ওহাবি মতবাদঃ ১৭তম পর্ব

ওহাবি মতবাদঃ ১৭তম পর্ব
ইসলামী দ্বীন অনুযায়ী শাফায়াত হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্যে অসামান্য এক নিয়ামত।যেসব ব্যক্তি আল্লাহর বন্দেগি ত্যাগ করেনি এবং কুফুরি বা শির্‌ক করে নি, আল্লাহর আওলিয়াদের শাফায়াত তাদের জন্যে আশার আলোর মতো। শাফায়াত তাদের অন্তর থেকে হতাশা দূর করে দেয় আর আল্লাহর রহমতের প্রতি তাদের আগ্রহ উদ্দীপনা বাড়ায়। কিন্তু শাফায়াত সম্পর্কে বাহ্যত কিছু ইসলামী ফের্কা যেসব বোধ-বিশ্বাস বা মতাদর্শের কথা বলে সেগুলো একটু পর্যালোচনার বিষয়। সালাফিয়া বা ওহাবিরা বিশ্বাস করে কোরআনের সুস্পষ্ট হুকুম অনুযায়ী দোয়া করার সময় আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ডাকা ঠিক নয় কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে শাফায়াতের আবেদন জানানোর মানে হলো এক আল্লাহর বাইরে কারো কাছে নিজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা।
তাঁরা সূরা জ্বিনের ১৮ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন যেখানে বলা হয়েছেঃ 'তোমরা আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে ডেকো না।' একইসাথে সূরা মুমিনের ৬০ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ 'তোমরা আমাকে ডাকো,আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো'। উদ্ধৃত আয়াত দুটির প্রথমটিতে-যেখানে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে না ডাকে-তা থেকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো প্রার্থনা করাকে হারাম বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর উদ্দেশ্যে রুকু সিজদা করা, ইবাদাত করা শির্‌ক হিসেবে পরিগণিত,যারা তা করবে তারা মুশরিক হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর অলিদের কাছে শাফায়াত কামনা করার মানে তাদের ইবাদাত করা নয় বরং যারা শাফায়াত কামনা করে তারা জানে শাফায়াত কেবল আল্লাহর সম্মতিতেই সংঘটিত হয়। এধরনের ব্যক্তি মুমিন এবং আল্লাহর ওলিদেরকে 'মাধ্যম' হিসেবে গ্রহণ করে যাতে তাঁরা ঐ ব্যক্তির জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করে, কেননা আল্লাহ পাক পয়গাম্বর এবং পুণ্যবানদের দোয়া ভালোভাবে কবুল করেন।
সুতরাং কেউ যদি তার গুনাহগুলো ক্ষমার জন্যে কিংবা তার প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্যে দোয়া চাইতে নবীজীর শরণাপন্ন হয় সেটা কক্ষণো নবীজীকে আল্লাহর মতো চিন্তা করা হয় না বরং তাকেঁ কেবল 'মাধ্যম' হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুফাস্‌সির আল্লামা তাবাতাবায়ি এ সম্পর্কে বলেছেন ইমামের কাছে প্রয়োজনীয়তা মেটানোর প্রত্যাশা করাটা তখনি শের্‌ক বলে পরিগণিত হবে যখন প্রত্যাশাকারী ইমামকে পরোয়ারদেগারের মতো প্রভাবশালী এবং চিরন্তন শক্তির অধিকারী বলে চিন্তা করবে। কিন্তু শক্তিমত্তার অধিকারী যদি আল্লাহকেই ভাবা হয় আর ইমামকে যদি মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয় তাহলে শির্‌ক হবে না।
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব ইসলামের নামে যে ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাসের প্রসার ঘটিয়েছেন ইসলামের মৌলিক এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুযায়ী সেগুলোর অসারতা প্রমাণিত হবার ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। প্রকৃত ব্যাপারটা হলো ইবনে তাইমিয়ার মতো আব্দুল ওহাবরাও ইবাদাত বা প্রার্থনার গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে নি। এজন্যেই তারা ভেবেছে নেককার শাফায়াতকারীগণের কাছে শাফায়াতের প্রত্যাশা করা মানে তাদের ইবাদাত করা। তারা জানতো না যে প্রকৃত ইবাদাত হলো আল্লাহর দরবারে পরিপূর্ণ বিনয়ের প্রকাশ, কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সম্মান করা বা তার প্রতি বিনয় প্রদর্শন করা ইবাদাত নয়। এমনকি সেই গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ববর্গ যদি নবী কারিম (সা) কিংবা তাঁর আহলে বাইতের মহান ইমামদের মতোও হন-যাঁরা নিজেরাই আল্লাহর বন্দেগি এবং আনুগত্য করার ক্ষেত্রে আদর্শস্থানীয়।

শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে ওহাবিদের আরেকটি দলিল হলো এই যে, তারা মনে করে শাফায়াতের অধিকার কেবল আল্লাহরই রয়েছে,তাঁর বাইরে আর কারো ঐ অধিকার নেই। তারা তাদের বক্তব্যের পক্ষে পবিত্র কোরআনের সূরা যুমারের ৪৩ এবং ৪৪ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেখানে বলা হয়েছেঃ 'তারা কি আল্লাহ ব্যতীত সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলুন! তাদের কোনো এখতিয়ার না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? বলুন সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন! আসমান ও যমিনে তাঁরই সাম্রাজ্য, অতপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।' কিন্তু এ আয়াতে এ কথা বলা উদ্দেশ্য নয় যে, 'কেবল আল্লাহই শাফায়াত করবেন,ব্যাস..অন্য কারো আর শাফায়াত করার অধিকার নেই।' কেননা এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আল্লাহ কখনোই কারো জন্যে কারো কাছে শাফায়াত করবেন না এবং আল্লাহ এসব কাজের অনেক উর্ধ্বে। বিবেকও এটা সমর্থন করে না যে বলি কোনো বান্দার গুনাহ মাফের জন্যে খোদা 'মাধ্যম' হয়েছেন। কারণটা হলো এই, একথা বলার সাথে সাথে যে প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলো আল্লাহ মাধ্যম হয়ে কার কাছে শাফায়াত করবেন? তাই আয়াতের কেন্দ্রীয় বক্তব্য হচ্ছে আল্লাহ হলেন শাফায়াত গ্রহণ করার মালিক। তিনি যাকেই উপযুক্ত মনে করবেন তাকেঁই বান্দার ব্যাপারে শাফায়াত করার অনুমতি দেবেন। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী ওহাবিদের দাবির সাথে এই আয়াতের কোনো সম্পর্কই নেই। রাসূলে খোদার সময় থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানরা কেবল বিশ্ব স্রষ্টাকেই শাফায়াতের মালিক এবং শাফায়াত গ্রহণকারী হিসেবে মনে করে আসছে,তাঁর কোনো আওলিয়াকে নয়। সেইসাথে মুসলমানরা এ-ও বিশ্বাস করে যে কেবল তিনি বা তাঁরাই শাফায়াত করার যোগ্য যাদেঁরকে আল্লাহ শাফায়াত করার অনুমতি দিয়েছেন। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী রাসূলে খোদা (সা)কে আল্লাহ শাফায়াতের অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং শাফায়াত করার অনুমতিপ্রাপ্ত হিসেবে তাঁর কাছে শাফায়াতের আবেদন জানানোটাই স্বাভাবিক এবং যুক্তিযুক্ত।
বোখারি এবং মুসলিমের মতো বিখ্যাত হাদিসবেত্তাদের মতো আলেমগণও তাঁদের সংকলিত হাদিস গ্রন্থে কক্ষণো শাফায়াতকে শির্‌ক বলে উল্লেখ করেন নি। মুহাম্মাদ তিরমিযির সুনানে তিরমিযি সহিহ হাদিস গ্রন্থ 'সিহহা সিত্তা'র অন্তর্ভুক্ত অন্যতম প্রধান একটি গ্রন্থ। তিরমিযি তাঁর গ্রন্থে শাফায়াত সম্পর্কে আনাস ইবনে মালিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। আনাস ইবনে মালিক বলেনঃ নবীজীর কাছে আবেদন জানিয়েছি কিয়ামতের দিন তিনি যেন আমার জন্যে শাফায়াত করেন। তিনি আমার আবেদন গ্রহণ করে বললেনঃ 'আমি এ কাজটি আঞ্জাম দেবো।' নবীজীকে বললামঃ 'আপনাকে কোথায় খুজেঁ পাবো?' নবীজী বললেনঃ 'পুলসিরাতের কাছে।' যাই হোক, আনাসের কাছে মোটেও মনে হয় নি যে শাফায়াতের আবেদন করা এক ধরনের শির্‌ক।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন