খুন্দ খোরাসানি'র জ্ঞানগত শক্তি ও নতুন চিন্তাধারা
আখুন্দ খোরাসানি'র জ্ঞানগত শক্তি ও নতুন চিন্তাধারা
আখুন্দ খোরাসানিকে জানতে হলে হাওযা ইলমিয়্যাতে যে উসুল বা মৌলিক বিষয়ে কিফায়া ও রাসায়েল বই পড়ানো হয় সেখানে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি নজর দিতে হবে। আর সেইসব দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে তাঁকে "মোহাক্কেক" বলা হয়ে থাকে।
কিন্তু তাঁর লিখিত ফিকাহ শাস্ত্রের বইয়ে এমনকি তাঁর দেয়া ফতোয়া সম্বলিত বই (রিসালাহ)'তে এই মোহাক্কেক বা গবেষকের নতুন রূপ তুলে ধরা হয়েছে যা প্রমাণ করে যে, জনাব আখুন্দ ফিকাহ শাস্ত্রের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের দরজা খুলে ধরেছেন এবং নতুন গবেষণা উপস্থাপন করেছেন। এই প্রবন্ধের লেখক যিনি গত কয়েক বছর "মোআস্সেসেয়ে কেতাব শেনাসিয়ে শিয়া" (শিয়া বই পরিচিতি সংস্থা)'র পরামর্শে আখুন্দের চিন্তাগত ভিত্তির ব্যাখ্যা -বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাতে মশগুল ছিলেন এবং সবশেষে এ পরিণামে পৌঁছেছেন যে, জনাব আখুন্দ তাঁর খ্যাতির সাথে সাথে হাওযা ইলমিয়্যার জন্য একজন অপরিচিত গবেষক রয়ে গেলেন এবং তাঁর ফিকাহগত গভীর আলোচনা যা একদিক দিয়ে নতুনত্ব ও অনুসন্ধানী এবং অপর দিকে স্বাধীনতা ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ ছিল, যা গবেষকদের জন্য নতুন দরজা খুলে দেয়। আখুন্দ খোরাসানির চিন্তাগত বইয়ে আমি এ দু'টি বৈশিষ্ট্যের বিস্তারিত বর্ণনা করেছি এবং এখানে স্মরণ করিয়ে দেবো যে, "আখুন্দের ফিকাহগত ধরণ" এবং তাঁর বিভিন্ন উদ্যোগ যদিও গবেষকদের জন্য হচ্ছে পথপ্রদর্শক ও আকর্ষণীয়। কিন্তু এ পদ্ধতি সাধারণ আলেম এবং আলেম বা জ্ঞানীদের মত দেখতে অজ্ঞদের জন্য সহ্য করার মত নয়। এ প্রবন্ধটিতে সংক্ষেপে আখুন্দ খোরাসানির বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁর চিন্তাভাবনার প্রতি ইশারা করা হয়েছে।
আখুন্দের (লিখিত) ফিকাহ শাস্ত্র তার বৈশিষ্ট্যের কারণে যারা গবেষণা করে তাদের জন্য অনেক আকর্ষণীয় এবং সূক্ষ্মদৃষ্টি, নতুনত্ব, উদ্যোগ ও গভীরতার কারণে এস্তেম্বাত, ইজতেহাদ ও মুজতাহিদদের তারবিয়াতের জন্য জীবন্ত থাকবে। কিন্তু এ ফিকাহ সাধারণ লোকদের জন্য বিকর্ষণ স্বরূপ। আখুন্দের অনেক ফতোয়া জনগণের মন মানসিকতার সাথে মানানসই নই, তাই এ লোকগুলোকে আখুন্দের মোকাল্লিদ হওয়ার চেয়ে নিজেদের আচার ব্যবহার ও আকিদাগত বিষয়ে পরিবর্তন আনা উচিত এবং নিজেদের বিভিন্ন কাজকর্মে সংশোধন আনা প্রয়োজন। জনাব আখুন্দের ফিকাহ শাস্ত্র জনগণের আচার আচরণের পবিত্রতার বেষ্টনী হতে উদ্ধৃত এবং কখনো কখনো শরিয়ত বিরোধী বলে তার নিন্দাও করেছেন।
আখুন্দের ফিকাহ ও ফতোয়া সাধারণ জনগণের জন্য মানানসই না হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে:
১। আখুন্দের ফতোয়াতে অনেক বিষয় রয়েছে, যা তাঁকে মশহুর ও বিখ্যাত দৃষ্টিভঙ্গি হতে অনেক দূরে নিয়ে যায়, আর যেহেতু মশহুর ফতোয়াসমূহ জনগণের মাঝে বেশি গ্রহণীয় তাই যদি কোন মুজতাহিদ কখনো তাতে প্রতিবাদ বা আপত্তি করে, আসলে তখন সে জনগণের মাঝে নিজের ব্যক্তিত্বর উপর আঘাত করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, জনগণের জন্য খুব কঠিন ব্যাপার হবে যে, আখুন্দের মত একজন লোক কালিল বা এক কুরের কম পানিতে অপবিত্র জিনিষের মিশ্রণের ব্যাপারে দ্বিধা -সংকোচ করবে অথবা কুকুরের খাওয়া ঝুটা খাদ্য সম্পর্কে কোন ফতোয়া দেবে না! তাদের জন্য খুবিই কঠিন বিষয় যে, তাদের মুজতাহিদ নারীদের হায়েয বা ঋতুস্রাবের বিষয়ে সৈয়দ নারীর সাথে সৈয়দ নয় এমন নারীর কোন পার্থক্যকে অস্বীকার করবে তাতে ৬০ বছর বয়সকালকে তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে করবে না ইত্যাদি।
২। সাধারণ জনগণ যেভাবে মশহুর দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতাকে অপছন্দ করে তদ্রূপ যারা মশহুরের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রদান করেছেন তাদেরকে পথভ্রষ্ট লোক হিসেবে বিবেচনা করে। তাছাড়া নতুন কৃতিত্ব বা নতুনত্ব হতেও ঘৃণা করে। তারা নতুন ফতোয়াকে নতুন ফিকাহ বলে এবং সবশেষে নতুন ধর্ম বলে মনে করে। আর নতুন ফতোয়ার নাম শুনলেই ততক্ষণাত তার বিরোধিতা করে এবং বলে: অমুক লোকের কি জ্ঞান কম ছিল যে, এরকম ফতোয়া প্রদান করেছে? আর যদি এ ফতোয়া সঠিক থাকে তাহলে অতীতের ওলামায়ে কেরামরা কেন অন্য রকম ফতোয়া দিয়ে গেছেন? আর যেহেতু জনাব আখুন্দের ফিকাহতে বিভিন্ন রকম নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়, যেমন: "সাময়িকভাবে কোন কিছুকে ওয়াক্ফ করা যাবে", স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ জনগণ আখুন্দের ফিকাহকে স্বাগতম জানায় না। জনগণের জন্য সহ্য করা সম্ভব নয় যে, একজন ফকিহ কোন মারজার তাকলিদের বিষয়ে পুরুষ হওয়াকে শর্ত মনে করবে না!
৩। সাধারণ জনগণ ধর্মীয় রীতি -নীতির ক্ষেত্রে কখনো এমন সব পদ্ধতি অনুসরণ করে যে, একদিক থেকে তা আহলে বাইত (আ.) এর শিক্ষার সাথে মেশে না এবং অন্য দিকে পুরোপুরি কুসংস্কার ও ভ্রষ্টতায় ভরা। আর তারা এরকম মুজতাহিদকে পছন্দ করে যে তাদের এ সকল আচার অনুষ্ঠানের বৈধতা দেবে। অথবা কমপক্ষে সেসব বিষয় সম্পর্কে কিছু বলবে না।
উদাহরণস্বরূপ শাবিহ খানি ও তাযিয়া খানি (একজন ইমাম হুসাইন (আ.) ও একজন ইয়াজিদ বা হযরত যাইনাব (সা.) ইত্যাদি বেশে সেজে কারবালার ঘটনাকে মঞ্চনাট্ট হিসেবে তুলে ধরে) যা মোহররমের একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান, আখুন্দ যদিও মূল অনুষ্ঠানকে হারাম বলেননি কিন্তু এসব অনুষ্ঠানে কিছু কিছু গুনাহ বা পাপ কাজের মিশ্রণ ঘটেছে বলে মনে করেন এবং বলেন: "গান বাজনা করা, কোনো পুরুষ নারীর লেবাস পড়ে, কোনো নারী পুরুষের লেবাস পড়ে, মিথ্যা কোনো শ্লোক গাঁথা বা কবিতা পাঠ করা, নারী -পুরুষের সংসর্গ ইত্যাদি সবকিছুকে শাবিহ খানিতে হারাম বলে মনে করেন"। আখুন্দ অবশ্য কামা যানি বা মাথায় ছোড়া দিয়ে মাতম করার পক্ষে ছিলেন না এবং সরাসরি তাকে "হারাম" বলে মনে করতেন।
এটা পরিষ্কার যে, এক শতাব্দী পূর্বে সংস্কৃতি ও মাযহাবগত পরিবেশে এসকল ফতোয়া প্রদান করার মাধ্যমে জনাব আখুন্দ কতটুকু সাধারণ জনগণকে নিজের থেকে দুরে সরিয়ে দিতেন। আখুন্দ কখনোই তাদেরকে খুশি করার উদ্দেশ্যে এসকল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করা হতে বিরত থাকতেন না।
৪। জনসাধারণের মধ্যে এমন কিছু আচার ব্যবহার রয়েছে যে, অনেক সময় সেগুলোকে ধর্মীয় সুন্নত বলে মনে করা হয়। জনাব আখুন্দ এসকল সুন্নত সম্পর্কে খুবি সংবেদনশীল ছিলেন। আর প্রয়োজনীয় হুকুম আহকামের মত তার মূল দলিল প্রমাণ খুঁজে বেড়াতেন। আর যেহেতু অনেক বিষয়ে কোন দলিল প্রমাণ খুঁজে পেতেন না তখন বিবাদের সৃষ্টি হত। যেমন: বলা হয়ে থাকে যে, মৃত ব্যক্তির কাছে চেরাগ জালানো মোস্তাহাব, কিন্তু জনাব আখুন্দ "জামে আব্বাসি" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: "তাঁর দৃষ্টিতে চেরাগ জালানোর মোস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে সমস্যা রয়েছে"। এমনিই বলা হয়েছে যে, আকিকার জন্য কোরবানি কৃত জন্তুর হাড় ভাঙ্গা মাকরুহ কাজ, কিন্তু জনাব আখুন্দ এ বাক্যটিকে তার "তাবসেরাহ" বইতে বাদ দিয়েছেন এবং "তাকমিলাতুত তাবসেরাহ" বইতেও উল্লেখ করেননি।
৫। কাফেরদের ব্যাপারে আখুন্দের প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গিও তার ফতোয়াগুলোর মধ্যে দেখা যায়। সাধারণ অজ্ঞ লোকের দৃষ্টিতে এটি ক্ষমা না করার মত একটি বড় গুনাহর কাজ। আখুন্দ অমুসলিম (আহলে কিতাব) নারীদের সাথে বিবাহকে বৈধ মনে করেন এবং তাদের জন্য কোনো কিছু ওয়াক্ফ করা বা তাদের জন্য নেকি করাকেও জায়েজ মনে করতেন। জনাব আখুন্দের দৃষ্টিতে খ্রীষ্টানদের গীর্জাতে "কাফেরের মুআল্লাফাতুল কুলুব" এর মত ইতিবাচক কাজে সাহায্য করা শুধু পছন্দনীয়ই নয় বরং এটি একটি ওয়াক্ফ হিসেবে ইবাদতের অন্তর্ভুক্তও হতে পারে।
৬। আকিদাগত বিষয়েও জনাব আখুন্দের কিছু বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যা জনসাধারণে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে। এ দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তির কাফনে আয়েম্মায়ে মাসুমিন (আ.) এর নাম লেখা। আল্লামা তাঁর "তাবসেরাহ" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:
"و يستحب ان يكتب اسماء الائمه"
কিন্তু জনাব আখুন্দ ব্যাখ্যা -বিশ্লেষণের সাথে একমত নন এবং আয়েম্মাদের নাম লেখার ব্যাপারটাকে মোস্তাহাবের ফতোয়া না দিয়ে "তাবার্রুক" স্বরূপ মনে করেন:
"و يستحب ان يكتب علي اللفافه... اسمه و انه يشهد شهادتين، و يضاف اسماء الائمه تبركاً"
অবশ্য সাধারণ লোকেরা কথার দলিল ও প্রমাণের এস্তেম্বাতের গুরুত্ব সম্পর্কে কোনো খবর রাখে না। তারা এ ধরণের বিবাদকে আকিদাগত দুর্বলতা বলে মনে করে এবং এর মোকাবেলায় দলিল প্রমাণ ছাড়া ফতোয়া দেয়াকে পবিত্রতা ও তাকওয়ার নিদর্শনস্বরূপ মনে করে!
অবশ্য আখুন্দের প্রত্যেকটি দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ করে এখানে যা আমরা উল্লেখ করেছি সেগুলো গবেষকদের দৃষ্টিতে সমালোচনা ও পর্যালোচনা হতে পারে কিন্তু যারা এসকল দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করার যোগ্যতা রাখেন না তারা শুধু হৈ চৈ করতে ও প্রতিবাদ করতে জানে এবং একজন মুজতাহিদের জ্ঞানগত ও সামাজিক ব্যক্তিত্বের উপর হামলা করে। তাঁকে বিধর্মী ও অজ্ঞ বলে অপবাদ দেয়। আখুন্দও এ ধরণের লোকদের অপবাদ হতে রক্ষা পাননি।
বর্তমানে হাওযা আখুন্দ খোরাসানির মত ব্যক্তিত্বের মত স্বাধীন চেতা ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গির ফকিহর মূখাপেক্ষী।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন