হযরত আলী (আ.) এর বংশ পরিচয় ও জন্ম
হযরত আলী (আ.) এর বংশ পরিচয় ও জন্ম
আদম (আ.) সৃষ্টি হতে আজ পর্যন্ত প্রতিটি যুগে পৃথিবীর বুকে অসংখ্য মহামানবের আগমণ ঘটেছে। তাদের অনেকের কথা আমাদের মাঝে এখনও চর্চা হয় এবং আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, আবার তাদের কারো কারো নাম ইতিহাসের উত্থান-পতনে নাম মুছে গেছে অথবা মুছে ফেলা হয়েছে।
হযরত আলী (আ.)ও এমন একজন ব্যক্তিত্বের নাম, যার নাম শত্রুরা শত চেষ্টা করেও ইতিহাসের পাতা হতে মুছে ফেলতে পারেনি। কেননা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতেই তিনি ইসলামের প্রতিটি ঘটনার সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন এবং ইসলামকে তত্কালীন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে যে অবদান তিনি রেখেছেন তা আজও মুসলমানরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর নবুয়্যতি মিশনের শুরু দিন হতে তাঁর জীবনের অন্তিম লঘ্ন পর্যন্ত হযরত আলী (আ.) তাঁর পাশে অবস্থান করেছেন। ছোটবেলা থেকেই নবী (স.) এর সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা হযরত আলী (আ.) শত প্রতিকূলতার মাঝেও কখনই মহানবী (স.) কে নিঃসঙ্গ ত্যাগ করেন নি।
যার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে ওহুদের যুদ্ধ। যখন সাহাবীরা নিজের জীবনের মায়ায় আল্লাহর রাসূল (স.) কে ত্যাগ করে পলায়নে ব্যস্ত তখন ইসলামের অকুতোভয় এ সৈনিক ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন শত্রুদের উপর। আর আহত আল্লাহর রাসূল (স.) কে রক্ষা করছিলেন তাঁর (স.) দেয়া তলোয়ার চালিয়ে ও নিজের শরীরে আঘাতের পর আঘাত গ্রহণের মাধ্যমে।
ওহুদের যুদ্ধের দিনে মহানবী (স.) এর উপর আস্থা হারানো সাহাবীরা পরবর্তীতে ইসলামের এ এ সেনাপতিকে –যিনি নুবয়্যতি জ্ঞান ও শিষ্টাচারের মাঝেই বেড়ে উঠেছেন- বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করতে থাকে। কিন্তু এ প্রবাদের ন্যায় –যাতে বলা হয়েছে যে, ‘আতর অনাস্ত কে খুদ বেবুয়াদ, না অনকে আত্তার বেগুয়াদ’ (সুগন্ধী আতর হচ্ছে সেটা যা নিজেই সুগন্ধ ছড়ায়, ঐটা নয় যার প্রশংসা বিক্রেতা করে)- ইমাম আলী (আ.) সুগন্ধী আতরের ন্যায় নিজেই সুবাশ ছড়িয়েছেন, চাই অন্য কেউ তার প্রশংসা করুক বা না করুক।
ইসলামের শত্রুরা বিশেষতঃ বনি উমাইয়া চক্র ক্ষমতায় আসার পর হযরত আমিরুল মু’মিনীন (আ.) এর উপর গাল-মন্দ করার প্রচলন ঘটায়। এরপর হতে বনি উমাইয়া সরকারের অধিনে থাকা সকল মেম্বর হতে আমিরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আ.) এর উপর গালমন্দ করা হয়। যা দীর্ঘ কয়েক দশক যাবত অব্যাহত ছিল।
এছাড়া হযরত আলী (আ.) এর শানে যে সকল হাদীস মহানবী (স.) হতে সাহাবীরা বর্ণনা করেছেন সেগুলোকে কখন মুছে দিয়ে, আবার কখনও বা জায়িফ (দূর্বল) বলে উল্লেখ করে তার মর্যাদাকে খর্ব করার অপচেষ্টাও চালানো হয়েছে (যার কিছু কিছু নমুনা বর্তমানেও পরিলক্ষিত)। কিন্তু যারাই এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে তারাই হয়েছে অপদস্ত এবং হযরত আমির (আ.) এর সম্মান ও মর্যাদা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।
‘অন্যন্য সাহাবীদের উপর হযরত আলী (আ.) এর শ্রেষ্ঠত্ব’ শীর্ষক এ সিরিজে আমরা তাঁর (আ.) শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ইতিহাস হতে বিভিন্ন দলিল ও প্রমাণ উপস্থাপন করব। যেগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে আবনা পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করা হবে।
হযরত আলী (আ.) এর বংশ পরিচয়
প্রাচীণকাল হতেই বংশ মর্যাদার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। আর সর্বক্ষেত্রে এর বিশেষ কার্যকারিতা রয়েছে, বিশেষতঃ যখনই কোন বিবাহের কথা ওঠে তখন বংশ মর্যাদারবিষয়টিকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মতই দৃষ্টিতে রাখা হয়। আর কোরআন ও হাদীসের পাশাপাশী বর্তমান যুগে সায়েন্সও এটা প্রমাণ করেছে যে, ভাল ও সুস্থ পিতা-মাতাই সমাজকে একটি ভাল ও সুস্থ সন্তান উপহার দিতে সক্ষম। তাই সবকিছুর আগে হযরত আলী (আ.)-এর বংশ পরিচয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যাক।
বংশের দিক হতে রাসূল (স.) এর মত একই বংশ পরিচয়ের অধিকারী তিনি। কেননা তারা ছিলেন পরস্পরের চাচাতো ভাই। আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন তাদের পিতামহ। হযরত মহানবী (স.) ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ (আ.) এর একমাত্র সন্তান এবং হযরত আলী (আ.) ছিলেন হযরত আবু তালিবের কনিষ্ঠ সন্তান।
ঐতিহাসিকগণ যেভাবে এ মহান দুই ব্যক্তিত্বের পূর্বপুরুষদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন, ঠিক সেভাবেই আপনাদের জন্য উল্লেখ করা হল:
পর্যায়ক্রমিকভাবে তাঁদের পূর্বপুরষগণ হলেন- আবুতালিব, আব্দুল মোত্তালিব, হাশেম (এই নামের কারণেই আহলে বাইত (আ.) গণকে হাশেমী বলা হয়), আব্দে মানাফ, কুসাই, কালাব, মুর্রা,কায়া’ব, লুওয়াই, গালিব, ফাহ্র, মালিক, নাদ্র, কানানাহ, খুযাইমাহ, মুদরেকাহ, ইলইয়া’স, মুযার,নাযার, মায়াদ, আদনান। (কামেলে ইবনে আসির, ২য় খণ্ড, পৃ. ১ ও ২১)
নিশ্চিতভাবে, তাঁদের পূর্ব পুরুষের তালিকা মায়াদ বিন আদনান পর্যন্ত এভাবেই সঠিক। কিন্তু আদনানের পূর্বপুরুষগণ হতে হযরত ইসমাঈল (আ.) পর্যন্ত, সংখ্যা এবং নামের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য রয়েছে। আর ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়েত অনুযায়ী যা তিনি হযরত মহানবী (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন, যখনই তাঁর পূর্বপুরুষের তালিকা আদনান পর্যন্ত পৌঁছায় তখন তিনি আদনান হতে অতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন। কেননা যখন তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের নামের তালিকা বর্ণনা করেছেন,তখন আদনানের পর আর কারো নাম বলেন নি। আর তিনি নির্দেশ দিতেন যে, আদনান হতে ইসমাঈল (আঃ) পর্যন্ত তাঁর পূর্বপুরুষদের নাম গণনা না করার জন্য।
তিনি আরো বলেছেন: আর এ সম্পর্কে যা কিছু আরবদের মধ্যে প্রসিদ্ধ, সেগুলো সঠিক নয় (সিরায়ে হালাবি, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৬)। তাই আমরাও রাসূল (সঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক শুধুমাত্র আদনান পর্যন্ত গণনা করাকে যথেষ্ঠ মনে করবো।
উপরোক্ত আলোচনার পর পাঠক মহোদয়ের নিকট এই বিষয়টি কি স্পষ্ট নয় যে, বংশ মর্যাদার দিক থেকেও অন্যান্য সাহাবীদের উপর আলী (আ.) এর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে?! কারণ যদি অন্য কারো বংশ মর্যাদা আলীর চেয়ে উচ্চ হয় তবে তাঁর বংশ মর্যাদা মহানবী (স.)-এরও উপরে। আর আমরা এটা জানি যে, বংশের দিক থেকে মহানবী (স.) মর্যাদার সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করছেন। আর যেহেতু আলী (আ.) তাঁর আপন চাচাতো ভাই, তাই তিনিও এ দিক থেকে অন্যান্য সাহাবীদেরওপরে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
কাবা গৃহে জন্মগ্রহণ
আলী (আঃ)-এর কাবাগৃহ অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণের বিষয়টিতে ওলামাদের মতৈক্য রয়েছে। (মুরুরুয যাহাব, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৫৮; তাযকেরাতুল খাওয়াস, পৃ. ১১; কাশফুল গাম্মাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৯; মানাকেবে ইবনে শাহরে আশুব, ২য় খণ্ড, পৃ.১৭৫; আ’লামুল ওয়ারা, পৃ. ১৫৩; শাবলাঞ্জি কর্তৃক রচিত নূরুল আবসার, পৃ. ৮৫; বিহারুল আনওয়ার, ৩৫তম খণ্ড, পৃ. ৭, হাদীস নং ১০; ফুসুলুল মুহিম্মাহ, পৃ. ১২)
আর মতৈক্য রয়েছে এ বিষয়েরও উপর যে, একমাত্র আলী (আ.)-ই এমন মহান সৌভাগ্যেরঅধিকারী। কোন সাহাবী তো দূরের কথা কোন নবী, রাসূল ও আল্লাহর ওলীও এমন সৌভাগ্য লাভ করেন নি।
কিন্তু ফাতেমা বিনতে আসাদের (হযরত আলী (আ.) এর মাতা) কা’বা গৃহে প্রবেশ ও সেথায় তাঁর জন্মগ্রহণের ঘটনাটির বর্ণনায় রাবী ও ঐতিহাসিকদের মাঝে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ইবনে আব্বাস তার পিতা আব্বাস হতে যে রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন তাতে এটা স্পষ্ট হয় যে, কা’বা গৃহের দরজায় তালা লাগানো ছিল এবং ফাতেমা বিনতে আসাদ কর্তৃক দোয়া, পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণ ও আসমানী কিতাবের উপর স্বীকৃতি দেয়ার পর, তাঁর পিতামহ হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর কথায়,আল্লাহকে কা’বা গৃহের, যে তাকে তৈরী করেছে তাঁর, এবং যে সন্তান তার গর্ভে বিদ্যমান ছিল তার কসম দেবার পর তার সন্তান প্রসব সহজতর করার জন্যে কা’বা গৃহের দেয়ালে ফাঁটলের সৃষ্টি হয়।
হযরত আব্বাস (রা.) বলেন: আমি দেখলাম যে, কা’বা গৃহের দেয়াল বিপরীত দিক থেকে ফেঁটে গেল এবং ফাতেমা তাতে প্রবেশ করল। অতঃপর দেয়াল পূনরায় পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেল। এরপর আমরা যতই চেষ্টা করলাম দরজা খোলার জন্যে -যাতে আমাদের কিছু মহিলারা ফাতেমার নিকট গিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারে- কিন্তু দরজা খুললো না। আর তখনই বুঝতে পারলাম যে, এটা স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে। ফাতেমা তিনদিন কা’বা গৃহের মধ্যে অবস্থান করলো। চতুর্থ দিন আল্লাহর নির্দেশে দরজা খুলে গেল এবং যে স্থান দিয়ে ফাতেমা প্রবেশ করেছিলো ঠিক সে স্থান দিয়েই সেবেরিয়ে এল... (খারায়েজ ও জারায়েহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭১; মানাক্বেবে ইবনে মাগাযেলী, পৃ. ৭; [সামান্য পার্থক্যে বর্ণিত হয়েছে] নাহজুল হাক্ব, পৃ. ২৩৩; [সামান্য পার্থক্যে বর্ণিত হয়েছে] এহকাকুল হাক্ব, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৫৬)
‘বাশারাতিল মুস্তাফা’ ইয়াযিদ ইবনে ক্বানআব হতে বর্ণনা করেছেন, “যখন ফাতেমার প্রসব বেদনা উঠল তখন তিনি কা’বায় প্রবেশ করলেন, অতঃপর তিনি বেরিয়ে এলেন, এমতাবস্থায় তার হতে আলী (আ.) ছিলেন।” (বাশারাতুল মুস্তাফা, পৃ. ৮; বিহারুল আনওয়ার, ৩৫তম খণ্ড, পৃ. ৮ ও ৯)
অন্য একটি রেওয়ায়েত হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত হয়েছে, “ফাতেমা জন্ম দিয়েছেন আলী (রা.) কে কা’বাগৃহে।” (বিহারুল আনওয়ার, ৩৫তম খণ্ড, পৃ. ৩৬ ও ৩৭)
ওয়ারযান্দি শাফেয়ী ‘নাযমুদ দুরার’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, “যখন ফাতেমার প্রসব বেদনা উঠলো তখন আবু তালিব (আঃ) এশার পর তাকে কা’বা গৃহে প্রবেশ করান অতঃপর আলী (আঃ) সেখানে জন্মলাভ করেন।” (নাযমু দুরারুস সামত্বীন, পৃ. ৮০)
শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, কোন নবী-রাসূল (আ.)ও এমন সৌভাগ্যের অধিকারী হননি। তাই সাহাবাদের মধ্যে তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণের জন্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের সম্মুখে এমন শক্ত দলিল উপস্থাপনের পর আর কোন দলিলের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আর তার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এটাও যথেষ্ঠ যে, তিনি তার জীবনের প্রথম নিঃশ্বাসটি আল্লাহর ঘরেই ফেলেন। যা অন্যান্য সাহাবীদের ভাগ্যে জোটেনি।
উল্লেখ্য, কিছু বছর পূর্ব পর্যন্ত সে ফাঁটলটি কা’বা গৃহের দরজার বিপরীত পার্শ্বে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই ফাঁটলটি আর পরিলক্ষিত হয় না। কেননা তদস্থল ইট দ্বারা গেঁথে দেয়া হয়েছে। আপনার যারা দেখতে ইচ্ছুক তারা যদি কখনো মক্কায় যাবার সৌভাগ্য অর্জন করেন, তবে অবশ্যই দেখতে পাবেন যে, কা’বা গৃহের অন্যান্য স্থানের গাঁথুনি হতে সেই স্থানের গাঁথুনির যথেষ্ঠ অমিল রয়েছে। আর এটাই এর স্পষ্ট সাক্ষি যে, এই স্থানে পূর্বে কোন কিছু ছিল যা বর্তমানে মুছে ফেলা হয়েছে।
(সূত্র : ইন্টারনেট)
নতুন কমেন্ট যুক্ত করুন