেবে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। আমরা উগ্র এই গোষ্ঠিগুলোর পেছনের ইতিহাস একটু দেখা নেওয়ার চেষ্টা করবো।
আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী এবং ওহাবি গোষ্ঠি তালেবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, পাকিস্তান ও সৌদিআরবের যৌথ প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হয়েছে। তাদের নেতা হলো মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর। এই গোষ্ঠিটি ১৯৯৬ সালে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করে এবং দেশের শাসনভার হাতে তুলে নেয়। তারা ওহাবিদের কাঙ্ক্ষিত সরকারের নমুনা জনগণের সামনে তুলে ধরে। তারা ইসলামের নামে নৃশংস এবং মূর্খতাপূর্ণ আইন কানুন চালু করে। সিনেমা থিয়েটার বন্ধ করে দেয়। জনগণকে বেত্রাঘাত করে জামাতে নামায পড়তে বাধ্য করে এবং লম্বা দাড়ি রাখতেও বাধ্য করে। তালেবানরা মেয়েদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং মহিলাদেরকে ঘরের বাইরে কাজ করতে নিষেধ করে। তালেবানরা তাদের আকিদা বিরোধীদের হত্যা করে চাই সে সুন্নি হোক কিংবা শিয়া। এই উগ্র গোষ্ঠিটি মুসলমানদের ঐক্যকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পশ্চিমা মিডিয়াগুলোকে ইসলাম বিরোধী প্রচারণা চালাবার মোক্ষম সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
সেপাহে সাহাবা নামে এরকম আরেকটি গোষ্ঠি আছে পাকিস্তানে। তালেবান এবং সৌদি আরবের সহযোগিতায় সৃষ্টি হয়েছে এই গোষ্ঠিটি। এরা ওহাবিদের চেয়েও বেশি উগ্র। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে পাকিস্তানের শিয়াদেরকে তারা নির্দয়ভাবে হত্যা করছে। ইমাম হোসাইন (আ) এর জন্যে শোকানুষ্ঠান পালনের ঘোর বিরোধী এই গোষ্ঠিটির প্রধান টার্গেট হলো শিয়া এবং সুন্নিদের মাঝে ফাটল ধরানো। মসজিদে নামাযরত অবস্থায়ও এই উগ্র গোষ্ঠিটি মুসল্লিদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। কেবল শিয়া-সুন্নিদেরকেই নয় বরং তারা নিজেদের তরিকার লোকজনকেও নির্মমভাবে হত্যা করতে দ্বিধা করে না।
আলকায়েদা' এরকম আরেকটি গোষ্ঠি। ওসামা বিন লাদেনের মাধ্যমে এই গোষ্ঠিটির জন্ম হয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই গোষ্ঠিটির গোপন সম্পর্ক রয়েছে তবুও ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পেছনে এই গোষ্ঠিটির হাত থাকার অজুহাতে আলকায়েদার ঘাটিঁ হিসেবে পরিচিত আফগানিস্তানের ওপর মার্কিনীরা হামলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করে। ওহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠিটি এখন বিভিন্ন নামে ইরাক, ইরান, ইয়েমেন, সিরিয়া, সোমালিয়াসহ আরো বহু মুসলিম দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মুসলমানদেরকেই তাদের প্রধান শত্রু বলে মনে করছে।
অথচ বোখারি শরিফে এসেছে, খায়বার যুদ্ধে আলি (আ) এর এক প্রশ্নের জবাবে হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেনঃ তাদের সাথে লড়াই করো যতোক্ষণ না তারা বলে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) তাঁর প্রেরিত রাসূল। এই দুটি বিষয়ে যদি তারা সাক্ষ্য দেয় তাহলে তাদের রক্ত ঝরাণো জায়েয নেই।' অথচ ওহাবিরা যাদের রক্ত ঝরাচ্ছে তারা সবাই মুসলমান। আসলে ওহাবিদের এইসব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বে ইসলামকে ভয়ঙ্কররূপে তুলে ধরা। যদিও কোরআনে বলা হয়েছেঃ আমরা আপনাকে রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী করি নি, কেননা আপনি যদি রাগী ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচিছন্ন হয়ে যেতো।' অন্যত্র এসেছে দ্বীন তো প্রেম ছাড়া আর কিছু নয়।
আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা,রাসূলের প্রতি ভালোবাসা, সালেহিন এবং সকল মানুষকে ভালোবাসা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। ভালোবাসা এবং প্রেমের ভিত্তিমূলে সৃষ্ট এই ঐশী ধর্ম এখন ওহাবিদের মতো উগ্র গোষ্ঠিগুলোর কার্যক্রমের ফলে সুযোগ সন্ধানী ইসলামের শত্রুরা এই দ্বীনটিকে বিকৃতভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছে। ওহাবিদের কার্যক্রমকে কাজে লাগিয়ে তারা ইসলাম এবং মুসলমানদেরকে উগ্র এবং সন্ত্রাসী বলে প্রচার চালাচ্ছে।
আল্লাহ সবাইকে দ্বীনের সঠিক বোধ ও উপলব্ধি দিন।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন