রাসুলে আকরম (সা.) ও ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদত বার্ষিকী

রাসুলে আকরম (সা.) ও ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদত বার্ষিকী
২৮শে সফর মাস বিভিন্ন রেওয়ায়েতের বর্ণনা মতে শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও ইমাম হাসান (আ.) এর শাহাদত বার্ষিকী। যা মুসলমানদের জন্য বিশেষ শোক বার্তা বয়ে আনে।
আল্লাহ'র রাসুল (সা.) এর শাহাদত
হিজরতের পর প্রায় ১১ বছর মুসলমানদের সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ (সা.) মদীনা শহরে অবস্থান ও জীবন যাপন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। অতঃপর ২৮শে সফর ১১ই হিজরি সনে ৬৩ বছর বয়সে বিষ খাওয়ার কারণে শাহাদত বরণ করেন।(১)অবশ্য কিছু কিছু রেওয়ায়েতের বর্ণনা মতে নবী করিমের কাছের লোক তাঁকে বিষ খাইয়েছিল।(২)
বিহারুল আনওয়ারের বর্ণনা মতে নবী করিম (সা.) যে অসুস্থতার কারণে শাহাদত বরণ করেছেন তা ১৫ই সফর থেকে শুরু হয়েছিল।(৩) ২৪শে সফর নবী করিমের (সা.) অসুস্থতা খুব চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।(৪)সেই অসুস্থ অবস্থায় নবী করিম (সা.) বললেন: আমার হাবিবকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)'কে ডেকে হাজির করা হলে হুজুর পাক (সা.) তাঁকে আরো কাছে আসতে বলেন। অতঃপর কিছু কথা তাঁকে বলেন। ইমাম আলী (আ.) যখন হুজুর পাকের (সা.) কাছ থেকে বেড় হয়ে এলেন হযরত ওমর ও হযরত আবু বকর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: "তোমার খলিল বা বন্ধু তোমাকে কি বললেন" ? ইমাম (আ.) বললেন: "নবী করিম (সা.) আমার জন্য জ্ঞানের হাজার দরজা খুলে ধরলেন এবং যার প্রত্যেকটি দরজা হতে আরো হাজার হাজার দরজা খোলা যায়"।(৫)

নবী করিমের (সা.) ওসিয়ত
নবী করিম (সা.) তাঁর জীবনের শেষ সময়ে আমিরুল মুমেনিন হযরত আলীকে (আ.) কিছু বিষয়ে ওসিয়ত করে যান এবং হযরত জিবরাইল, মিকাইল ও মালাইকাতুল মুকার্রাবিনকে তাতে সাক্ষী করলেন। হযরত জিরাইল (আ.) যে কথাগুলো নবী করিমকে (সা.) বলছিলেন এবং হযরত আলীও (আ.) তা শুনছিলেন তা ছিল এই যে, "তোমার খুমসকে গসব করে নেয়া হবে এবং তোমার সম্মানহানি করা হবে অবশেষে তোমার দাড়ি তোমার মাথার রক্তে রঞ্জিত হবে"।
আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ.) বলেন: "আমি যখন সেই কথাগুলো বুঝতে পারলাম চিৎকার দিয়ে উঠলাম এবং মাটিতে পড়ে গেলাম"। অতঃপর হযরত যাহরা (সা.) ও হাসানাইন (আ.)'কে কিছু উপদেশ দিলেন। রাসুলের (সা.) রেহলতের সময় হযরত যাহরা (সা.) অনেক কান্না করেন। নবী করিম (সা.) তাঁকে নিজের কাছে ডাকলেন এবং কিছু বললেন যাতে হযরত ফাতেমা যাহরার (সা.) দুঃখ কিছুটা লাঘব হল। যখন তাঁর কাছে এর বারণ জিজ্ঞেস করা হল তিনি বললেন: "আমার বাবা আমাকে একটি খবর শোনালে যে, তাঁর আহলে বাইত হতে প্রথম যে ব্যক্তি সাঁর সাথে গিয়ে মিলিত হবে সে হচ্ছে আমি আর এ দূরত্ব বেশি দিনের নয়"। তারপর সেই ওসিয়তসমূহকে কিছু সোনা যাকে কখনো আগুন ধরানো হয়নি (মানবের সৃষ্টিকৃত ছিল না) তা দিয়ে মোহর করা হল এবং হযরত আমিরুল মুমেনিনের (আ.) হাতে তুলে দেয়া হল।(৬)

নবী করিমের (সা.) জানাযা'র গোসল ও নামায
আমিরুল মুমেনিন আলী (আ.) হুজুর পাককে গোসল দেয়ার পর নিজেই একা একা তাঁর জানাযাতে নামায পড়লেন।(৭)
কিছু লোক যেহেতু সাক্বিফায়ে বনী সায়েদাতে বসে মিটিং করছিলেন, তাই তাদেরকে বাদ দিয়ে সকল মুসলমানরা মসজিদে দিয়ে হাজির হল এবং নবী করিমের (সা.) জানাযাতে নামায পড়ার ও তাঁকে দাফন করার চিন্তায় ছিল। ইমাম আমিরুল মুমেনিন আলী (আ.) আসলেন এবং বললেন: "আল্লাহ'র রাসুল (সা.) হচ্ছেন তাঁর জীবন কালে এবং মৃত্যুর পর আমাদের ইমাম"। এ সময় দলে দলে লোক মসজিদে প্রবেশ করছিল এবং এ আয়াতটি তিনবার করে পড়ছিল: "ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইয়ুসাল্লুনা আলান নাবী ইয়া আইয়ুহাল্লাযিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা",(৮) আর মসজিদ থেকে বেড় হয়ে আসছিল।

নবী করিমের (সা.) জানাযার দাফন
আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ.) বলেন: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবী করিমের (সা.) রূহ ও আত্মাকে যে স্থানেই রহমত স্বরূপ দাফন করা হোকনা কেন রাজি আছেন। আর তাই আমি তাঁর জানাযা মোবারককে যে হুজরাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন দাফন করছি।
আমিরুল মুমেনিন অন্যান্যদের সহযোগিতায় কবর খুঁড়লেন এবং হুজুর পাকের জানাযাকে কবরের ভিতর সসম্মানে নামালেন। অতঃপর তিনি কবরে নামলেন এবং নবী পাকের (সা.) চেহারা মোবারককে খুলে দিলেন এবং ডান গাল মাটিতে রাখলেন তারপর মাটি দিয়ে কবর বন্ধ করে দিলেন।(৯)

ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) এর শাহাদত
ঠিক একই দিনে অর্থাত ২৮শে সফর ৫০ হিজরি সনে ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) শাহাদত বরণ করেন।(১০) অবশ্য কারো দৃষ্টিতে তাঁর শাহাদত ৭ই সফর আবার কারো মতে তিনি ৫ই রবিউল আউয়াল মাসে শাহাদত বরণ করেছেন।(১১)
আশআস ইবনে কাইসের কন্যা জুদা মুয়াবিয়া কতৃক পাঠানো বিষ খাওয়ানোর মাধ্যমে ইমামকে বিষ ক্রিয়ায় আক্রান্ত করেছে। মুয়াবিয়া বিষের সাথে এক লক্ষ দেরহামও উপঢৌকন স্বরূপ পাঠালো এবং তার ছেলে ইয়াযিদের সাথে বিবাহ করানোর ওয়াদা করলো; কিন্তু শেষে সে নিজের ওয়াদা পালন করেনা।(১২)

বিষ ক্রিয়ায় আক্রান্ত ইমাম হাসান (আ.)
ইমাম হাসান (আ.) চল্লিশ দিন বিষ ক্রিয়াতে আক্রান্ত ছিলেন।(১৩) ইমামের (আ.) শরীর মোবারকে বিষ ক্রিয়ার প্রভাব প্রকাশ পাওয়ার পর এবং শাহাদতের সময় ঘনিয়ে আসলে সাইয়েদুশ শুহাদা ইমাম হুসাইনকে (আ.) ডেকে বললেন: "আমাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে এবং কলিজার টুকরোগুলো (যা বমি করার সময় বেড় হয়েছে) ট্রেতে রাখা আছে। আমি তোমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ফিরে যাচ্ছি এবং আমি জানি যে কে আমাকে বিষ খাইয়েছে; কিন্তু তোমার উপর আমার যে অধিকার সে সম্পর্কে বলছি এ কথা কাউকে বলনা। যখন আমার চক্ষুদ্বয় বন্ধ হবে এবং আমি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো তুমি আমাকে গোসল করিয়ে দিও এবং কাফন পড়ানোর পর আমাকে নানার কবরের পাশে নিয়ে যেও যাতে আমার কৃত ওয়াদা পূণর্ব্যাক্ত করতে পারি। অতঃপর আমাকে আমার মাতামহ ফাতেমা বিনতে আসাদের (আ.) পাশে বাকিহ কবরস্থানে দাফন কর। অবশ্য তোমাকে এ কাজে বাধা দেয়া হবে। তোমাকে খোদার কসম দিচ্ছি "আমার কারণে এক ফোটা রক্তও যেন মাটিতে না পড়ে"। তারপর তিনি আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ.) যেভাবে ওসিয়ত করেছিলেন নিজের সন্তান ও পরিবারবর্গের জন্য ওসিয়ত করেন এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

ইমাম হাসানের (আ.) জানযার দাফন
ইমাম হুসাইন (আ.) গোসল, কাফন ও নামাযের কার্য সম্পাদনের পর ইমাম হাসানের (আ.) জানাযাকে নবী করিমের (সা.) মাযারের দিকে নিয়ে গেলেন। এ দৃশ্য দেখার পর মারওয়ান ও বনী উমাইয়ার অন্যান্য লোকজন যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে এসেছিল কোন সন্দেহই বাকি থাকে না যে, ইমাম হাসানকে (আ.) নবী করিমের (সা.) পাশে দাফন করার জন্য আনা হয়েছে।
তাই তারা এসে এ কাজে বাধা দান করলো। ইবনে আব্বাস তাদের কথার জবাব দিলেন। হযরত ওসমানের সন্তানেরা এগিয়ে এলো এবং বললো: "কখনই হতে পারে না যে, হযরত ওসমানকে নিকৃষ্টতম স্থানে দাফন করা হবে আর ইমাম হাসানকে (আ.) রাসুলের (সা.) পাশে দাফন করা হবে"।
ইমাম হুসাইন (আ.) বললেন: "যে খোদা মক্কাকে সম্মান প্রদর্শন করেছে তার কসম আলী ও ফাতেমা'র সন্তান হাসান তাদের তুলনায় নবী করিমের (সা.) জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি যারা বিনা অনুমতিতে নবী'র (সা.) ঘরে প্রবেশ করেছে।
যখন দাফন করতে বাধা দেয়া হচ্ছিলো তখন বনী মারওয়ান ইমাম হাসানের (আ.) জানাযায় তীর ছুড়লো। বনী হাশেমরাও তলোয়ার বেড় করে নিলেন কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) তাদেরকে বাধা দিয়ে বললেন: "আমার ভাইয়ের ওসিয়ত যেন বৃথা না যায়"। অতঃপর শত্তুরটি তীর ইমামের (আ.) জানাযা থেকে বেড় করা হলো !(১৪) আর এ ছিল এমন এক অবস্থায় যে, ইমাম হাসান (আ.) পূর্বেই এসব ঘটনার কথা ইমাম হুসাইনকে (আ.) বলেছিলেন।(১৫)
অতঃপর হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বললেন যে, "যদি আমার ভাইয়ের ওসিয়ত না হত তাহলে তোমরা দেখতে যে, এলাহি তলোয়ারগুলো কোথায় ও কিভাবে নেমে আসতো"। তারপর ইমাম হাসানের (আ.) জানাযাকে বাকিহ'তে নিয়ে আসা হল এবং তাঁর দাদী ফাতেমা বিনতে আসাদের (আ.) পাশে দাফন করা হল।(১৬)
শাহাদতের সময় ইমাম হাসান (আ.) ১৫ জন সন্তান ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জুদা থেকে কোন সন্তানই ছিল না।(১৭)

সূত্রসমূহ:
১। তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৫৪; সুনান আবি দাউদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৪; আলামুল ওয়ারা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৮০; মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ, পৃষ্ঠা: ৪৬।
২। তফসিরে সাফি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮৯।
৩। বিহারুল আনওয়ার, ৩১তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬৩৩ ও ৩৭তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১১৬।
৪। মুসতাদরাকে সাফিনাতুল বিহার, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৯৫।
৫। কাফি, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬১; বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৭৩।
৬। কাফি, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩২ ও ৩৩; আল ইরশাদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৮৭।
৭। আল ইরশাদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৮৮ ও ১৮৯।
৮। সুরা আহযাব, আয়াত: ৫৬।
৯। আল ইরশাদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৮৮ ও ১৮৯।
১০। আলামুল ওয়ারা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪০৩; মুনতাহিয়ুল আমাল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৩১; কাফি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৬১; মুসতাদরাকে সাফিনাতুল বিহার, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৯৫।
১১। বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৬১।
১২। তারিখুল খুলাফা, পৃষ্ঠা: ১৯২; আল ইরশাদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৬; বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৪৯; কাফি, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৮১।
১৩। তাতিম্মাতুল মুনতাহা, পৃষ্ঠা: ৪১।
১৪। মুনতাহিয়ুল আমাল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৩৫।
১৫। মাজমাউল বাহরাইন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৫৪।
১৬। আল ইরশাদ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭ -১৯; বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৫৬।

 

নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন