হযরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (আ.)

হযরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (আ.)
এই অনন্য ব্যক্তিত্ব। যিনি দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস ও ঐতিহাসিকদের চিন্তা চেতনাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে আসছেন। ভবিষ্যতেও এ আলোড়ন অব্যাহত থাকবে। তিনি এমন এক মহান চরিত্র যিনি ইসলামের ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে আছেন। যখনই তাঁর কথা আলোচনা করা হয় তখনই বিশ্বাসী মুসলমান নর নারীর অন্তর তাঁর প্রতি গভীর ভালবাসা ও অসীম শ্রদ্ধায় ভরে যায়। তিনি হচ্ছেন আল্লাহ্র হাবীব হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৌহিত্র মা ফাতিমার দ্বিতীয় পুত্র রায়হানা (অতীব প্রিয়), বেহেশতে যুবকদের সরদার, হযরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (আ.) বিন আবি তালিব বিন আবদুল মুত্তালিব বিন হাশিম বিন আবদ মুনাফ আল কোরাইশি আল হাশিমী।
মুমিনদের চোখে তিনি এমন এক কিংবদন্তীতুল্য বীর পুরুষ যিনি দ্বীন ও আদর্শের জন্য আপন জীবনকে কুরবানী করে দিয়েছেন। তিনি ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও ত্যাগের উজ্জ্বল প্রতীক। তিনি সেই বহুল প্রচলিত প্রবাদবাক্যের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি যাতে বলা হয়েছে, ‘‘মৃত্যুকে আলিঙ্গন কর তাহলে জীবনকে ফিরে পাবে।’’ তিনি মহান শহীদী মৃত্যু কামনা করেছিলেন আর হয়েছেন অনন্ত জীবনের অধিকারী। মানুষের স্মৃতিপটে তিনি আপন মহিমায় ভাস্বর। মুসলমানদের অন্তরে তিনি চিরদিনের জন্য ঠাঁই করে নিয়েছেন। আত্মোৎসর্গের এক মহান প্রতীক তিনি।
শুভ আবির্ভাব
হযরত ইমাম হাসান (আ.) এর বয়স তখনও দু’বছর পূর্ণ হয়নি। আল্লাহ্র নবী রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট খবর এল অচিরেই তাঁর দ্বিতীয় নাতি দুনিয়ায় আসছেন। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বকালকে আইয়ামে জাহেলিয়া অর্থাৎ অন্ধকার যুগ বলা হয়। সে যুগে ‘হাসান’ ‘হোসাইন’ এ সমস্ত নাম কারো জানা ছিল না। কোথাও চালুও ছিল না। হযরত উমর বিন সোলাইমান (আ.) হতে বর্ণিত, ‘হাসান’ ‘হোসাইন’ নামসমূহ বেহেশতবাসিদের মধ্যে হতে এসেছে, জাহেলি যুগে এ সমস্ত নাম কারো জানা ছিল না। (উসদুল গাবাহ, ২য় খন্ড)
চতুর্থ হিজরির ৩ শা’বান মাসে (৮ জানুয়ারি ৬২৬ইং) তাঁর জন্ম। তাঁর জন্মের শুভ সংবাদে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর তাহনিক (তাহনিকঃ একটি ইসলামি প্রথা। খেজুর ইত্যাদি জাতীয় ফল চিবিয়ে তার রস নবজাতকের প্রথম খাবার রূপে মুখে দেয়া এবং পরে তার কানে আযান দেয়া) করলেন ও তাঁর কানে আযান দিলেন। (আত তিরমীযি) এবং তিনিই নবজাতকের নাম হোসাইন রাখেন। হাদিস শরীফের বর্ণনায় এর প্রমাণ আছে।
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর চেহারা ছিল খুবই আকর্ষণীয় ও সুন্দর। হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র চেহারা মোবারকের সাথে তাঁর চেহারার মিল ছিল। যেভাবে মিল ছিল তাঁর বড় ভাই হযরত হাসান (আ.) এর চেহারা। জন্মের সাতদিনের দিন স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি মেষ (কোন কোন বর্ণনায় দুটো) জবেহ করে তাঁর আকীকা (আকীকাঃ ইসলামী প্রথা। শিশুর জন্মের পর আল্লাহ্ তা’য়ালার প্রতি শুকরিয়া হিসাবে একটি বা দুটো মেষ অথবা এ জাতীয় পশু জবেহ করা। ছেলের জন্য দুটো ও মেয়ের জন্য একটি) দেন। এরপর তিনি হযরত ইমাম হাসান (আ.) এর বেলায় যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন তেমনি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর মাথার চুল কামিয়ে তার ওজনের সমপরিমাণ রৌপ্য গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

দু’সহোদর
হযরত ইমাম হাসান (আ.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এ দু’সহোদরের নাম এমন ওৎপ্রোতভাবে জড়িত যে, অনেকেই ভুলক্রমে তাঁদেরকে যমজ ভাই মনে করে থাকে। অবশ্য তাঁদের দু’ভাইয়ের মধ্যে ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতি এতই গভীর ছিল যে, তা অনেক যমজ ভাইয়ের মাঝেও দেখা যায় না। তাঁদের উভয়ের মধ্যে বয়সের ব্যবধান দু’বছরেরও কম। হযরত হোসাইন (আ.) যখন বুকের দুধ খাচ্ছেন তখন হযরত হাসান (আ.) এর ভালো করে মুখের বুলিও ফোটেনি। তাঁরা দু’জন ছিলেন একাত্ম্য। একসাথে খেতেন তাঁরা, একসাথে খেলতেন। দু’জনের স্মৃতিও এক। কোথাও যেতে হলে একসাথে যেতেন তাঁরা। তাঁদের দু’জনের মধ্যে ভালবাসার যে গাঢ় বন্ধন তার পেছনকার রহস্য ছিল তাঁরা দু’জনই মহান পুরুষের পিতৃস্নেহে লালিত পালিত হয়েছিলেন। পেয়েছিলেন তাঁদের উষ্ণ সান্নিধ্য। তাঁদের পারিবারিক পরিবেশও ছিল খুবই চমৎকার, উন্নত ও সদাচরণের অনুকূল। উভয়ের প্রতি উভয়ের ছিল প্রবল অনুরাগ, আচার আচরণে ছিলেন খুবই বিনম্র ও শালীন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা উভয়ে কখনো একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতেন না। পবিত্র হাদিস শরীফে যেখানে হযরত হাসান (আ.) এর নাম উচ্চারিত হয়েছে সেখানে অনিবার্যভাবে হযরত হোসাইন (আ.) এর কথাও উল্লেখিত হয়েছে। নিম্নোক্ত হাদিস শরীফেও এ কথার প্রমাণ মেলে।
হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘হাসান এবং হোসাইন বেহেশতে যুবকদের সরদার…….।’’
(তিরমীজি)
হযরত ওসামা বিন যায়েদ হতে বর্ণিত একটি হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, হুজুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘এরা দু’জন আমার বংশ এবং আমার কন্যার সন্তান, হে আল্লাহ্! আমি তাদেরকে ভালবাসি, আপনিও তাঁদের ভালবাসুন, আর তাদেরকেও ভালবাসুন যারা এদের দু’জনকে ভালবাসে।’’
(তিরমীজী)
হযরত হোজাইফা বর্ণনা করেন, ‘‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে হোজাইফা! এই মাত্র হযরত জিবরাঈল (আ.) এসে আমাকে সুসংবাদ দিয়ে গেলেন, হাসান হোসাইন হবে বেহেশতে যুবকদের সরদার।’’ (আহমদ)
হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) এর নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে এমন হাদিসের সংখ্যা অসংখ্য। হযরত হোসাইন (আ.) এর জীবনী বর্ণনাকালে আমরা আরও কিছু হাদিসের উল্লেখ করব।
বস্ত্তত তাঁদের উভয়কে সবসময় একই সাথে দেখা যেত। বাইরে গেলেও তাঁরা একসাথে বের হতেন। একদিন তাঁরা ঘর হতে বের হয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন। হারিয়ে ফেলেছিলেন পথের দিশা। মা জননী ফাতিমা (আ.) তাঁদের অনুপস্থিতিতে পাগলপারা হয়ে পড়লেন। ভাবলেন তাঁদের কোথাও কোন বিপদ ঘটেছে। তিনি দ্রুত আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘‘হাসান হোসাইন দু’জনই বাইরে চলে গেছে। আমি জানি না তারা কোথায় আছে।’’ তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের প্রতি তোমার চাইতেও বেশি দয়ালু ও যত্নবান।’
অতঃপর তিনি মহান আল্লাহ্র দরবারে তাঁদের নিরাপত্তার জন্য এই বলে দোয়া করলেন, ‘‘ইয়া আল্লাহ্! তারা জলে ও স্থলে যেখানেই থাকুক না কেন, তাদেরকে নিরাপদে ফিরিয়ে দিন ও সুরক্ষা দান করুন।’’ তারপর আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে তাঁদের সম্পর্কে খবর পৌঁছল। তাঁদের এক জায়গায় পাওয়া গেল যেখানে তাঁরা একে অন্যের বাহুতে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলেন এবং তাঁদেরকে চুমু খেলেন। তিনি হযরত হাসান (আ.) কে ডান কাঁধে ও হযরত হোসাইন (আ.) কে বাম কাঁধে তুলে নিলেন। আর বললেন, ‘আল্লাহ্র কসম, আমি তোমাদের প্রতি সেভাবেই দৃষ্টি রাখব যেভাবে মহান সম্মানিত ও গৌরবের অধিকারী আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি দৃষ্টি রাখেন।’
পথিমধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক এর সাথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাৎ হল। তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্! একজনকে আমায় দিন যাতে আপনার বোঝা কিছু হালকা হয়।’ কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, ‘‘কি চমৎকার বাহন তাদের আর কি চমৎকার আরোহীই না তারা! আর তাদের পিতা তাদের চেয়ে উত্তম।’’ এভাবে তিনি তাঁদেরকে মসজিদ পর্যন্ত বহন করে নিয়ে এলেন।’’
(মাজমা’উজ জাওয়ায়েদ কৃত আল হাইতামি, খন্ড ৯, পৃ: ১৮২)
হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) দু’জনও আল্লাহ্র হাবীব নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। তিনি যেখানেই থাকতেন তাঁকে তাঁরা খুঁজে বের করতেন।
একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন। সেখানে হযরত হাসান ও হযরত হোসাইন (আ.) উপস্থিত হলেন। তাঁদের পরনে ছিল লাল পোশাক। তাঁরা একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন আবার উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। তিনি খুতবার জায়গা থেকে নেমে এলেন এবং তাঁদেরকে সামনে নিয়ে রাখলেন। এবং বললেন, ‘‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা সত্য কথাই বলেছেন, ‘‘তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ।’ (সূরা আত-তাগাবুন ৬৪:১৫) আমি দু’বালককে দেখার পর আর অপেক্ষা করতে পারিনি। এরপর তিনি আবার খুতবা দিতে শুরু করলেন।’’
(মুসনাদ আহমদ, সুনান আবু দাউদ ও ইবনে মাজা)
আল্লাহ্র হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বড়ই জ্ঞানী। তিনি উভয়ের উপর খুবই প্রভাব বিস্তার করতেন। তাঁদের উভয়ের জন্য ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ। তাঁরা এমন এক প্রেমময় পরিবারে বেড়ে উঠেছেন যেখানে একের প্রতি অন্যের ছিল অফুরন্ত দরদ, ভালবাসা ও সহানুভূতি। তাই তাঁদের মাঝে এমন অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল যে, তাঁরা যেন দু’জনে মিলে একজন।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা বর্ণনা করেন, ‘মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন কালো পশমের চাদর পরে বাইরে এলেন। তাতে উটের জিনের ছবি অঙ্কিত ছিল। তখন হযরত ফাতিমা (আ.) এলেন। তিনি তাঁকে চাদরের মধ্যে ঢুকালেন। এরপর হযরত হাসান বিন আলী (আ.) এলেন। তাঁকেও চাদরের নিচে নেয়া হল। তারপর এলেন হযরত হোসাইন (আ.)। তাঁকেও চাদরের নিচে নেয়া হল। সবশেষে এলেন হযরত আলী (আ.)। তাঁকেও চাদরের নিচে ঢুকালেন। তারপর বললেন, ‘‘হে আহলে বায়ত (নবী পরিবারের সদস্য)! আল্লাহ্ শুধু চাহেন তোমাদের থেকে সর্বপ্রকার অমঙ্গল ও পাপ বিদূরিত করতে।’’ (আল আহযাব ৩৩ঃ ৩৩) এ কারণে তাঁদেরকে চাদরের সাহাবা বলা হয়।
শৈশব হতেই তিনি তাঁদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন ছোটরা যাতে বড়দের শ্রদ্ধা ও সেবা করে। কারণ যে ভালবাসার পেছনে সম্মানবোধ থাকে না সে ভালবাসা অপূর্ণ। সম্মানবোধ ভালবাসার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই হযরত হোসাইন (আ.) সবসময় হযরত হাসান (আ.) কে সম্মান করে চলতেন। তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দিতেন। তাঁর যে কোন কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলতেন। যদি না তা অসঙ্গত কোন কাজ হত। কিন্তু হযরত হাসান (আ.) এর পক্ষ হতে কোন ধরনের অসঙ্গত কাজের নির্দেশ দেয়া অভাবনীয় ছিল।
তাই হযরত হাসান (আ.) যখন মুয়াবিয়া এর পক্ষে খিলাফতের দাবি পরিত্যাগ করতে চাইলেন তখন হযরত হোসাইন (আ.) তা মেনে নিতে পারলেন না। কিন্তু যখন দেখলেন হযরত হাসান (আ.) তাঁর সিদ্ধান্তে অটল, তখন তিনি বললেন, ‘‘আপনি আমার চেয়ে বড়, আপনি খলিফা আর আমার গুরুজন, আপনাকে মানার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি, অতএব আপনার কাছে যা উত্তম বলে মনে হয় তাই করুন।’’ (তাহজিবুল কামাল ৬ষ্ঠ খন্ড)
বস্ত্তত আমরা দেখি হযরত হাসান (আ.) এর ইন্তিকালের পরও হযরত হোসাইন (আ.) বড় ভাইয়ের নির্দেশ পালন করতে কুণ্ঠিত হননি। হযরত হাসান (আ.) নসিহত করে গিয়েছিলেন যাতে তাঁকে হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা মোবারকের পাশে দাফন করা হয়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা ও এতে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু মদীনার গভর্নর মারওয়ান বিন হাকাম এ বিষয়ে প্রবল আপত্তি করেন। তাতে হযরত হোসাইন (আ.) খুবই মর্মাহত হন। তিনি বিষয়টি ফয়সালার জন্য তলোয়ার বের করেন। বনু হাশিম গোত্রের কিছু যুবকও তাঁর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। প্রিয় ভাইয়ের নসিহত পালনে তিনি শক্তি প্রয়োগের জন্যও প্রস্ত্তত ছিলেন। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ্ বিন উমর তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে হযরত হাসান (আ.) তাঁর দাফন নিয়ে কোন ফিতনা সৃষ্টি ও রক্তপাত না ঘটাতে উপদেশ দিয়ে গেছেন। এ কথা শুনে হযরত হোসাইন (আ.) অস্ত্র সংবরণ করেন। তিনি ভাইয়ের অসিয়ত পালনের উদ্দেশ্যেই অস্ত্র ধারণে প্রস্ত্তত ছিলেন আবার সেই ভাইয়ের অসিয়তের কারণেই অস্ত্র ত্যাগে রাজি হন।
এতে প্রকাশ পেয়েছে বড় ভাইয়ের প্রতি ছোট ভাইয়ের ভালবাসার গভীরতা। আর প্রকাশ পেয়েছে কীভাবে ভালবাসার সাথে শ্রদ্ধার সংমিশ্রণ ঘটে থাকে তাও।

নানাজান নবী করীম (সা.) এর দৃষ্টিতে হযরত হোসাইন (আ.) এর মর্যাদা

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) কে গভীরভাবে ভালবাসতেন।
হযরত আবু আইউব আনসারি বর্ণনা করেন, তিনি একদিন আল্লাহ্র হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয়ে দেখেন হযরত হাসান (আ.) এবং হযরত হোসাইন (আ.) দু’জন তাঁর পবিত্র বুকের ওপর খেলছেন। তিনি তাঁকে বললেন, ‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি কী তাঁদেরকে ভালবাসেন?’’ তিনি জবাব দিলেন, ‘‘আমি কীভাবে তাদের ভাল না বেসে পারি, যেখানে পার্থিব জীবনে তারা আমার রায়হানা!’’ (আত-তাবারানি)
হযরত ই’য়ালা আল-‘আমিরি বলেন, তিনি একদিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দাওয়াতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে দেখলেন হযরত হোসাইন (আ.) কিছু ছেলের সাথে খেলছেন। তিনি তাঁকে সাথে নিতে চাইলেন। কিন্তু শিশু হোসাইন একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে ছোটাছুটি করতে থাকলেন। আল্লাহ্র নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও যে পর্যন্ত তাঁকে কব্জা করতে না পারলেন সে পর্যন্ত তাঁর সাথে ছোটাছুটি করতে থাকলেন। হাসান তাঁর ছোট্ট এক হাত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘাড় মোবারকের নিচে রাখলেন। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মুখের ওপর মুখ রেখে চুমু খেতে বললেন, ‘‘হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে। যে হোসাইনকে ভালবাসে আল্লাহ্ তাকে ভালবাসেন। সে আমার দৌহিত্রের মধ্যে একজন। যে আমাকে ভালবাসে সে যেন হোসাইনকে ভালবাসে।’’
(তারিখ বিন আসাকির। ইবনে মাজাহ কর্তৃক বর্ণিত। ইয়ালা বিন মুররাহ আত তাকাফি এর বরাতে)
প্রিয় দৌহিত্রের প্রতি হযরত রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালবাসা কত গভীর ছিল এ হাদিস শরীফে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি তাঁকে সাথে সাথেই রাখতেন। এমনকি দাওয়াতেও শরীক করতেন। তাঁর শিশুসুলভ চপলতাকে সহাস্যে সহ্য করে যেতেন। স্নেহ মমতায় তাঁকে চুমু খেতেন। তাঁর সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। বলতেন, ‘‘সে ‘সিবতুল মিনাল আসবাত’।’’ অর্থাৎ উত্তম জাতির অংশ। তিনি তাঁর পক্ষে আল্লাহ্ রাববুল আলামীনের দরবারে ফরিয়াদ জানাতেন। তিনি মুসলিম জাতির প্রতি আহবান জানিয়েছেন তাঁকে ভালবাসতে। এটা এমন এক ভালবাসা যা সহজেই আমাদের মনপ্রাণ ছুঁয়ে যায়।
হযরত উসামা বিন যায়েদ বলেন, ‘‘আমি এক বিশেষ প্রয়োজন বশত একবার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে যাই। তিনি বাইরে আসলেন। তাঁর পবিত্র হাত মোবারকে কিছু একটা ধরা ছিল কিন্তু তা কী আমি বুঝতে পারছিলাম না। প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে আমি জানতে চাইলাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আপনার বাহুতে কাকে ধারণ করে আছেন? অতঃপর তিনি তা প্রকাশ করলেন। আমি দেখলাম হাসান এবং হোসাইন তাঁর পিঠের ওপর। তিনি বললেন, ‘এরা আমার সন্তান এবং আমার কন্যার সন্তান। হে আল্লাহ্! আপনি জানেন যে, আমি তাদের ভালবাসি। অতএব, আপনিও তাদের ভালবাসুন।’ এবং তিনি এ কথা দু’বার বললেন।’’
(তারিখ বিন আসাকির, ৪র্থ খন্ড)
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আববাস বলেন, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান হোসাইনের জন্য আল্লাহ্র কাছে পানাহ চেয়ে বলতেন, ‘‘আল্লাহ্র পরিপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে আমি তোমাদের পানাহ চাই, সমস্ত শয়তান, বিষাক্ত, নীচাশয় জীব ও ঈর্ষাপরায়ণ নজর হতে।’’ (তিরমীজি)
একদিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী (আ.) এর গৃহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হযরত হোসাইন (আ.) এর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি হযরত ফাতিমা আয যাহরা (আ.) কে ডেকে বললেন, ‘‘হে যাহরা! তুমি কি জান না তার কান্না আমাকে পীড়া দেয়?’’
হযরত হোসাইন (আ.)ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ অতুলনীয় ভালবাসাকে যথাযথ মর্যাদা দিতেন। তিনি কখনো তাঁর কাছ ছাড়া হতেন না। এমনকি আল্লাহ্র হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুতবা দিতে মিম্বরে দাঁড়াতেন তখনও তিনি তাঁর কাছে থাকতেন। এ কথা আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়াসাল্লাম এর সান্নিধ্য ও ভালবাসা পেয়ে তিনি তাঁকে অনেক সময় সম্বোধন করতেন ‘‘হে আমার পিতা’’ বলে।

তাঁর প্রতি সাহাবাগণ এর ভালবাসা ও সম্মানবোধ
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবাগণ হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) এর প্রতি গভীর ভালবাসা পোষণ করতেন। তাঁদেরকে মর্যাদার চোখে দেখতেন। তাঁদের কাছাকাছি থাকতে ভালবাসতেন। এর অন্যথা হওয়ার কোন উপায়ও ছিল না। কারণ মহানবী রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তাঁদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘‘যে আমাকে ভালবাসে সে যেন তাদেরকে ভালবাসে।’’ সাহাবাগণ এর পক্ষে সেটাই ছিল শোভন ও স্বাভাবিক। কারণ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহ্ রাববুল আলামীনের দরবারে তাঁদেরকে ভালবাসার জন্য প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। আর মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’য়ালা যাকে ভালবাসেন পৃথিবীর সকল সৎকর্মশীল বান্দাই তাঁকে ভালবাসে। হযরত হোসাইন (আ.) এর চেহারা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা মোবারকের সাথে মিল ছিল। তাই তাঁর উপস্থিতি সাহাবাগণকে আল্লাহ্র প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা মনে করিয়ে দিত। এতে তাঁর প্রতি তাঁদের ভালবাসা আরো বেড়ে যেত।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) কে গভীরভাবে ভালবাসতেন। তাঁদের নৈকট্য কামনা করতেন। কারণ তিনি তাঁদেরকেই বেশি ভালবাসতেন যাঁদেরকে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালবাসতেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক লোকজনকে আহবান জানাতেন যেন তারা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবারের সদস্যদের ভালবাসে ও যথাযথ মর্যাদা দেয়।
তিনি বলতেন, ‘‘হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবারের সদস্যদের সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো।’’ তিনি আরো বলতেন, ‘‘সেই সত্বার শপথ! যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমার কাছে আমার নিজের আত্মীয়ের চেয়ে হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আত্মীয়গণ বেশি প্রিয়।’’
হযরত উমর বিন খাত্তাব হযরত হোসাইন (আ.) ও তাঁর ভাইকে খুবই সম্মানের চোখে দেখতেন। তাঁদেরকে যথাযথ মর্যাদা দিতেন। তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলতেন। হযরত উমর বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠার পর হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) সহ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার দিরহাম করে ভাতার ব্যবস্থা করেন।
হযরত হোসাইন (আ.) বলেন, আমি উমরের মিম্বরে আরোহণ করে বললাম, ‘‘আমার পিতার মিম্বর ছেড়ে আপনার পিতার মিম্বরে গিয়ে উপবেশন করুন।’’ তিনি বললেন, ‘‘আমার পিতার কোন মিম্বর নেই।’’ অতঃপর তিনি আমাকে তাঁর পাশে বসালেন। যখন তিনি মিম্বর হতে নেমে এলেন তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘হে আমার ছেলে! কে এসব আপনাকে শিখিয়েছে?’’ আমি বললাম, ‘‘কেউ আমাকে এটা শিখিয়ে দেয়নি।’’ তিনি বললেন, ‘‘হে আমার সন্তান! আল্লাহ্ এবং আপনারা ছাড়া আমাদের মাথায় এ চুল গজিয়েছেন কে?’’ তারপর তিনি তাঁর মাথায় হাত বুলালেন এবং বললেন, ‘‘হে আমার সন্তান! আপনি যদি আমাদের সাথে নিয়মিতভাবে সাক্ষাৎ করতেন…….।’’
(‘তারিখে বাগদাদ’ আল-খাতিব আল বাগদাদী কর্তৃক বর্ণিত এবং সিয়ার আলম আন নুবালা, খন্ড ৩, পৃ: ২৬৫)
একবার হযরত উমর এর কাছে ইয়েমেন থেকে কিছু কাপড় চোপড় এসেছিল। তিনি জনসাধারণের মাঝে সে সব বিতরণ করে দিলেন। এমন সময় সেখানে হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) উপস্থিত হলেন। তখন ইয়েমেনি কাপড়ের আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এতে হযরত উমর খুবই ব্যথিত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ইয়েমেনি প্রতিনিধির কাছে অতিসত্বর আরো কাপড় পাঠানোর জন্য খবর পাঠালেন। সেখান হতে পুনরায় কাপড় এলে তা থেকে দু’খন্ড হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন হোসাইন এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘‘এখন আমি স্বস্তি পাচ্ছি।’’
হযরত হোসাইন (আ.) বলেন, একদিন আমি হযরত উমর এর কাছে গেলাম। তিনি তখন মুয়াবিয়া এর সাথে একাকি ছিলেন। দরজায় হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি বেরিয়ে আসছিলেন। আমিও তাঁর সাথে বেরিয়ে এলাম। পরে তাঁর {হযরত উমর }সাথে আমার দেখা হল; তিনি বললেন, ‘‘বহুদিন আপনার সাথে আমার দেখা হয় না।’’ আমি বললাম, ‘‘ইয়া আমীরুল মোমেনীন! আমি আপনার কাছে গিয়েছিলাম, আপনি মুয়াবিয়া এর সাথে একাকি ছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর সেখানে ছিলেন। তিনি ফিরে আসছিলেন আমিও তাঁর সাথে ফিরে এসেছি।’’ তিনি বললেন, ‘‘ইবনে উমরের (আব্দুল্লাহ্র) চাইতে আমার কাছে আসার হক আপনার বেশি। আমাদের মাথায় যা গজিয়েছে তা আল্লাহ্রই অনুগ্রহে আর আপনাদের পরিবারের উছিলায়।’’

(তাহজিবুল কামাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ: ৪০৪)
আল আইজার বিন হুরায়িশ বলেন, হযরত আমর বিন আল আ’স একদিন কা’বার ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে সময় হযরত হোসাইন (আ.) কে দেখে তিনি বললেন, ‘‘বেহেশতবাসিদের চোখে আজকের দিনে পৃথিবীর পৃষ্ঠে বিচরণকারি মানুষের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন প্রিয়তম মানুষ।’’
(সিয়ার আ’লম আন নুবালা, ৩য় খন্ড)
হযরত ইবনে আববাস বহনকারী পশুদের তাঁদের {হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) এর} কাছে নিয়ে আসতেন। এ কাজকে তিনি নিজের জন্য সৌভাগ্য বলে মনে করতেন। তাঁরা দু’জন যখন আল্লাহ্র ঘর তওয়াফ করতেন লোকজন তাঁদের অভিনন্দন জানানোর জন্য ঘিরে ধরতেন। মনে হত লোকজনের ভিড়ে তাঁরা পিষ্ট হয়ে যাবেন। মহান আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন, তাঁরাও সন্তুষ্ট আছেন মহান আল্লাহ্র প্রতি।
(আল বিদায়াহ আন নিহায়া ৪র্থ খন্ড)
আল্লাহ্র নবীর সাহাবায়ে কেরামগণ হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) কে তাঁদের বাল্য অবস্থা থেকেই ভালবাসতেন। তাঁদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁদের প্রতি সাহাবা কেরামগণের ভালবাসাও বাড়তে থাকে। কারণ তাঁরা ছিলেন পূত পবিত্র চরিত্রের অধিকারী। তাঁদের মহত্ব ও চরিত্র মাধুর্য সবারই মনোযোগ আকর্ষণ করত। সর্বোপরি আল্লাহ্র হাবীব রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের খুবই ভালবাসতেন। আর সাহাবায়ে কেরামগণ সব কাজে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই অনুসরণ করতেন।
হযরত ইমাম আল বুখারি হযরত আবু হোরায়রা এর বরাতে বলেন, তিনি বলেছেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে একদিন মদীনার বাজারে ছিলাম। তিনি বাজার থেকে ফিরলেন, আমিও তাঁর সাথে ফিরলাম। তিনি জানতে চাইলেন, ‘‘ছোট শিশুটি কই?’’ তারপর বললেন, ‘‘হাসান বিন আলীকে ডাক।’’ হাসান বিন আলী আসলেন। তাঁর গলায় ছিল একটা হার। আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে হাত বাড়িয়ে দিলেন, হাসানও তাই করলেন। তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‘ইয়া আল্লাহ্! আমি তাকে ভালবাসি, আপনিও মেহেরবানি করে তাঁকে ভালবাসুন, আর ভালবাসুন তাদের যারা তাকে ভালবাসে।’’
এই যেখানে ছিল আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অভিপ্রায়, তাই আমার কাছে হাসানের চাইতে প্রিয় আর কেউ ছিল না।

তাঁর দয়া
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। তাঁর দানশীলতা ছিল প্রশংসাযোগ্য। তিনি কারো অনুরোধ উপেক্ষা করতেন না। দরিদ্রতার ভয়ে দান করা থেকে তিনি বিরত থাকতেন না। এতে অবশ্য আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ তার নানাজান হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দয়ালু মানুষদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর দানশীলতা ছিল বাতাসের প্রবাহের মত।
একবার এক ভিক্ষুক মদীনা শরীফের অলি গলি ঘুরে হযরত হোসাইন (আ.) এর দরজায় এসে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগল-
‘‘আজকের দিনে যে কেউ আপনার কাছে হাত পাতবে
সে কখনো নিরাশ হবে না,
যে আপনার দরোজায় করাঘাত হানবে,
আপনি হচ্ছেন উদার হস্ত, বদান্যতার প্রতীক
আপনার মহান পিতা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে করেছেন লড়াই।’’
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) তখন প্রার্থনারত ছিলেন। ভিক্ষুকের হাঁক ডাক শুনে তিনি তাড়াতাড়ি নামায শেষ করে বাইরে এলেন। দেখলেন সাহায্যপ্রার্থীর চোখেমুখে দরিদ্রতার ছাপ। তিনি তাঁর চাকর কাম্বারকে ডেকে পাঠালেন। কাম্বার বলল, ‘‘হে আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তান! আমি হাযির।’’ তিনি তাঁকে বললেন, ‘‘আমাদের হাতে আর কতটুকু জমা আছে?’’ সে বলল, ‘‘আপনার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিলি করার মত ২০০ দিরহাম মাত্র অবশিষ্ট আছে।’’ তিনি বললেন, ‘‘তা নিয়ে এসো, কারণ এমন একজন এখানে উপস্থিত হয়েছে যার প্রয়োজন আমার পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনের চাইতে বেশি।’’ তিনি সেই অর্থ বেদুইনের হাতে তুলে দিয়ে বললেনঃ-
‘‘এটা রেখো, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই,
আমার অন্তর তোমার জন্য বিগলিত
আমার যদি আরো থাকত, তাই আমি তোমাকে দিয়ে দিতাম।
উন্মুক্ত আকাশ হতে সম্পদের বারিপাত ঝরুক
তোমার মাথার পরে
কিন্তু ভাগ্যের ওপর সন্দেহ আমাদের
অসুখি করে রাখে।’’
বেদুইন তাঁর দান গ্রহণ করে যেতে যেতে বললঃ
‘‘তাঁরা পাক পবিত্র, যেমন পবিত্র তাঁদের সম্পদ, তাঁদের নাম যেখানেই উচ্চারিত হয় সেখানেই নাযিল হয় আল্লাহ্র অবারিত রহমত।
আর আপনি হচ্ছেন সুমহান, উচ্চশির, আপনার রয়েছে আল্লাহ্র কিতাবের জ্ঞান, আয়াতে কি বলা আছে তা আপনি জানেন উত্তমরূপে, আলীর পরিবার ছাড়া কারো অধিকার নেই অহংকারের।’’ (তারিখ ইবনে আসাকির, ৪র্থ খন্ড)
হযরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (আ.) এর দুয়ার হতে কেউ কোনদিন খালি হাতে ফিরে যায়নি। এমনকি কবিদেরও তিনি বিমুখ করতেন না। কবিদের দান করার ব্যাপারে একবার হযরত হাসান (আ.) তাঁকে আপত্তি জানালে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন, ‘‘সেই অর্থই সর্বোত্তম যা একজন মানুষের মর্যাদা রক্ষা করে।’’
(তাহজিবুল কামাল)
একবার মুহাম্মদ বিন বশির আল হাযরামির পুত্র বন্দী হন। তাঁর পিতা এ খবর শুনে বললেন, ‘‘আমি তার জন্য এবং আমার জন্য আল্লাহ্র তরফ হতে পুরস্কার আশা করি। আমি তার বন্দী জীবন চাই না। তার অবর্তমানে আমি বেঁচে থাকতেও চাই না।’’
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) তার আহাজারি শুনে বললেন, ‘‘আল্লাহ্ তোমার ওপর রহম করুন। আমার প্রতি দায়বদ্ধতা হতে আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম। তুমি তোমার ছেলের মুক্তিপণ জোগাড়ে কাজ কর।’’ সে বলল, ‘‘বন্য পশু আমাকে জীবিত খেয়ে ফেলুক, যদি আমি আপনাকে ত্যাগ করে যাই।’’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তোমার ছেলেকে এ সমস্ত কাপড় পৌঁছে দাও, যাতে সে তার ভাইয়ের মুক্তিপণ হিসেবে তা ব্যবহার করতে পারে।’’ এই বলে তিনি তাকে পাঁচ সেট কাপড় দিলেন যার মূল্য ছিল এক হাজার দিনার।’’ (তাহজিবুল কামাল, ৪র্থ খন্ড)

তাঁর ধার্মিকতা
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন একজন সাচ্চা ঈমানদার, অত্যন্ত আল্লাহ্ভীরু ও গভীর ধর্মপরায়ণ। আল্লাহ্ নির্ধারিত সীমারেখা তিনি কখনো লঙ্ঘন করেননি।
তিনি ছিলেন সৎকর্মশীল, সালাত আদায়কারি ও নিয়মিত রোযা পালনকারি। বহুবার হজ্ব পালন করেছেন তিনি। দানশীলতা ও পুণ্যকর্ম সাধনে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। বহুবিধ সমাজকল্যাণমূলক কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।
(উসদুল গাবাহ)
আয-যুবায়ের বিন বক্কর বলেন, ‘‘মুসা’ব আমাকে জানিয়েছেন, হযরত হোসাইন (আ.) পদব্রজে (মদীনা হতে মক্কায়) ২৫ বার হজ্ব করেছেন।’’
আল্লাহ্ রাববুল আলামীনের শাহী দরবারে তাঁর আকুতি ও আহাজারি দেখলে তাঁর উচ্চ ধর্মবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলতেন, ‘‘হে আল্লাহ্! জীবনের প্রতিটি দুঃখ দুর্দশায় আমি আপনার ওপরেই নির্ভর করি। প্রতিটি বিপদেই আমি আপনার ওপর ভরসা করি। আমি যে অবস্থায়ই থাকি না কেন, সর্বাবস্থায়ই আপনি হচ্ছেন নির্ভরতার স্থল, আমার অর্জিত সকল নিয়ামত আপনারই দান এবং আপনিই এই সকল কল্যাণের উৎস।’’
তাঁর প্রার্থনার ভাষার আরও নমুনা, ‘‘হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে সংরক্ষণ করেছেন কিন্তু আমাকে কৃতজ্ঞ পাননি। আমাকে পরীক্ষা করেছেন কিন্তু ধৈর্যশীল পাননি। তবুও আমার অকৃতজ্ঞতার কারণে আপনি আমাকে রিজিক থেকে বঞ্চিত করেননি। আমি অধৈর্য হওয়া সত্ত্বেও আপনি আমার বিপদকে স্থায়ী করেননি। শ্রেষ্ঠতম দয়ালু প্রভুর কাছে থেকে দয়া ও করুণা ছাড়া বিপরীত কিছুই নাযিল হয় না।’’
তাঁর প্রতিটি মুনাজাতেই আল্লাহ্র প্রতি আত্মসমর্পণের পরিচয় পাওয়া যায়। জীবনের সকল ভয় ও আশা তিনি মহামহিম আল্লাহ্র ওপরই সোপর্দ করতেন। কার্যকারণের জন্য আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন শক্তিকে তিনি স্বীকার করতেন না। কারণ আল্লাহ্ই অকল্যাণ বা কল্যাণ করার একমাত্র মালিক, তিনি পরম দাতা, হায়াত ও মউতের তিনিই একমাত্র মালিক। এ পর্যায়ের তাওয়াক্কুল অর্জন করার ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের থাকে না। ইবাদতে একাগ্রতা, আনুগত্যে বিনীত সমর্পণ, আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভের লাগাতার প্রচেষ্টা ছাড়া মানুষ তা অর্জন করতে পারে না। নিয়মিত ইবাদত, সিয়াম পালন, হজ্ব সমাপন, কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহ্র যিকির ছাড়া কেউ আল্লাহ্র এমন নৈকট্য হাসিল করতে পারে না। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন তেমনিই এক বিরল ব্যক্তিত্ব।
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর মত ব্যক্তির পক্ষে এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.) এর সন্তান। ইসলামী ফিকহ্ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল খুবই গভীর। প্রকৃত জ্ঞানই মানুষের মনে আল্লাহ্র ভয় সৃষ্টি করে। জ্ঞানীরাই আল্লাহ্ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখে। তারাই আল্লাহ্র বন্দেগীতে অধিক অগ্রসর। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘‘আল্লাহ্র বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই আল্লাহ্কে বেশি ভয় করে চলে।’’
(সূরা ফাতির ৩৫: ২৮)

তাঁর সাহসিকতা ও সংগ্রাম
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। দৃঢ় মনোবলের অধিকারী। অকুতোভয় সৈনিক। জিহাদের ডাকে প্রয়োজনের মুহূর্তে সাড়া দিতে কখনো পিছপা হতেন না তিনি।
হযরত সাঈদ বিন উমর এর বরাতে বলা হয়েছে : তিনি বলেন, একদা হযরত হাসান (আ.) হযরত হোসাইন (আ.) কে বলেন, ‘‘আমি যদি আপনার মত দৃঢ় মনোবলের অধিকারি হতে পারতাম।’’ আর হযরত হোসাইন (আ.) হযরত হাসান (আ.) কে বলেন, ‘‘আমি যদি আপনার মত চমৎকার ভাষা শৈলীর অধিকারী হতে পারতাম!’’ (সিয়ার আলম আন নুবালা)
তাঁকে একবার মুয়াবিয়া এর নিকট দূত হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনীর সাথে কনস্টান্টিনোপলে (ইস্তাম্বুল অভিযানের) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সে যুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া।
এতে হযরত হোসাইন (আ.) এর মহত্ত্বই প্রকাশ পায়। তাঁর এবং মুয়াবিয়া এর সম্পর্ক যাই থাকুক না কেন, যখনই আল্লাহ্র পথে যুদ্ধের আহবান এসেছে তখনই তিনি তাতে সাড়া দিয়েছেন। শুধু মাত্র আল্লাহ্র ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্যই তিনি তা করেছিলেন।
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ইরাকের কুফায় যেতে মনস্থ করলে আমারাহ তাঁকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। তিনি হযরত আয়েশা সিদ্দিকা এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন, ‘‘তিনি {হযরত আয়েশা } বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি ব্যবিলনের ভূমিতে হোসাইন নিহত হবে।’’ একথা শুনে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন, ‘‘তাহলে আমার পক্ষে মৃত্যু হতে পালিয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই।’’
(তারিখ ইবনে আসাকির)
পবিত্র নগরী যাতে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় সে জন্যই তিনি মক্কা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। হযরত ইবনে যুবায়ের তাঁকে বললেন, ‘‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন? এমন লোকদের কাছে কী আপনি যাচ্ছেন যারা আপনার পিতাকে হত্যা করেছে, ভাইয়ের বিরুদ্ধে দিয়েছে অপবাদ?’’ তিনি জবাবে বললেন, ‘‘পবিত্র মক্কা নগরীতে রক্তপাত হওয়ার চেয়ে আমার মৃত্যু অধিক শ্রেয়।’’
(আল বিদায়া আন নিহায়ায় ইবনে কাসিরের বর্ণনা)
মুয়াবিয়া ইরাকে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁকে হুঁশিয়ার করে দেন। কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) প্রত্যুত্তরে জানালেন, ‘‘আপনার চিঠি আমার হস্তগত হয়েছে। আমার সম্পর্কে আপনার কাছে যে সংবাদ পৌঁছেছে আমি তার যোগ্য নই। আল্লাহ্র মেহেরবানী ছাড়া কেউ কোন সৎকাজ করতে পারে না। আমি যদি আপনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিত্যাগ করি তাহলে আমার আশঙ্কা হয় আল্লাহ্ আমাকে ক্ষমা করবেন না। আর আপনি ক্ষমতা দখল করে যেভাবে এ জাতির ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছেন তার চেয়ে বড় ফেতনা আর হতে পারে না।’’
মুয়াবিয়া বলেন, ‘‘আবু আবদুল্লাহ্ (ইমাম হোসাইন) সম্পর্কে আমরা যা জানি তা হচ্ছে তিনি ছিলেন সিংহের মত সাহসী। যা সত্য বলে তিনি বিশ্বাস করতেন তা অাঁকড়ে ধরতে তিনি কখনো পিছপা হতেন না, যদিও এতে তাঁর মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকত।’’ বস্ত্তত তাঁর জীবনে তাই সত্য হয়েছিল।

বাগ্মীতা
তিনি ছিলেন পরম বাগ্মী ও শিল্পীত মানুষ। তিনি যখন কথা বলতেন তা যেন কথা নয়, যেন তাঁর মুখ থেকে ঝরে পড়ছে মুক্তার দানা। তাঁর বক্তৃতা শ্রোতার মনকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত, তাঁদের হৃদয়কে করে রাখত আচ্ছন্ন। উপস্থিত বক্তৃতার ক্ষমতা ছিল তাঁর অসাধারণ। হযরত ওসমান এর খিলাফত কালে মুয়াবিয়া শাম (সিরিয়া) থেকে হযরত আবু জর গিফারিকে বহিষ্কার করলে তিনি মদীনা শরীফ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিলেন। তখন হযরত হোসাইন (আ.) এক অনির্ধারিত বক্তৃতায় বলেন, ‘‘হে চাচাজান! আপনি যা দেখেছেন আল্লাহ্ অবশ্যই তা পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন এবং প্রত্যেক দিনই আল্লাহ্ নতুন নতুন সৃষ্টি অস্তিত্বে আনয়ন করে থাকেন। লোকজন দুনিয়ার স্বার্থে আপনাকে পরিত্যাগ করেছে আর আপনি তাদের পরিত্যাগ করেছেন দ্বীনের কারণে। অতএব আল্লাহ্ রাববুল আলামীনের দরবারে ধৈর্য ও সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করুন। প্রবৃত্তির তাড়না ও মানসিক উদ্বেগ থেকে তাঁর কাছেই আশ্রয় ভিক্ষা চান। কারণ ধৈর্য দ্বীনেরই অঙ্গ এবং মহৎ গুণ। কেবল ইচ্ছার তাড়নায় মানুষ অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না এবং নির্ধারিত সময় শেষ না হলে উদ্বেগও নিরসন হয় না।’’
তাঁর লিখিত কিছু কবিতার মধ্যে নিম্নোক্তটি অন্যতমঃ-
যদি দুনিয়ার জীবনকে বেশি মূল্যবান মনে করা হয়,
স্মরণ রেখ আল্লাহ্র পুরস্কার তার চেয়েও উচ্চ মর্যাদার ও অতীব চমৎকার
যদি দেহকে তৈরি করা হয়েছে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য তাহলে
তলোয়ারের আঘাতে মৃত্যুই অধিক শ্রেয়।
পৃথিবীর সমস্ত সম্পদকেই যদি মৃত্যুর মাধ্যমে ছেড়ে যেতে হয় তাহলে
সম্পদ বিলিয়ে দিলে ক্ষতিই বা কী?
দু’দিনের এ সম্পদ নিয়ে কেনইবা এত কৃপণতা।

তাঁর আরেকটি কবিতা হচ্ছেঃ-
সৃষ্টির মুখাপেক্ষি হয়ো না
নির্ভার হয়ে নির্ভর করো স্রষ্টার ওপর
সত্যবাদি হোক কিংবা মিথ্যাবাদি, কারো হতে
মিটবে না তোমার কোন প্রয়োজন।
মহান আল্লাহ্র অফুরন্ত ভান্ডার হতে তালাশ করো
তোমার রিজিক।
তিনি ছাড়া রিজিকের মালিক আর কেউ নয়।
যে বিশ্বাস করে মানুষই তার প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা রাখে
বুঝতে হবে পরম দয়াল দাতার প্রতি
তার বিশ্বাস অনিশেষ শূন্য।
তাঁর অন্যান্য কবিতার মধ্যে নিচেরটি অন্যতমঃ
একজন সম্পদশালী যখন আরও সম্পদের অধিকারী হয়ে পড়ে তার উদ্বেগ ক্রমশ বেড়ে যায়, সম্পদ গ্রাস করে ফেলে তার সমগ্র সত্ত্বা।
আমরা তোমাকে চিনি,
হে জীবনে ফেৎনা সৃষ্টিকারি,
হে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের আকর!
অধীনস্থদের বোঝা যার ঘাড়ে চেপে বসে
তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় ত্যাগের মহিমাকে শিরোধার্য করা।
তাঁর এ সমস্ত অনবদ্য কবিতা, মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা ও বিজ্ঞতা ছাড়াও তিনি ছিলেন ইসলামী ফিকহ্ শাস্ত্রের একজন বিশেষজ্ঞ পন্ডিত এবং প্রজ্ঞাবান শিক্ষক। মুয়াবিয়া কুরাইশ বংশীয় একজন লোককে একবার বলেছিলেন, ‘‘মসজিদে নববীতে যখন তুমি একদল লোককে চক্রাকারে নিশ্চল হয়ে বসে থাকতে দেখবে যে মনে হবে তাদের মাথার ওপর পাখি বসে আছে, ধরে নেবে যে, তা হচ্ছে আবু আবদুল্লাহ্র (ইমাম হোসাইন) পাঠ চক্র গোষ্ঠী যার জামা হাতের কব্জির অর্ধেকাংশ পর্যন্ত প্রলম্বিত।’’ (তারিখ ইবনে আসাকির)

যে কথায় তাঁর ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে
সত্যবাদি মানুষের কথাতেই তাঁদের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। নিঃসন্দেহে হযরত হোসাইন (আ.) ছিলেন পরম সত্যবাদি। তাঁর বক্তব্যের মাঝেই একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মর্যাদাবান মানুষের পরিচয় পাওয়া যায়।
তিনি বলতেন, ‘‘হে আল্লাহ্র বান্দাগণ! কল্যাণকর কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা করো, সৎকাজে প্রবৃত্ত হও, বদান্যতার মাধ্যমে প্রশংসা অর্জন করো; এবং স্মরণ রেখো, আল-মারুফের (ইসলামি তাওহীদ ও সৎকর্ম) মধ্যেই নিহিত রয়েছে সুনাম ও সাফল্য।’’
তিনি আরও বলতেন, ‘‘যে দানশীল সে-ই সম্মানিত হবে, যে কৃপণ সে লাঞ্ছিত হবে। আপন প্রয়োজনের অর্থ বিলিয়ে দেয়ার মাঝেই রয়েছে মহত্ত্ব। প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ক্ষমা করে দেয় সে-ই সবচেয়ে উত্তম। আত্মীয়তার বন্ধনকে যে অটুট রাখে সে-ই শ্রেষ্ঠ। যে অন্যকে ইহসান করে আল্লাহ্ তাঁকে ইহসান (অনুগ্রহ) করেন, কারণ আল্লাহ্ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন।’’

কারবালায় তাঁর শাহাদাত
হযরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (আ.) ৬১ হিজরীর ১০ই মুহার্রম পবিত্র আশুরার দিনে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর শাহাদাত সম্পর্কে প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যতবাণী করে গিয়েছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ্ বিন সাঈদ তাঁর পিতার বরাত দিয়ে বলেন, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা অথবা হযরত উম্মে সালমা বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ্র হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছেন, ‘‘আজ আমার কাছে একজন ফেরেশতা এসেছিলেন যাঁকে আমি ইতোপূর্বে আর দেখিনি।’’ তিনি বললেন, ‘‘অবশ্যই হোসাইন মৃত্যুবরণ করবে, আপনি চাইলে আমি ধুলার মাঝে তার রক্তের দাগ আপনাকে দেখাতে পারি।’’ (এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদকের মতে হাদিসটি দুর্বল)
আশ শাবি বর্ণনা করেন, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর মদীনায় এসে জানতে পারলেন যে, হযরত হোসাইন (আ.) ইরাক অভিমুখে রওনা দিয়েছেন তখন তিনি তাঁর খোঁজে দ্রুত রওয়ানা হলেন। মদীনা শরীফ থেকে দু’দিনের রাস্তায় তিনি তাঁর সাথে মিলিত হলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’’ তিনি জবাব দিলেন, ‘ইরাক।’ তাঁর সাথে বিভিন্ন বই ও কাগজপত্র ছিল। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর বললেন, ‘‘তাদের কাছে যাবেন না।’’ তিনি জবাব দিলেন, ‘‘এ সমস্ত কিতাব ও চিঠিপত্রে তাদের আনুগত্যের বিবরণ আছে।’’ তিনি তখন বললেন, ‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’য়ালা তাঁর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ দুনিয়া এবং আখিরাতের মধ্যে একটাকে বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিয়েছিলেন। তিনি আখিরাতের জীবনকে বেছে নিয়েছেন। আপনি তাঁরই বংশধর। আপনাদের কেউ এতে সফল হবেন না। (তিনি খিলাফতের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন) আল্লাহ্ এর দায়িত্ব আপনাদের কাছে থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বৃহত্তর কল্যাণের দিকেই আপনাদের ধাবিত করেছেন। সুতরাং ফিরে চলুন।’’ কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) তাতে অস্বীকৃতি জানালেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর এরপর তাঁর সাথে কোলাকুলি করলেন আর তাঁকে আল্লাহ্র সুরক্ষার মাঝে সোপর্দ করলেন। বললেন, ‘‘আল্লাহ্ আপনাকে মৃত্যু থেকে হিফাজত করুন।’’ (তারিখ ইবনে আসাকির)
কুফার লোকজন তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। তারা এ বিষয়ে তাঁকে চিঠি লিখে নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু তারা নিজেদের শপথ ভঙ্গ করে তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তিনি কারবালায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁর সাথে ৫০ জনের মত দেহরক্ষি ছিলেন। তাঁরা তাঁর শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রাণপণ লড়াই করে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, সংকল্পে অনমনীয়তা, সাহস, সত্যের প্রতি অবিচল আস্থা ও মিথ্যার মোকাবিলায় পিছপা না হওয়ার জীবন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। শাহাদাত বরণের আগমুহূর্ত পর্যন্ত অসীম সাহসী ইমাম সোহাইন (আ.) শত্রুবাহিনীর ৮০ জনকে হত্যা করেছিলেন। সে দিন কারবালা ময়দানে তিনি এবং নবী বংশের নারী শিশু-কিশোরসহ ৭২জন শহীদ হয়েছিলেন তাঁর একমাত্র জীবিত অসুস্থ সন্তান ইমাম জয়নুল আবেদীনসহ শিশুও মহিলাগণ ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে বন্দী হন।
চতুর্দিক হতে আক্রমণ চলল। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)ও তরবারি চালাতে আরম্ভ করলেন। তিনি তরবারি নিয়ে পদাতিক বাহিনীর দিকে ধাবমান হলেন। একাই তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। আব্দুল্লাহ্ ইব্নে আম্মার এই যুদ্ধে শরীক ছিল। তার বর্ণনা এরূপঃ
‘‘আমি বর্শা দ্বারা হযরত হোসাইনকে আক্রমণ করেছিলাম। একেবারে তাঁর সন্নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমি ইচ্ছে করলে তখনই তাঁকে হত্যা করতে পারতাম, কিন্তু এত বড় পাপ মাথায় কিরূপে নেব, তা ভেবে পশ্চাৎপদ হলাম। ডান বাম সবদিক দিয়েই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি যেদিকে ফিরতেন, সেদিকেই ইয়াজিদ বাহিনীকে ভেড়ার পালের ন্যায় বিতাড়িত করে নিয়ে যেতেন। দেহে লম্বা জুববা, মাথায় পাগড়ী বাঁধা অবস্থায় অলৌকিক শক্তি বলে তিনি শেষ পর্যন্ত একাই লড়ে যাচ্ছিলেন। আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলছি এরূপ ভগ্নহৃদয় ব্যক্তি, যার পরিবারের সকলেই একের পর এক তাঁর চোখের সামনে শত্রুর হাতে নিহত হয়েছেন, সেই মানুষের মধ্যে এরূপ বীরত্ব, সাহস ও দৃঢ়চিত্ততা এবং স্থিরতা আমি জীবনে আর কখনও করো কাছে দেখি নাই। তিনি ডানে বামে যেদিকেই ফিরতেন, সেই দিকেই শত্রুদল ব্যাঘ্র তাড়িত ভীরু মেষপালের ন্যায় ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করত। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এ অবস্থা চলল। এই সময় তাঁর বোন হযরত যয়নব বিনতে আলী (আ.) একবার তাঁবুর বাইরে এসেছিলেন। তার কানে ধূলো বালি দুলছিল। তিনি চিৎকার করে রোদন করছিলেন, ‘আকাশ কেন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে না……।’
এ সময় উমর ইব্নে সাআ’দ হযরত হোসাইন (আ.)-এর একেবারে নিকটবর্তী হয়ে পড়েছিলেন। হযরত যয়নব চিৎকার করে বললেন, ‘হে উমর! আবু আব্দুল্লাহ্ (হোসাইন রা.) কী তোমার চোখের সামনেই কতল হয়ে যাবে? উমর তখন যয়নবের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তার চেহারা এবং দাড়ি বয়ে অশ্রু ঝরছিল।
যুদ্ধের ময়দানে হযরত হোসাইন (আ.) পিপাসায় খুব কাতর হয়ে পড়েছিলেন। তিনি পানির জন্য ফোরাতের দিকে চললেন কিন্তু শত্রুরা বাধা দিল। ঠিক সে সময় হঠাৎ একটি তীর এসে তাঁর কণ্ঠনালীতে বিদ্ধ হল। তিনি নিজ হাতে তীরটি টেনে বের করে হাত মুখের দিকে উত্তোলন করলেন, হাতের অঞ্জলি রক্তে ভরে গেল। তিনি সে লহু-সিঞ্চিত অঞ্জলি আসমানের দিকে তুলে শোকর-গোযারী করতে করতে বললেন, ‘হে আল্লাহ্! আমার ফরিয়াদ কেবল তোমারই দরবারে। দেখ তোমার রাসূলের বংশধরদের প্রতি কি ব্যবহার চলছে!’
তিনি শিবিরের দিকে ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু শিমারের সাথীরা তাতেও বাধা দিল। তিনি বুঝলেন, তাদের উদ্দেশ্য ভাল নয়, তারা তাঁবু লুট করার মতলব অাঁটছে। তা অনুভব করে তিনি শিমারকে বললেন, ‘‘তোমাদের যদি দ্বীন-ধর্ম না থাকে, পরকালের ভয় না থাকে, তবে অন্তত পার্থিব ভদ্রতা বিসর্জন দিও না। অসভ্য এবং বর্বরদের হাত হতে আমার (পরিবারবর্গের) তাঁবু রক্ষা করিও।’
শিমার বলল, ‘তাই হবে, আপনার তাঁবুর উপর কোনরূপ আক্রমণ করা হবে না।’
‘‘দীর্ঘ সময় এভাবে চলে গেল। শত্রুরা ইচ্ছে করলে বহু পূর্বেই তাঁকে হত্যা করে ফেলতে পারত। কিন্তু কেউই এই মহাপাপের বোঝা নিজ মাথায় নেয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল না। অবশেষে শিমার সৈন্যদেরকে ধমক দিয়ে বলল, ‘তোমাদের সর্বনাশ হউক! তোমরা এখনও দেরী করছ কেন? দ্রুত কাজ সমাপ্ত কর।’
‘‘আবার চতুর্দিক হতে আক্রমণ শুরু হল। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) বললেন, ‘তোমরা আমাকে হত্যা করার জন্য একে অপরকে উত্তেজিত করছ কেন? আল্লাহ্র কসম! আমাকে হত্যা করলে আল্লাহ্ যত না-খোশ হবেন, আর কাউকে হত্যা করলে তিনি সে পরিমাণ না-খোশ হবেন না।’’
কিন্তু অন্তিম সময় উপস্থিত হল। যোরআ ইব্নে শরীফ তামামী ইমাম হোসাইনের বাম হাত জখম করে ফেলল এবং পুনরায় বাহুর উপর তরবারি দ্বারা আঘাত করল। তিনি অবসন্ন দেহে মাটিতে ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন। তা দেখে শত্রুগণ ভীত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।’’
পাষন্ড সানান ইব্নে আনাস নখ্ফী অগ্রসর হয়ে ইমামের দেহে বর্শা দ্বারা আঘাত করতেই তিনি ভূতলে পড়ে গেলেন। সানান আর একজনকে মস্তক ছেদন করতে বলল। সে লাফিয়ে মস্তক ছেদনে অগ্রসর হল কিন্তু তার সাহস হল না, পিছিয়ে গেল। সানান দাঁত কড়মড় করে বলল, তোর হাত অবশ হউক। এই বলে নিজেই ভূতলে ধরাশায়ী ইমাম হোসাইনের দেহের ওপর লাফিয়ে পড়ল। প্রথমে হযরত হোসাইনকে যবেহ করল, তারপর তাঁর পবিত্র দেহ হতে মস্তক দ্বি-খন্ডিত করে ফেলল। ‘‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।’’
জা’ফর ইব্নে মুহাম্মদ ইব্নে আলী (রাহ.) বলেছেন, ‘‘নিহত হওয়ার পরে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দেহে ৩৩টি বর্শার আঘাত এবং ৩৪টি তরবারির আঘাত দেখা গিয়েছিল।’’
শোকগাথা
নবী দৌহিত্র শহীদ ইমাম হোসাইন (আ.) এর পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে অনেক শোকগাথা রচিত হয়েছে। এতে সকল স্তরের মুসলমানদের তরফ হতে তাঁর প্রতি গভীর ভালবাসা ও স্নেহ মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এটা খুবই যথার্থ। কারণ এটা সুস্পষ্ট যে তাঁর প্রতি চরম জুলুম করা হয়েছে। আর মানুষ কখনো অন্যায়কে সমর্থন করে না। অধিকন্তু তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বংশধরদের একজন। কারবালা প্রান্তরে হৃদয়বিদারক এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক কবিতা ও শোকগাথা রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বংশধরদের মধ্যে আর যাঁরা কারবালা প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে হযরত ইমাম শাফেয়ী (আ.) এর রচিত কবিতাও রয়েছে। সে সবের কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলঃ-
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পরিবার পরিজনের জন্য
বার বার কেঁপে ওঠছে সারা পৃথিবীর হৃদপিন্ড
পর্বতের সুউচ্চ চূড়াও তাদের জন্য হয়ে গেছে মিসমার।
তিনি শহীদ হয়েছেন, অথচ ছিল না তাঁর কোন অপরাধ।
উরজুয়ানের জলে যেন ডুবানো হয়েছে তাঁর জামা
আর এতেই তা হয়ে পড়েছে রক্তরঙিন।
হাশেমী বংশের মনোনীত উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রতি
আমরা অহরহ পাঠ করি দরূদ
আর তাঁরই আত্মজ’র সাথে আমরা করি লড়াই
এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে!
নবীর পরিজনদের প্রতি ভালবাসা যদি কোন পাপ হয়ে থাকে তাহলে এ
পাপের জন্য আমার মোটেও কোন আক্ষেপ নেই।

হযরত আবদুল মুত্তালিবের বংশীয় এক রমনীর রচিত শোকগাথাঃ-
কী জবাব দেবে তুমি
যদি জিজ্ঞেস করেন আল্লাহ্র নবী-
কী ছিল তোমাদের ভূমিকা, হে আমার উত্তরসূরি,
কেমনতরো আচরণ করেছিলে তোমরা আমার বংশধরদের প্রতি
আমার বিদায়ের পর?
যারা বন্দী হয়েছিল, যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল,
রক্তের সমুদ্রে যাদেরকে
ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল,
তাদের প্রতি কেমন ছিল তোমাদের ব্যবহার?
তোমাদের প্রতি আমার নির্দেশতো
কখনো এমন ছিল না যে, তোমরা আমার
বংশধরদের সাথে খেলবে শত্রু শত্রু খেলা?

আর তাঁর স্ত্রী রাবাব যে কবিতায় তাঁর হৃদয়ের শোক প্রকাশ করেছিলেন তা এইঃ
কে আর এতিমদের সাহায্য করবে,
কে আর মিটাবে তাদের প্রয়োজন?
কে দেবে আশ্রয় নিপীড়িত জনে?
আল্লাহ্র কসম, তাঁর শূন্যস্থানে আমি
মাটি ও কাদায় মিশে না যাওয়া পর্যন্ত
আর কোন পুরুষকে স্বামী রূপে চাই না।
এভাবে আল্লাহ্র হাবীব হযরত রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় নাতি, তাঁর ‘রায়হান’ বেহেশতে যুবকদের সরদার হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর আপন সহোদর হযরত ইমাম হাসান (আ.) এর অনুগামী হয়ে শাহাদাত বরণ করেন।
তিনি আদর্শের জন্যই শহীদ হন, যে আদর্শকে তিনি সত্য হিসেবেই মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন; তিনি বীরের মৃত্যুই বরণ করেছেন। অবশ্যই তিনি আপন আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে পার্থিব জীবনের সুখ শান্তি ক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে আদর্শিক ও গৌরবময় মৃত্যুকে জিল্লতির জীবনের তুলনায় শ্রেয় বলে গণ্য করেছেন। যে মৃত্যুকে কোন প্রাণীই এড়াতে পারে না।
একথা আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, তাঁর নিষ্পাপ চেহারার সাথে হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা মোবারকের সাদৃশ্য ছিল। পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধের জন্য যারাই আত্মত্যাগে ব্রতী হবেন তাদের সবার জন্যই হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) একজন অতি উত্তম আদর্শ।
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর দৈহিক মৃত্যু হয়েছে সত্য কিন্তু তিনি আধ্যাত্মিকভাবে মুমিন মুসলমানের অন্তরে চিরজীবি হয়ে রয়েছেন। যেভাবে তিনি আল্লাহ্র সান্নিধ্যে জীবিত আছেন। কারণ তিনি শহীদ আর ‘‘শহীদদের কোন মৃত্যু নেই। বরং তারা জীবিত ও মহাপ্রভুর কাছ থেকে তারা নিয়মিত রিজিক প্রাপ্ত হন।’’
(আল-কুরআন)

তাঁর চরিত্র
প্রজ্ঞাবান ও অনুপম চরিত্রের অধিকারী ইমাম হোসাইন (আ.) এর ব্যক্তিত্ব কারো সাথে তুলনা করা যায় না। ইয়াযিদ যখন তার পিতার অবৈধ অসিয়তনামার বদৌলতে মুসলিম উম্মাহ্র ঘাড়ে চেপে বসে তখন তার এমন কোন গুণ ছিলনা যে মানুষ তাকে সানন্দে আমীরুল মুমিনিন হিসেবে মেনে নেবে। যেখানে (সমকালীন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহাবী) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়ের, আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর, আবদুল্লাহ্ ইবনে আববাস প্রমুখ উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ কেউই তার হাতে বায়াত হননি। প্রকৃত পক্ষে হযরত হাসান (আ.) ও আমীর মুয়াবিয়া -এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ইমাম হোসাইন (আ.)-ই খেলাফতের একমাত্র হকদার। এ অবস্থায় কীভাবে হযরত হোসাইন (আ.) তার অবৈধ অগণতান্ত্রিক শাসন মেনে নেবেন?
ঐতিহাসিক সৈয়দ আমীর আলী তাঁর অ ঝযড়ৎঃ ঐরংঃড়ৎু ড়ভঃযব ঝধৎধপবহং (চ-৮৩)- এ বলেন : ইয়াযিদ ছিল যেমন নিষ্ঠুর তেমনি বিশ্বাসঘাতক; তার কলুষিত মনে দয়ামায়া বা সুবিচারের কোন স্থান ছিল না। তার আমোদ প্রমোদ ছিল যেমন নীচুস্তরের; তার সঙ্গী-সাথীরাও ছিল তেমনই নিচাশয় ও দুশ্চরিত্র। একটি বানরকে মাওলানার পোশাক পরিয়ে সে ধর্মীয় নেতাদের বিদ্রুপ করত এবং যেখানে যেত সেখানে জন্তুটিকে নিয়ে যেত কারুকার্যময় বস্ত্রে সজ্জিত একটি সিরিয় গাধার পিঠে বসিয়ে। তার দরবারে মদ্যপান জনিত হাঙ্গামা হত এবং তা প্রতিফলিত হতো রাজধানী দামেস্কের রাস্তায়।
ইয়াযিদ যখন অনৈতিকভাবে রাজসিংহাসনে আরোহণ করে তখন তার বয়স মাত্র সাঁইত্রিশ বছর। আর ইমাম হোসাইন (আ.) জ্ঞানে গুণে বিভূষিত ছাপ্পান্ন বছরের এক পরিপূর্ণ কামিল ইনসান। বংশানুক্রমিকভাবে নানা, বাবা ও মায়ের পূত-পবিত্র স্বভাব ও গুণাবলী; সর্বোপরি পিতার বীরত্ব তাঁর মাঝে বিরাজমান ছিল।

ইংরেজ ঐতিহাসিক প্রফেসর সিডিলট ইমাম হোসাইনের (আ.) সহজ-সরল জীবনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘‘তাঁর মধ্যে একটি গুণেরই অভাব ছিল, তা হল ষড়যন্ত্রের মানসিকতা; যা ছিল উমাইয়া বংশীয়দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।’’ (প্রাগুক্ত- পৃ: ৮৪)
শাহাদাত লাভের জন্য এমন উদ্গ্রীব মানুষ এ পৃথিবীতে খুব কমই পরিদৃষ্ট হয়েছে। তিনি বলতেন, ‘‘শরীরের জন্য যদি মৃত্যুই অনির্বায, তবে আল্লাহ্র পথে শহীদ হওয়াই মানুষের জন্য উত্তম?’’ জিহাদের জন্য নিজের ধন-সম্পদ পুত্র-পরিজন ও নিজের জীবনকে দৃঢ় চিত্তে, স্থির মস্তিষ্কে উৎসর্গ করার মাধ্যমে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। জীবন উৎসর্গের এমন এক বিরল দৃষ্টান্ত এ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের’ খোদায়ী আহবানে সাড়া দানের এ অশ্রুতপূর্ব নজীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ইমাম হোসাইনের চারিত্রিক মাধুর্যের ম্যাগনেটিক পাওয়ার (আকর্ষণ শক্তি) এতই প্রবল ছিল যে, পরম শত্রুও তাঁর মিত্রে পরিণত হয়েছিল। ইয়াযিদ বাহিনীর একাংশের কমান্ডার হোর ইবনে ইয়াযিদ (যিনি শুরু থেকে ফোরাত নদীর তীর অবরোধ করে রেখেছিলেন) নিজের জীবন বিপন্ন করে হোসাইন (আ.) এর পদতলে নিজেকে সমর্পণ করেন। শুধু কি একা! না, ৩০জন ইয়াযিদী সৈন্যসহ। আহলে বাইতের ইজ্জত-আব্রু রক্ষার্থে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে এ জিন্দাদিল মুজাহিদগণ একে একে নিজেদেরকে কারবালা প্রান্তরে কুরবান করে দিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা।
বন্ধু, আত্মীয়-পরিজন, ভাইয়ের সন্তান, নিজের সন্তানদের একের পর এক মৃত্যু (শাহাদাত) প্রত্যক্ষ করেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ক্ষণিকের জন্য বিব্রত বা বিচলিত হননি। নিশ্চিত মরণ জেনেও তাঁর পদযুগল একটুও টলেনি। একবারের জন্যও শত্রুকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেননি। পর্বতসম দৃঢ়তা নিয়ে প্রগাঢ় আস্থার সাথে একাকী শতসহস্র ইয়াযিদী সৈন্যের বিরুদ্ধে সিংহের মত লাড়াই করে হাসিমুখে শহীদ হলেন। কিন্তু আল্লাহ্ ও রাসূল বিরোধী অগণতান্ত্রিক, অবৈধ, স্বৈরশাসকের সাথে হাত মেলাননি। এ অসম, একতরফা চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে নিজের পরিণতি কি হতে পারে তা পূর্বাহ্নে স্থির নিশ্চিত জেনেই এ আপসহীন সিপাহসালার শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘‘নির্যাতনকারীর আনুগত্য জঘন্যতম অপরাধ। আমি মৃত্যুকে সৌভাগ্য মনে করি। কিন্তু জালিমের সাথে জীবন যাপনকে অন্যায় ছাড়া কিছুই মনে করি না।’’
কারবালায় কী হোসাইনের মৃত্যু হয়েছে? না-প্রকৃত মৃত্যু সাধিত হয়েছে ইয়াযিদের। পাপিষ্ঠ ইয়াযিদ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, পক্ষান্তরে হোসাইন কিয়ামত পর্যন্ত মুমিন হৃদয়ে চিরঞ্জীব থাকবেন। হোসাইনের পবিত্র খুন কিয়ামত পর্যন্ত সকল মজলুম মুসলমানের হৃদয়ে বিপ্লবের অগ্নিশিখা রূপে প্রজ্জ্বলিত হবে। দেশে দেশে কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী রাজা-বাদ্শাহ্, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকদের পতন ঘটাবে।
স্বর্গের সর্দার (বেহেস্তে যুবকদের নেতা) ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.) এর সাথে মিলিত হবার ও তাঁদের নেতৃত্বে অনন্তকাল বেহেশতে বসবাসের এই তো উত্তম সোপান। ইমাম হোসাইন (আ.) এর পূত-পবিত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জনের মধ্যেই মুসলিম উম্মাহ্র জীবনের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত। রাসূলে পাক (সা.) এর সুপ্রসিদ্ধ হাদীস-
‘‘হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে। যে হোসাইনকে ভালবাসে আল্লাহ্ তাকে ভালবাসেন। সে আমার দৌহিত্রের একজন। যে আমাকে ভালবাসে সে যেন হোসাইনকে ভালবাসে।’’
আল্লাহ্র জমিনে আল্লাহ্র দ্বীন কায়েমের লক্ষ্যে আমাদের সবার উচিত ইমাম হোসাইন (আ.) এর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা প্রদর্শন ও তাঁর আদর্শ অনুসরণ। মহান আল্লাহ্ আহলে বাইতদের শাহাদাত কবুল করুন, তাঁদের মর্যাদা চিরকাল সমুন্নত রাখুন। আমীন।

তাঁর বাণী
কোন মানুষের চরিত্র তার কথা, কাজ ও জীবনাচরণ থেকেই যাচাই করা যায়। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি। তাঁর কিছু কথা এখানে উদ্ধৃত করা হলো। এ সব কথা তারিখে কবির, আল হোসাইন, কাশফুল গুমতাহ, ইবনে আসাকির, তারিখুল মুল্ক, ইবনে জারির, তাবারি, রিয়াজুল জান্নাহ্ এবং ইসরারুল হুকামা প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে উৎকলিত হয়েছে। তিনি বলেছেন-
১। আল্লাহ্র নিকট এমন এক রেজিস্ট্রার রয়েছে, যাতে ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল গুনাহ্ই লিপিবদ্ধ থাকে।
২। (আমীর মুয়াবিয়া রা. কে উদ্দেশ্য করে) নিজের ছেলের জন্যে আপনার এই বাইয়াত এবং সে জন্যে লোকদেরকে পাকড়াও কোনক্রমেই উপেক্ষিত হতে পারে না।
৩। আল্লাহ্র আনুগত্যের প্রতি সদা-সর্বদা সন্তুষ্ট থাকাই উত্তম।
৪। ধৈর্য ও সহনশীলতা মানব চরিত্রকে সুসজ্জিত করে।
৫। লোভ এবং অধিক প্রাপ্তির আশা শুধুমাত্র খারাপই নয় বরং তা মানুষকে ধ্বংস করে।
৬। বদান্যতা এবং নেককাজ আজমত ও বুজুর্গীর উৎকৃষ্টতম মাধ্যম।
৭। ভালো কাজ নিজেই ব্যক্তিকে প্রশংসার যোগ্য করে তোলে।
৮। আল্লাহ্ পাক দুনিয়াকে পরীক্ষার জন্যে তৈরি করেছেন।
৯। আল্লাহ্র কিতাবের উপর আমল, আদল, ইনসাফ, দিয়ানত এবং আল্লাহ্র উপর ভরসা না করা পর্যন্ত কেউই প্রকৃত ঈমানদার হতে পারে না।
১০। সবচেয়ে খারাপ শাসক সেই ব্যক্তি, যে নিজের বিরোধীদের সামনে নতশির ও হিম্মতহীন কিন্তু দুর্বলদের সামনে বাহাদুরীর পারাকাষ্ঠা দেখায়।
১১। যে সম্পদের মাধ্যমে ইজ্জত-আবরু সংরক্ষিত থাকে সেই সম্পদই উত্তম সম্পদ।
১২। কাল যদি তোমার মাথাও উড়িয়ে দেয় তবুও সৃষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হবেনা।
১৩। জিল্লতি বরদাশ্ত করার চেয়ে মৃত্যুই উত্তম।
১৪। শরীরের জন্যে মৃত্যু অনিবার্য হলেও আল্লাহ্র পথে শহীদ হওয়াই মানুষের জন্যে উত্তম।
১৫। যে ব্যক্তি নিজের মতকে কিয়াসের পাল্লায় মেপে থাকে, সে সন্দেহ সংশয়ে গ্রেফতার হয়।

উপসংহার
মুমিনদের জন্য তিনি এক অনুকরণীয় আদর্শ। ধর্ম ও আদর্শ রক্ষার জন্য তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। ধৈর্য ও ত্যাগের তিনি মূর্ত প্রতীক। প্রচলিত প্রবাদ আছে যে, ‘‘মৃত্যুকে তালাশ করো, তাহলে জীবনকে খুঁজে পাবে।’’ (তিনি এ প্রবাদের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি)
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন অতি দয়ালু ও মহান দানবীর। মানুষের কোন অনুরোধই তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। এমনভাবে দান করতেন তিনি যাতে বুঝা যেত দারিদ্র্যকে মোটেই তাঁর পরোয়া নেই। তাঁর দুয়ারে যে-ই হাত পাততো সে কখনো বিমুখ হয়ে ফিরে যেত না।
তিনি ছিলেন পাক্কা ঈমানদার, অতি মজবুত ছিল তাঁর ধর্মবিশ্বাস। প্রচন্ড আল্লাহ্ভীরু, গভীর ধর্মপরায়ণ। আল্লাহ্র নিষেধের সীমানা অতিক্রমের ভয়ে সর্বদা কম্পমান থাকতো তাঁর দীল।
তিনি ছিলেন একাধারে পুণ্যশীল, রোযাদার, ইবাদতগুজার। জীবনে বহুবার হজ্ব পালন করেছেন তিনি। তাঁর বদান্যতা সুবিদিত, তাঁর জীবন ছিল সৎকর্মে ভরপুর।
তিনি ছিলেন সাহসী, দৃঢ়চেতা, অকুতোভয় সৈনিক, সময়ের প্রয়োজনে জানবাজ যোদ্ধা।
তিনি ছিলেন মধুরভাষী, শিল্পিত চেতনার মানুষ। তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত শব্দমালা শ্রোতাদের মোহমুগ্ধ করে রাখত। উপস্থিত বক্তৃতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
তাঁর কাব্য প্রতিভা, বক্তৃতা দানের ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার কথা বাদ দিলেও তিনি ছিলেন একজন উঁচু স্তরের জ্ঞানী, ইসলামী ব্যবহার (ফিকহ্) শাস্ত্রে তাঁর জ্ঞান ছিল কিংবদন্তীতুল্য। তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ শিক্ষকও।
তিনি এক মহান আদর্শের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, যে আদর্শের প্রতি তাঁর ছিল অবিচল নিষ্ঠা। তিনি সত্যিকারের বীরের মৃত্যুই বরণ করেছিলেন।

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন