ইরানের উৎসব

ইরানের উৎসব
হাজার বছরের পরিক্রমায় বয়স, ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে সর্বস্তরের ইরানী জনগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে নওরোয পালন করে আসছে। ফার্সী ভাষায় ‘নওরোয’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘নতুন দিন’ বা নববর্ষ এবং এটি সৌর বছরের শুরু বোঝায়। এটি একই সাথে ইরানী জাতি ও অপর কিছু সংখ্যক জাতিরও ক্যালেন্ডারের শুরু।
নওরোয উৎসব হলো প্রকৃতির পুনর্জন্ম উৎসব। এ পুনর্জাগ্রত হওয়া অন্ধকার অপশক্তিরূপ শীতকালের বিরুদ্ধে উত্তম শক্তির বিজয়ের প্রতীক।
প্রাচীন পারস্যে কখন এবং কিভাবে নওরোয অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে তা জানা যায় নি। তারপরও এটা বলা যায় যে, ইরানীরা সব সময়ই নওরোয পালন করে এসেছে।
ইরানের বিখ্যাত কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী (৯৪০-১০২০) তাঁর মহাকাব্য শাহনামায়, আবু রায়হান আল বিরুনী, কবি ওমর খইয়াম তাঁর ‘নওরোযনমেহ’  গ্রন্থে নওরোযের উৎসবকে ইরান সম্রাট জামশিদের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।
প্রাচীন ইরানে ইরানীরা প্রধানত দু’টি উৎসব পালন করতো যে সম্পর্কে লোগ্বাতনমে দেহখোদায় উল্লেখ করা হয়েছে। নওরোয বলতে সাত মাসব্যাপী গ্রীষ্মকালের শুরুকে বোঝাতো, আর ‘মেহেরগান’ উৎসব হতো শরৎকালের প্রথম ভাগে যা এখনো জরথুস্ত্রীদের দ্বারা পালিত হয়।
নওরোয উৎসবের ব্যাপারে প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক রেকর্ড পাওয়া যায় ২৫০০ বছর আগের হাখামানেশী আমলের। তারা সেই অঞ্চলে প্রথম সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এবং শিরাজ নগরীর সন্নিকটে ‘পারসেপোলিস কমপ্লেক্স’ তৈরি করে।
চার ঋতুর জন্য হাখামানেশীদের ভিন্ন ভিন্ন চারটি আবাসস্থল ছিল। পারসেপোলিস ছিল তাদের বসন্তকালীন আবাসস্থল এবং নববর্ষ উদ্যাপনের স্থান। প্রাচীন ভাস্কর্যের নকশাদিতে দেখা যায়, সম্রাট সিংহাসনে বসে তাঁর নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের প্রজাসাধারণ, গভর্নর এবং বিভিন্ন অঞ্চলের দূতদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। তাঁরাও সম্রাটকে উপহার সামগ্রী দিচ্ছেন এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। আমরা এসব রীতি সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, সকালগুলো প্রার্থনা ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতো।
ইসলামের আগমনের পূর্বে ইরানের সর্বশেষ রাজবংশ সাসানীদের আমলে নতুন বছরের প্রথম দশ দিন নওরোযের উৎসব পালন করা হতো। ইরানে ইসলামের আবির্ভাবের পর নওরোয উৎসব পালন করা হতে থাকে মহানবী (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের দিন অর্থাৎ ১ রবিউল আউয়াল থেকে (আরবি ‘রবি’ শব্দের অর্থ বসন্ত)। নয় শতাব্দীরও পূর্বে প্রখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ওমর খইয়াম তুর্কী সালজুক শাসক মালেক শাহেব নির্দেশনায় যথাযথভাবে সৌর হিজরী ক্যালেন্ডার তৈরি করেন এবং ফারভারদিন মাসের ১ তারিখকে নওরোয হিসাবে  নির্দিষ্ট করেন। এ দিক থেকে ২০১২ সালের ২১ মার্চের নতুন বর্ষ হলো সৌর বর্ষ হিসাবে মহানবী (সা.)-এর হিজরতের ১৪৩৩ সাল।
ইরানীরা আজো তাদের ঐতিহ্যবাহী নওরোয পালন করে। নওরোযের আরো অনেক আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় ঐতিহ্য রয়েছে যা এখনো ইরানীদের দ্বারা উদ্যাপিত হয়। যখন রেডিও বা টেলিভিশনে নওরোযের ঘোষণা দেয়া হয় তখন পরিবারের ছোট সদস্যরা বড়দের প্রতি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়, তাদের গালে চুমু দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে, কখনো কখনো তাদের হাতেও চুম্বন করে। আত্মীয়-স্বজনরা পরস্পরকে চুম্বন ও কোলাকুলি করে, টাকা উপহার দেয়। সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয় যাতে বছরের অবশিষ্ট সময়ে তাদের জীবন মধুময় হয়। একটি ছোট আয়না চারদিকে ঘোরানো হয়, বাতাসে গোলাপ পানি ছিটানো হয় এবং কুদৃষ্টি দূর করার জন্য এসফান্দ নামক সুগন্ধী বীজ জ্বালানো হয়।
প্রথম কয়েকদিন পরিবারের বয়স্ক সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে সাক্ষাতে ব্যয় করা হয়। শিশুরা বড়দের নিকট থেকে উপহার সামগ্রী লাভ করে। মিষ্টি ও অন্যান্য বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়।
নওরোয উৎসব হলো ইরানীদের ইতিহাস, সাহিত্য, কবিতা ও জনসাধারণের জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব।
তাজিকিস্তান, ইরাকী কুর্দিস্তান, আফগানিস্তান, কাজাখস্তান, উযবেকিস্তান, ভারতের একটি অংশে, পাকিস্তান এবং চীনেও ব্যাপকভাবে নওরোয পালন করা হয়। মিশর, ফিলিস্তিন এবং সিরিয়ায় বসন্ত উৎসব পালন করা হয় যা ‘ঈদ-উল-উম্ম বা ‘প্রকৃতি মায়ের উৎসব’ নামে পরিচিত। জাপনীরাও মার্চ মাসে বসন্ত উৎসব পালন কলে। আঠারো শতক পর্যন্ত রাশিয়া যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত তাতে বছর শুরু হতো ২৪ মার্চ। এসব কারণে ‘বসন্তবিষুব’ দিন জাতিসংঘ কর্তৃক ছুটির দিন বলে ঘোষিত হয়েছে।
নওরোযের বাণী হলো সামাজিক ন্যায়বিচার, ঐক্য, সাহচর্য, আনন্দ, সুখ এবং মানবতার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির বাণী।
সূত্রঃ ইন্টারনেট

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন